শিলিগুড়ি থেকে কালিম্পং যাবার পথে, জীপের সিট পেয়েছিলাম একদম পিছনে আর মাঝখানে! যেটা সবচেয়ে অপছন্দের যায়গা! যে মন খারাপের শুরুটা হয়েছিল বাংলাবান্ধা পোর্ট থেকে, সেটা ধীরে ধীরে বাড়তে লাগলো, বিভিন্ন ঝামেলায়। যে কারণে জীপের যাত্রাটা সঠিক উপভোগ করতে পারছিলাম না এতটুকুও। গুম মেরে বসে ছিলাম কোন মতে চেপেচুপে।
কিন্তু ৩০ মিনিট পরে জীপ কয়েকটি বাঁক নিয়ে পাহাড়ি উঁচু রাস্তায় পড়তেই, হুট করে গুমোট ভাবটা কেটে গেল! পাহাড় আমাকে এতটাই বিমোহিত করে সব সময়, যে ওকে দেখলেই কিভাবে যেন দুঃখ-ব্যাথা আর সকল না পাওয়া ভুলে যাই! তখনও তাই হল। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তায়, হেলেদুলে চলতে শুরু করতেই জানালার পাশে না বসতে পারার দুঃখ কিছুটা হলেও ভুলে গেলাম। তাকিয়ে ছিলাম কাছে-দূরের সবুজ আর বাদামী পাথুরে পাহাড়দের দিকে, মুগ্ধ নয়নে।
কিন্তু এই ভালো লাগাটাও খুব একটা সময় রইলোনা, যখন আরও প্রায় ১৫ মিনিট যাবার পরে চোখে পড়লো ডানে গভীর, গতিশীল আর উম্মত্ত তিস্তার বয়ে চলা, তার ওপাশে বিশাল বিশাল সব সবুজ পাহাড়ের দাড়িয়ে থেকে আমাকে উপহাস করা, জানালার পাশে বসে একই সাথে পাহাড় আর উচ্ছ্বসিত তিস্তা দেখতে নাপারার জন্য অবজ্ঞা ভরে তাকিয়ে থাকা দেখে।
তবুও মনের বেদনা মনে চেপেই চলছিলাম, কিন্তু সেই চেপে রাখা বেদনা আর একান্ত কষ্টটা যেন গুমরে উঠতে চাইলো, আর একটু পরেই তিস্তার বুকে এসে আছড়ে পড়া একাধিক ঝর্ণাধারা দেখে! কি তার রূপ, কি তার আহবান, আর কি তার সবুজ পাহাড়ের বুক চিরে হনহন করে কোমর দুলিয়ে বয়ে চলা দেখে! সাদা ফেনার উচ্ছ্বাস, টলটলে নীল জলে অবগাহন করতে না পারাটা তখন আরও বেশী করে কুঁকড়ে দিচ্ছিল প্রতি ক্ষণে ক্ষণে। সেই না পাওয়া মেনে নিয়েই চলে যেতে হয়েছিল, আর মনে মনে ভাবছিলাম, এবারের ভ্রমণটা বোধয় আর আনন্দদায়ক হলনা বা হবেনা।
এরপর, লাভার বৃষ্টি ভেজা বিকেল, পাহাড়ের চুড়ায় ধোঁয়া ওঠা কফির আনন্দ আর রিশপের মন কাড়া মোহময়তায় আচ্ছন্ন থেকে ফিরে আসার জন্য আবার জীপে ওঠা। এবার আর মাঝে নয়, জানালার পাশে! কালিম্পং এসে বাসে করে শিলিগুড়ির পথ ধরলাম। কালিম্পং থেকে শিলিগুড়ি জীপে ২:৩০ ঘণ্টা কিন্তু বাসে সেটা ৩ ঘণ্টার পাহাড়ি পথে যাত্রা শুরু হল।
ঘুমে জাগরণে কেটে গেল প্রায় এক ঘণ্টা। একটা ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ বাঁকের কাছে এসে আচমকা ব্রেক করাতে ঘুম ভেঙে গেল। আর ঘুম ভাঙতেই, চোখে পড়লো মাইলের নাম ফলক, যেখানে লেখা তিস্তা ১৫ কিলো। উহ আবারো তিস্তা? আবারো সেই মন পাগল করা স্বচ্ছ ঝর্ণার বয়ে চলা, আবারো পাহাড়ের সবুজ শরীর বেঁয়ে বেঁয়ে তিস্তায় গড়িয়ে পড়া! পাথরের পানিতে মাখামাখি, আনন্দ আর ওদের একান্ত অবগাহন দেখে, লোভাতুর হয়ে পড়া! আর সেই সব চোখ দিয়ে দেখে দেখে তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়া।
