যখনই কোন ভগ্নী মস্তক উত্তোলনের চেষ্টা করিয়াছেন, অমনি ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচনরূপ অস্ত্রাঘাতে তাঁহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে। আমরা প্রথমতঃ যাহা মানি নাই, তাহা পরে ধর্মের আদেশ ভাবিয়া শিরোধার্য করিয়াছি। আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগন ঐ ধর্মগ্রন্থগুলিকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রচার করিয়াছেন। এই ধর্মগ্রন্থগুলি পুরুষরচিত বিধি-ব্যবস্থা ভিন্ন আর কিছুই নহে।
লাইন কটি মহিয়সী নারী বেগম রোকেয়ার। বাঙালী মুসলমানের মধ্যে এরূপ একটি বিদ্রোহী (?) উচ্চারণ তাঁর আগে আর কেউ করেছে কীনা সন্দেহ। যে মোল্লাতান্ত্রিক সমাজে রোকেয়া তাঁর জীবন পার করেছেন তাতে এমন ইসলামবিরোধী উচ্চারণ তাকে সময়ের চেয়ে অনেক বেশি সাহসী এবং যুক্তিবাদী বলেই তুলে ধরে। ব্লগের বেশিরভাগ আস্তিক বন্ধুদের কাছে রোকেয়ার এই পরিচয়টা জানা নেই। জানা নেই দেশের সামগ্রিক মানুষের। অনেক আস্তিক বন্ধুরা হয়তো বিশ্বাসই করবে না যে বেগম রোকেয়া এরকম একটি কথা বলতে পারেন।
আমাদের (নারীদের) জন্য এ দেশে শিক্ষার বন্দোবস্ত সচরাচর এইরূপ-প্রথমে আরবীয় বর্ণমালা, অতঃপর কোরাণ শরীফ পাঠ। কিন্তু শব্দগুলির অর্থ বুঝাইয়া দেওয়া হয় না, কেবল স্মরণশক্তির সাহায্যে টীয়াপাখীর মত আবৃত্তি কর।কোন পিতার হিতৈষণার মাত্রা বৃদ্ধি হইলে, তিনি দুহিতাকে “হাফেজা” করিতে চেষ্টা করেন। সমুদয় কোরাণখানি যাঁহার কণ্ঠস্থ থাকে, তিনিই “হাফেজ”।
এও কী কম কথা! বর্তমান সময়ের বেশিরভাগ মুসলমানেরই যেখানে ধারণা কোরাণে হাফেজ হতে পারলেই অনেক সওয়াব সেখানে সেই বিশ শতকের প্রথম দশকে কোরাণ শরীফ পাঠকে টীয়া পাখির মত আবৃত্তি করার সাথে তুলনা দেয়াটাও অনেক সাহসের পরিচয়। কিংবা মোহাম্মদকে ধর্মগুরু শব্দ দিয়ে প্রকাশ করা! আজ একুশ শতকেও কেউ এরকম ধৃষ্টতা দেখাতে চাইবে না।
একজন নারী হয়ে বেগম রোকেয়া কীভাবে এতখানি সাহসী হলেন তা ভাবতে গেলে আমরা পাই তাঁর অপূর্ণ দাম্পত্যজীবন। প্রথমত অসমবয়সী স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রী হওয়া, দ্বিতীয়ত বিয়ের খুব অল্পদিন পরেই স্বামীর মৃত্যু। ভাইয়ের কাছে রোকেয়া যে শিক্ষাটুকু পেয়েছিলেন তাতে ছিল পাশ্চাত্য শিক্ষার ছোঁয়া। জীবনে পেয়েছেন ঠিক তার উল্টো। এই উল্টো জীবনই তাকে প্রচলিত সমাজকে আঘাত করতে শিখিয়েছে। একের পর এক সাহিত্যকর্ম দিয়ে তিনি ভাঙতে চেয়েছেন নারীর তথা সমাজের শৃঙ্খল।
কিন্তু কতটুকু সফল হয়েছেন সেটা একটা প্রশ্ন বটে। যার নিকট হতে আমরা পাই অবরোধবাসিনী, মতিচুর, সুলতানার স্বপ্ন। তাঁর কাছেই পাই বোরকার মত অপসাহিত্য। কিংবা আরো কিছু বক্তৃতা যা কেবল নারীবাদিদের হতাশই করেনি, মোল্লাতন্ত্রকে দিয়েছে অপযুক্তির হাতিয়ার। তবে এ কি রোকেয়ার আপোস নাকি আত্মসমর্পণ? কেউ কেউ দ্বিতীয়টা মনে করলেও বেশিরভাগ নারীবাদিরা মনে করেন আপোস। ঠিক আমরা যুক্তিবাদীরা যেমন ব্লগে নাস্তিকতাবাদ নিয়ে লিখতে গেলে চেষ্টা করি ব্লগের মোল্লাতন্ত্রের বাহক ও ধারক আস্তিকদের ধর্মানুভূতিকে বাঁচিয়ে লিখতে। কারণ এই মোল্লাতন্ত্রের ধারকদের রয়েছে ধর্ম নামক এক অব্যর্থ অস্ত্র, যার মারপ্যাঁচে পড়ে আমার সারাদিন সারারাত বসে লেখা পোস্টটাই কতৃপক্ষ গায়েব করে দেয়। একবার ভেবেও দেখেনা যে এই লেখাটি লিখতে লেখকের কতখানি সময়, মেধা ও মননকে ব্যয় করতে হয়েছে।
বেগম রোকেয়ার শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্মগুলিকে আমাদের মুসলমান বাঙালীরা সবসময়েই ভয় করে চলেছে। আমরা এর প্রকৃত প্রমাণ পাই আমাদের টেক্সটবোর্ডের বইগুলোতে রোকেয়ার যেসব গল্প, কবিতা অন্তর্ভূক্ত করা হয় তার মধ্যে। তাতে রোকেয়ার প্রকৃত পরিচয়কে গোপন করার একটা প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। আর তাই সারাদেশের মানুষের কাছেই রোকেয়ার পরিচয় থেকে যায় কেবল নারী জাগরণের অগ্রপথিক হিসেবে। তার যুক্তিবাদী মনটার সাথে পরিচয় হয়না কারো। পরিচয় হয় না তার বিদ্রোহী সাহিত্যকর্মের সাথে।
নজরুলের মত বেগম রোকেয়াও আমাদের দেশের আস্তিক মুসলমানদের কাছে অত্যন্ত প্রিয়। এরা জানেনা নজরুলের বিদ্রোহী পরিচয়টার চেয়ে তাঁর যুক্তিবাদী এবং মানবতাবাদী পরিচয়টা অনেক বড় হওয়া উচিত ছিল। বেগম রোকেয়ার নারীবাদী চরিত্রের সাথে জড়িয়ে আছে একটি বিদ্রোহী এবং যুক্তিবাদী মন।
খুব দুঃখ লাগে বইপত্রে বেগম রোকেয়ার নামটা দেখলে। এই বিদ্রোহী নারীবাদীর নামটা লিখতে গিয়ে আমরা লিখি বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। নামের সাথে একটি মোল্লাতান্ত্রিক বোঝা বয়ে বেড়ানো থেকে এই যুক্তিবাদী নারীকে মুক্তি দেয়া হোক এই প্রত্যাশা।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে ডিসেম্বর, ২০১০ রাত ১০:৩৪