somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অল্প সুখের গল্প...

০৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ সকাল ৯:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


মিনির আজ অনেক আনন্দের দিন। কারণ ওদের রাজহাঁসটা পরপর দুই দিন দুইটি ডিম দিয়েছে। গতকাল থেকেই মিনি অনেক আনন্দে আছে রাজহাঁস ডিম দিয়েছিল বলে। অনেক দিন থেকেই মিনি ডিম খায়না। ওদের একটি ছোট্ট দোকান আছে বেড়ি বাঁধের উপরে। যেখানে অল্প-স্বল্প চাল, ডাল, তেল, লবণ, চা, বিস্কিট, চকলেট আর চিপসের পাশাপাশি কিছু তরকারী আর ডিমও থাকে।

কিন্তু সেই ডিম ওদের ঘরে খাবার জন্য নয়। ওগুলো বিক্রি করে ডিম প্রতি ৫০ পয়সা লাভের জন্য রাখা হয়েছে। তাও সরবোচ্চ ৩৬ টি ডিম রাখে। এতো বেশী ডিম এই অজো পাড়াগাঁয়ে কেউ কেনেনা। দিনে দুটি বা চারটি ডিম বিক্রি হলেই মিনির বাবা খুশি। আর যদি কখনো চারটির বেশী ডিম বিক্রি হয় তো আর দুটি পয়সা বেশী লাভের খুশি মনে ধরেনা।

মিনি বারে বারে মায়ের কাছে বায়না করে একটা ডিম খাবে বলে। মায়ের এক কথা যেদিন রাজহাঁস ডিম দেবে সেদিন ওকে ডিম খেতে দেবে। এই রাজহাঁস মিনির নানা বাড়ি থেকে এনেছে। সেদিন থেকে মিনি অপেক্ষায় আছে কবে রাজহাঁস ডিম দেবে আর কবে সে সেই ডিম খেতে পারবে। একদম যে ডিম খেতে পায়না তা নয়, বাসায় কখনো কখনো একটি ডিম ভাঁজা বা পিঁয়াজ দিয়ে রান্না হয়, তবে সেই একটি ডিম-ই তিন জনের জন্য।



মিনি আজো একা একটা ডিম খেতে পারেনি। খুব ইচ্ছা হয় একা একটা ডিম খাবে একদিন। কিন্তু সেই একদিন আসছেনা কিছুতেই। তাই যেদিন ওদের বেড়িবাঁধের ছাপরা ঘরে নানা বাড়ি থেকে এই রাজহাঁসটা পেয়েছে সেদিন মিনির মা মিনিকে কথা দিয়েছে, যেদিন এই রাজহাঁস ডিম দেবে সেদিন মিনিকে একটা আস্ত ডিম খেতে দেবে।

মিনিদের ছোট পরিবার, খুব ছোট। ছোট যমুনার তীরে বেড়ি বাঁধের পারে ওদের ছাপড়া ঘর। এক পাশে ভরা মৌসুমে বয়ে চলা স্রোতস্বিনী নদী, সেখানে মিনির বাবার একটা নৌকা বাঁধা আছে ঘাটে। বাড়িতে একটি ছাগল আছে, আছে কয়েকটি মুরগী, আর আছে এক খণ্ড ধানক্ষেত। যেখানে ওদের বছরের ধান আর ধান থেকে চাল পাওয়া যায়। ঘরের পাশের এক চিলতে উঠোনে কিছু শাক-সব্জি, কাঁচা মরিচ, আর এক আধটা ফলমূলও হয়। ছোট্ট দোকানটা ওদের নিয়মিত আয়ের একমাত্র সংস্থান। তাই আজও একটি আস্ত ডিম খাবার পূর্ণতা পায়নি মিনি। একদিন একটা পুরো ডিম খাওয়াই মিনির সবচেয়ে বড় স্বপ্ন।

তাই রাজহাঁস ডিম দেয়াতে মিনির খুশি যেন আর ধরেনা। কিন্তু সেখানে বাঁধ সাধলো মিনির মা। আর একদিন ধৈর্য ধরতে বলল মিনিকে। একটা ডিম তো দিয়েছে, আর একবার ডিম দেয়া শুরু করলে প্রতিদিন ডিম দেবে, তাই আজকে না তুই কালকে ডিম খাস পুরো একটা! কারণ আর একটা ডিম দিলে, তুই একটা খাবি, আর বাকি একটা ডিম দিয়ে আবার বাচ্চা হবে, পরে হাঁস বাড়বে আর কিছুদিন পরে ডিমও বাড়বে, তখন মিনি বেশী বেশী ডিম খেতে পারবে। সেই আশ্বাস দিয়ে সেদিনের মত মিনির মা মিনিকে শান্ত রাখে। আর মিনি পরের দিনের স্বপ্ন দেখে। কাল যদি রাজহাঁস আর একটা ডিম দেয় তো পরদিন সে পুরো একটা ডিম খেতে পারবে। খুশিতে মিনির চোখে ঘুম আসেনা।