এইসব ভাবতে ভাবতেই চলে এলো তিস্তার উচ্ছ্বসিত শব্দের গান। দুই পাশে সবুজ খাড়া পাহাড়, মাঝে ছুটে চলা তিস্তার নাচন! এক পাহাড়ের পিঠের আঁকাবাঁকা রাস্তায় আমার বাসের হেলেদুলে ছুটে চলা। ছিট থেকে নেমে দরজার পা-দানিতে গিয়ে বসলাম ছবি তুলবো আর ভিডিও করবো বলে। তাই-ই করছিলাম একা একা আপন মনে।
করনেশন ব্রিজ নামে এক আশ্চর্য ব্রিজ দেখলাম তিস্তার দুই পাশের দুই পাহাড়কে অসমান্ন উপায়ে এক করেছে। করেছে দুই পাহাড়ের মানুষ ও যানবাহন যাতায়াতের এক অনন্য উপায়, যেখানে নদীর কোনই ক্ষতি করা হয়নি। দেখতে দেখতে হঠাৎ দেখলাম, নদীর গতি কমতে কমতে এক জায়গায় গিয়ে পানি আর কোন দিকে যাচ্ছেনা! থমকে আছে! কিন্তু পাহাড়ি ঢলের পানির গতি রোধ করে রাখার, যেন রাগে ফুঁসে ফুঁসে উঠছে! মাঝে মাঝে প্রকাশ করছে ওর ছুটে চলার অবাধ্যতা!
এরপর একটু এগোতেই দেখা গেল, তিস্তায় বিদ্যুৎ কেন্দ্র করা হয়েছে, যে নদীর পানি জমিয়ে এক যায়গার রেখে, সুইস গেট দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে, যা ছেড়ে দিলেই অপর পাশে তৈরি হচ্ছে এক জলোচ্ছ্বাসের বীভৎসতা! যার পরিণাম হিসেবে তৈরি হচ্ছে জলবিদ্যুৎ! প্রকৃতির কাছ থেকে কি অদ্ভুত উপায়ে তৈরি করছে দেশের জন্য সম্পদ। মানুষের জন্য পূরণ করছে মৌলিক চাহিদা।
আর ১০ মিনিট এগোতেই, সেই দুইদিন আগে রেখে যাওয়া ঝর্ণার বয়ে চলা ধারা। যা সবুজ পাহাড়ের মাঝ দিয়ে, পাথরে-পাথরে ঠেলাঠেলি করে, গড়িয়ে-গড়িয়ে মিশে যাচ্ছে তিস্তার মাঝে, যে ঝর্ণা ধারা নিজেকে বিলীন করে দিচ্ছে তিস্তার বুকে, আর ভেসে যাচ্ছে অনন্ত সুখের উচ্ছ্বাসে। যেখানে হঠাৎ দেখা মিলল, দুই একটি ট্রাকের! যে ট্রাকে করে তিস্তার বুক থেকে তুলছে প্রয়োজনীয় পাথর! অত উঁচু পাহাড় থেকে ওই নিচুতে তিস্তার বুক থেকে পাথর তুলতে দেখেই নতুন রোমাঞ্চের বিদ্যুৎ খেলে গেল প্রতিটি শিরা-উপশিরায়!
আর সেই রোমাঞ্চ হল, ওই তিস্তার বুকে যদি অমন কঠোর ট্রাক ঠাই পেতে পারে, তুলে নিতে পারে পাথর, পেতে পারে অমন টলটলে নীল জলের পরশ! যার কোন অনুভূতিই নেই, সেই অনুভূতিহীন আর স্বাদহীন ট্রাক যদি পেতে পারে তিস্তার শীতল পরশ, নরম স্পর্শ, তবে আমি কি দোষ করলাম! নাহ, আমাকেও পেতে হবে তিস্তার নরম স্পর্শ, কোমল ছোঁয়া আর নীল জলের অবগাহন, আমিও ভেসে যেতে চাই, ওর বুকে, ডুবে যেতে চাই ওর অতলে!
