somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সাহিত্যপাঠঃ ফ্রাঞ্জ কাফকার 'মেটামরফোসিস'

২৪ শে মে, ২০১৭ রাত ১১:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গ্রেগর সামসার জীবনে আকস্মিক এমন কী ঘটে গেল- সবাই তাকে দেখে ভয়ে আঁতকে উঠছে, ধুর ধুর করে তাড়িয়ে দিচ্ছে, আঘাত করার জন্য তেড়ে আসছে !


ভ্রাম্যমান ব্যবসায়ী গ্রেগর সামসা । দিনশেষে পকেটে যা জমা হয়, বাবা-মা আর ছোট এক বোনকে নিয়ে তার দিন নিশ্চিন্তে চলে যায় । সংসারে গ্রেগরের একার উপার্জন । তবুও পরিবারের সবার জীবন-যাপনে ছিল স্বচ্ছলতার ছাপ ! এমনকি তার বাবা গত পাঁচ বছর ধরে পায়ের উপর পা তুলে নিশ্চিন্তে আরামে পার করে দিচ্ছিল গ্রেগরের উপার্জনের উপর ভর করে । সঙ্গীতপ্রেমী ছোটবোন গ্রেটাকে নিয়ে গ্রেগরের ছিল অনেক বড় স্বপ্ন—

"তার একটা গভীর পরিকল্পনা ছিল যে তার বোন, সে সঙ্গীত ভালোবাসে, গ্রেগরের মত নয় ও, যে চমৎকার বেহালা বাজাতে পারে, তাকে সে সামনের বছর, প্রচুর খরচের ব্যাপার হলেও কনসার্ভেটেরিয়ামে পাঠাবে, অর্থের ব্যাপারটা সে অন্য কোনোভাবে সমাধা করে নেবে ।"

কিন্তু সেই ছোট বোন গ্রেটাই এখন গ্রেগরকে দেখলে নাক সিঁটকায়, তাকে ঘর থেকে বের করে দেয়ার জন্য বাবা-মাকে পরামর্শ দেয় । বাবা তাকে দেখলে তেড়ে আসে মারবার জন্য । আর মা তো অজ্ঞান হয়ে গেল গ্রেগরের বীভৎস রূপ দেখে !
কিন্তু কী হল গ্রেগরের ?

১৮৮৩ সালে জন্ম নেওয়া বিখ্যাত চেক সাহিত্যিক ফ্রাঞ্জ কাফকা তাঁর 'মেটামরফোসিস' গল্পে পাঠককে এক অতিবাস্তবতার ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়ে এমন যুবককে হাজির করলেন, যে সকালে দুঃস্বপ্নের ভিতর থেকে জেগে উঠতেই টের পায় সে আর মানুষ নাই- পতঙ্গে রূপান্তরিত হয়ে গেছে ! হ্যাঁ, কাফকার সৃষ্ট সেই হতভাগা যুবকের নামই গ্রেগর, গ্রেগর সামসা । গল্পের প্রথম লাইনেই এক অদ্ভুত বিস্ময়ের সঙ্গে কাফকা আমাদের জানান দিয়ে দেন- গ্রেগর তেলাপোকায় পরিণত হয়েছে !
পরিবারের প্রতিটা সদস্য যার মুখের দিকে তাকিয়ে বেঁচে আছে, যার হাড়ভাঙা ক্লান্তিকর পরিশ্রমে উপার্জিত অর্থে চলে অসুস্থ মায়ের ঔষধের খরচ, বৃদ্ধ পিতার সকালের নাস্তার টেবিলে চায়ের কাপের সঙ্গে একটা খবরের কাগজ, সতের বছর বয়সী কিশোরী বোনের পড়াশোনা আর সঙ্গীতচর্চার ব্যয়, সেই গ্রেগর সামসার এরকম ভয়াবহ রূপান্তর আমাদের ভিতর শুধু বিস্ময়ই জাগায় না, মানব-অস্তিত্বের এক ভয়াবহ সংকটকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় ।

পুঁজিবাদ তখন ইউরোপীয় সভ্যতার বুকে জগদ্দল পাথরের মত গেড়ে বসেছে । যান্ত্রিক শহরের রাস্তায় অলিতে গলিতে এক অদ্ভুত কঠোর প্রতিযোগিতায় দিশেহারার মত মানুষের ছুটাছুটি । জীবনের অর্থ, বেঁচে থাকার অর্থ ক্রমশ পাল্টে যাচ্ছে, তাসের ঘরের মত হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ছে সমস্ত মানবিক মূল্যবোধ, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দিকে ধাবিত হচ্ছে পৃথিবী- তখনই প্রাগ শহরের কোনো এক টেবিলের কোণায় বসে কাফকা লিখে ফেললেন 'মেটামরফোসিস', এক অদ্ভুত কাল্পনিক শক্তির মাধ্যমে এঁকে ফেললেন গ্রেগর সামসা নামক এক মেরুদণ্ডী মানুষের মেরুদণ্ডহীন তেলাপোকায় রূপান্তরিত হওয়ার অ্যাবসার্ড আখ্যান ।
কাফকার এই অনবদ্য রচনাটির আঙ্গিকগত মতপার্থক্য আছে । অনেকের মতে এটা ছোটগল্প, অনেকের মতে নভেলা বা উপন্যাসিকা । তা যাই হোক । এর আঙ্গিকগত মতপার্থক্যে না গিয়ে শুধু একজন পাঠক হিসাবে এই গল্পটি পাঠ করার মাধ্যমে আপনি যে এক অভিনব অদ্ভুত অথচ রোমাঞ্চকর চিন্তাজগতে প্রবেশ করবেন- এটা দ্বিধাহীন কণ্ঠে উচ্চারণ করতে পারি ।