পরদিন সকালে মিনি ঘুম থেকে উঠেই রাজহাঁসের ঘরের আশেপাশে ঘুরঘুর করতে লাগলো। রাজহাঁসটিকে পর্যবেক্ষণে রাখছে সব সময়ে। ঠিক দুপুরের পরে রাজহাঁসটি আর একটি ডিম দিল। সেটি হাতে নিয়ে মিনির উপচে পরা আনন্দ আর বাধভাঙ্গা উচ্ছ্বাসে যেন বাঁধনহারা। খুশি যতটা রাজহাঁসের ডিম পাড়াতে তার চেয়ে বেশী আজই প্রথম মিনি একটি পুরো ডিম খেতে পারবে সেই আনন্দে।

এদিকে মিনির মাও দারুণ খুশি, তার এতো আদরের রাজহাঁস ডিম দেয়া শুরু করেচে। তার মানে নিয়মিত ডিম দিলে বেশী করে বাচ্চা হবে, মিনির মায়ের রাজহাঁসের খামার হবে, সেই খামারের হাঁস আর ডিম বিক্রি করে মিনির মা ওদের ছাপড়া ঘরে বাঁশের বেড়া দেবে, বারান্দায় একটু মাটি ফেলবে। ওদের আর একটু ভালো থাকা হবে, শীতের বাতাস ঘরে ঢুকতে পারবেনা। মিনির আর মিনির বাবার কষ্ট হবেনা, আর তাই মিনির মায়ের একটু আরাম হবে।

মিনির বাবাও খুশি, যদি ঘরের ফাঁকা যায়গা গুলো বাঁশের বেড়া দিয়ে ঢাকা যায় তবে এই শীতের মাঝে কয়েকদিন পরপর তাকে আর অসুস্থ হয়ে বিছানায় পরে থাকতে হবেনা। রোজ সকালে সে নদীতে মাছ ধরে আনতে পারবে, দুপুর পর্যন্ত ক্ষেতে কাজ করতে পারবে আর দুপুরের পরে রাত পর্যন্ত দোকান খুলে রেখে আয় বাড়াতে পারবে।



সেদিন দুপুরে মিনি। মিনির মা আর বাবা সবাই মিলে নিজেদের জন্য দুটি ডিমের রান্না করেছিল। একটি ডিম মিনির একার জন্য আর একটি ডিম মা-বাবার জন্য। শীতের দুপুরে ডিমের তরকারী, শাক আর জলপাইয়ের চাঁটনি দিয়ে পেট পুরে ভাত খেয়ে খুমিয়ে ছিল শেষ বিকেল পর্যন্ত। আর বিকেলে উঠে মিনি পাড়া বেড়াতে বের হল ওর চোখে-মুখে আর সমস্ত অভিব্যাক্তিতে এই প্রথম একটি ডিম খেতে পারার তৃপ্তি আর স্বপ্ন পূরণের আনন্দ।

কি দারুণ সুখী ওরা, বাড়ি নেই, টাকা নেই, ব্যাংকের লেনদেন নেই, ফ্ল্যাট-গাড়ি-বাড়ি আর চিকেন-পিৎজার ঝলমলে সেলফি নেই। লোক দেখানো বড়াই নেই, আত্ন অহংকার নেই, আরও কতকিছুই নেই ওদের তবুও ওদের যা আছে তা আমাদের নেই।

ওদের সত্যিকারের সুখ আছে, একটা ডিম খাবার তৃপ্তি আছে, রাজহাঁসের মত রাজকীয় সম্পদ আছে, ঝুপড়ি ঘর নিশ্চিন্তে ঘুমনোর সাধ্য আছে, ছোট্ট একটি দোকান আছে, একখণ্ড জমি আছে। সবচেয়ে বড় যেটা ওদের অনেক কিছু না থেকেও যা আছে আর আমাদের অনেক অনেক অনেক কিছু থেকেও যা নেই, তাহল...

ওদের অল্প সুখের গল্প আছে, আমাদের নেই।

কিছুই চাইনা তাই, শুধু মিনিদের মত একটা.....

অল্প সুখের গল্প চাই...

সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ সকাল ৯:০৭
১৪টি মন্তব্য ১৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×