এই ভাবনা ভাবতে ভাবতেই, গাড়ি নতুন বাঁক নেয়া শুরু করেছে... সামনে আর একটি ব্রিজ পেরোবে। ততক্ষণে নিজের সাথে নিজের যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। আমি কি নেমে যাবো? আর যদি নেমে যাই, তবে কি আবার যেতে পারবো আমার গন্তব্যে? এখান থেকে কি গাড়ি পাওয়া যাবে পরে? কিছুইতো জানিনা! আর যতটা পথ যেতে হবে তার অর্ধেকও তো আসিনি এখনো, অথচ টিকেট কাঁটা পুরো জার্নির-ই।
আবার ভাবছি না হয় নেমেই যাই! এমন অদ্ভুত সুন্দর ঝর্ণার বয়ে চলা স্বচ্ছ নীল জলে যদি আর নাহয় কখনো গাঁ ভেজানো, যদি আর না পাই এমন আদুরে আহবান আর কোন নদীর, যেখানে পাহাড় মিশে গেছে ঝর্ণা আর নদীর সাথে, করেছে তিনজন মিলে অদ্ভুত আলিঙ্গন! আর যদি না হয় গোসল করা এমন শীতল জলে? কি আছে জীবনে, কে আছে বাঁধা দেবার? কে আছে আমাকে ঠেকবার? তবুও একবার না হয় জেনে নেই বাসের কারো কাছ থেকে যে এখানে নেমে গেলে পরে কোন কিছু পাওয়া যাবেন কিনা শিলিগুড়ি যাবার?
পুরো ভাবনাটুকু ছিল, ৩০ সেকেন্ডের আর মাথায় ছিল অতিরিক্ত ৫০ টাকার ভাড়ার ভাবনা।
বাসের হেল্পারকে জিজ্ঞাসা করতেই জানালো সব সময় পাওয়া যাবে কোন না কোন কিছু শিলিগুড়ি যাবার, একটু অপেক্ষা করতে হবে এই আর কি? এই কথা শোনা মাত্র, ব্যাগ কাছে, পানির বোতল হাতে, সানগ্লাস চোখে আর ক্যাপ মাথায় দিয়ে, হেল্পারকে বললাম, বাস থামান!
কেন?
আমি নেমে যাবো!
বলেন কি, এখানে কেন, আরও দুই ঘণ্টা পরে তো!
আরে নাহ, আমি এখানেই নামবো, ওই তিস্তায় গোসল করতে যাবো!
বাসের সবাই যেন আকাশ থেকে পড়লো! বাস থেকে নেমে যেতে পারে কেউ, নদীতে গোসল করার জন্য! এমনটা তো কেউ চিন্তাই করেনি!
আরে থামান বাস, আমি নেমে যাবো।
হেল্পার, বাস থামাতে বলল, আর ড্রাইভার বাস থামাতেই একটা খুশির ঝংকার বয়ে গেল মনে-প্রানে, বাস থেকে নেমেই, আহ!
আর এরপর...?
এরপর যেটা হল, সেটা জীবনের এক অনন্য অর্জন আর চরম পূর্ণতার একটা দুপুর আর একটা বিকেল। সেই পাহাড়ের পাথর বেছানো পথ ধরে নেমে গেলাম তিস্তার কাছাকাছি, যেতে যেতেই কানে ভেসে আসছিল ঝর্ণা আর তিস্তার মিলনের এক অন্য সুখের গুঞ্জন! খুশিতে টগবগ করে উঠলাম একা একাই, মনে মনে।
সরাসরি নদীতে নেমে না পড়ে, চলে গেলাম জঙ্গলের ভিতর দিয়ে নদীর পাড়ে। যেখানে আছে পাশাপাশি দুটি গাছ। হলুদ হ্যামক ঝুলানো হল সেই দুই গাছের মাঝে, শুয়ে শুয়ে নদী-ঝর্ণা আর পাহাড়ের আলিঙ্গন দেখার জন্য! আর অবশ্যই গাছের ছায়া আর নীল আকাশের সাথে কিছু মিতালীর জন্য। সাথে পাহাড়ি পাখির গান, নদীর পানির সাথে পাথরের কলরব, নাম না জানা ফুলে ফুলে সাজানো এক রূপকথার রাজ্য যেন! যে রাজ্যের আমি-ই রাজা, যে রাজ্য আমারই হাতে গড়া!
সারা দুপুর আর বিকেল জুড়ে ছিল শুধু ঝর্ণার গান, নদীর কলরব, নাম না জানা ফুলের ঘ্রাণ, তিস্তায় অবগাহন, হ্যামকের দোলা, আকাশের হাসি, ঝিরঝিরে বাতাস, ক্যাটবেরি-কেক আর কোকের আহার, আর সাথে ছিল সবচেয়ে প্রিয়, পাহাড়ের আলিঙ্গন......
যার সব কিছু পেয়েছি মাত্র, ৩০ সেকেন্ড আর ৫০ টাকার জন্যে...!!
তাই এই গল্পের নাম......
৩০ সেকেন্ড আর ৫০ টাকার গল্প......
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা আগস্ট, ২০১৬ দুপুর ২:৩৭