গ্রেগর সামসার তেলাপোকায় রূপান্তর আপতদৃষ্টিতে অবাস্তবিক উদ্ভট মনে হয় ! কিন্তু শেষ পর্যন্ত 'মেটামরপোসিস' আমাদের সামনে এমন একটা বাস্তবতার প্রতিচ্ছবিই তুলে ধরে, যে বাস্তবতা আমাদেরকে প্রতিনিয়ত তাড়া করে বেড়ায়, যে বাস্তবতা আমাদের বুঝিয়ে দেয় পরিবারের প্রতি দায়বদ্ধতার মানে কি, মায়ের ভালোবাসার নিগূঢ়ে আরো কিছু আছে কিনা , পরজীবী পিতা কীভাবে উপার্জনক্ষম ছেলের আকস্মিক বিপর্যয়ে পাল্টা আঘাত হানতে ঘুরে দাঁড়ায় , স্নেহের ছোটবোন কীভাবে উপেক্ষার দৃষ্টিতে তাকে সরিয়ে দেবার ফন্দি আঁটে ।
নিজের এই করুণ নির্মম বিপর্যয়ের পরও গ্রেগর সামসা মোটেই নিরাশ হয় না । সে আশাবাদী , সে আবার পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসবে । আবার সে সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই ট্রেন ধরবে, পরিবারকে অনাটনের হাত থেকে রক্ষার জন্য নেমে পড়বে কর্মে, দু'হাতে রোজগার করবে, ছোটবোনের সঙ্গীতশিল্পী হওয়ার সেই বড় স্বপ্নটা পূরণ করবে ।

"গভীর প্রত্যাশা নিয়ে সে ভাবল যে আজকের সকালে এই দুঃস্বপ্ন-বিভ্রান্তিও আস্তে আস্তে কেটে যাবে । তাঁর কণ্ঠস্বরের পরিবর্তন আর কিছু নয়, একটা কঠিন ঠাণ্ডার পূর্বাভাস মাত্র, তার মত ভ্রাম্যমাণ বাণিজ্যিক কর্মচারীদের নিত্যদিনের অসুখ ।
... সে আশা করছে, সবকিছু আবার বাস্তব ও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাবে ।
"

কিন্তু একী হায় ! যে পরিবারকে ঘিরে গ্রেগরে এত দুঃশ্চিন্তা দুর্ভাবনা, সেই পরিবারের কেউ-ই চাচ্ছে না আর গ্রেগরকে । তারা সবাই গ্রেগরের ভরসা ছেড়ে দিয়ে কর্মে নেমে পড়েছে । অলস আরামপ্রিয় বাবা এখন কাজ শেষে আপেল কিনে সেই আপেল গ্রেগরের পিঠের দিকে ছুঁড়ে মারছে !

" নিজের নতুন জীবনের একেবারই শুরু থেকেই সে লক্ষ করছিল যে তার সঙ্গে ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাবা কঠোরতম প্রক্রিয়াকে সবচাইতে উপযোগী বলে বিশ্বাস করতে আরম্ভ করেছিলেন ।... একটা চাক্ষুষ স্বারকের মত আপেলটা তার পিঠে বিঁধে রয়েছে , কেউ সেটা সরাতে সাহস করল না…"


গ্রেগর ভালোমতই বুঝতে পারছে তার বর্তমান বীভৎস অস্তিত্ব সবার কাছেই বিরক্তিকর ও যন্ত্রণাদায়ক । বাবা-মা-ছোট বোন সবাই-ই এখন গ্রেগরের কাছ থেকে মুক্তি চাচ্ছে । তবুও গ্রেগর কীসের নেশায় কীসের আশায় একটা বীভৎস কুৎসিত ঘৃণ্য তেলাপোকা হয়ে বেঁচে আছে ?
এখানেই কাফকা হয়তো চিহ্নিত করতে চেয়েছিলেন পুঁজিবাদী সমাজের অভ্যন্তরে মানুষের মূল্যহীনতা ।

রূপান্তরের পর তেলাপোকার চোখ দিয়ে গ্রেগর সামসা মানুষের যে রূপ অবলোকন করেন, তার নিষ্ঠুরতা বুঝতে আমাদের বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয় না । এরই মধ্যে ঘটে গেছে দু' দুটি বিশ্বযুদ্ধ ! বিপন্ন হয়ে পড়েছে মানুষের জীবন । মূল্যহীন হয়ে গেছে বেঁচে থাকার সমস্ত মানে ! ঘরে ঘরে জন্ম নিচ্ছে বহু গ্রেগর সামসা । যাদের অস্তিত্ব মানুষের মত অর্থময় দামী নয়, তেলাপোকার মত অর্থহীন সস্তা !

বইঃ Metamorphosis – রূপান্তর
মূলঃ ফ্রাঞ্জ কাফকা
অনুবাদঃ কবির চৌধুরী
প্রকাশনাঃ বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র

_____________________০_______________________০________________০____________________

ব্যাক্তিগত যোগাযোগ লিংকঃ সালমান মাহফুজ
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা আগস্ট, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:১৬
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×