প্রায় তিন মাস যাবৎ ইন্টারনেট এর আওতার বাইরে ছিলাম। মাঝে কিছুদিন অবশ্য কিছুটা স্বেচ্ছায় ও কিছুটা সময়-সুযোগের অভাবে এই ল্যাপটপ-যন্ত্রটাকে পাশ কাটিয়ে গেছি।
কিন্তু আমি কল্পনাও করিনি সারাবিশ্বে ছড়িয়ে থাকা আমার বর্ধিত পরিবার ও বন্ধুমহলে আমার এই "অনলাইনে-না-আসার" নৈঃশব্দের কেমন মানে হতে পারে। আমার ভাই আমার হয়ে কৈফিয়ত দিতে দিতে ক্লান্ত; "হ্যা, ও ভাল আছে।" "না না পারিবারিক কোনও সমস্যা হয়নি।" "না ও কোনও চাকরি করেনা, এখনও বেকার।" ইত্যাদি।
মোবাইলে ফোনের পর ফোন। "শাফ্ক্বাত তুমি ভাল আছ?" "শাফু তোকে ফেইসবুকে নক করসিলাম..." "তোমার কোনও প্রব্লেম হচ্ছে? আমাকে খোলাখুলি বলতে পার..." ব্যাপারটা সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছে দেখে ফেইসবুকে লগিন করলাম একদিন। মেসেজ ইনবক্সে ২৬ টা আর নোটিফিকেশেন ১০৩। আবার লগাউট করে ফেল্লাম, এত পড়ার সময় ও ধৈর্য সে-সময়ে ছিলনা।
অবাক লাগছে এটা ভেবে, কী করে আমি কখন এমন ইন্টারনেট-নির্ভর যোগাযোগে জড়িয়ে পড়লাম?
চাকরি ছাড়ার পর মোবাইল নাম্বার বদলে ফেলেছিলাম। কেমন একটা আলস্য থেকে নতুন নাম্বারটা জনগণকে দেইনি। টেলিকমে কাজ করতাম বলে প্রচুর কথা বলতাম বিলের তোয়াক্কা না করে। তাছাড়া চাকরির ধরণটাই এমন ছিল যে বাসায় এসে মেয়েকে কোলে নিয়েও কান থেকে মোবাইল ফোনটা সরাতে পারতামনা। তাই অনেকটা বিরক্তি থেকেই ফোন থেকে অবসর নিয়েছিলাম কয়েক মাস।
সেবারও একই কান্ড। "সব ঠিকাছে তো?" এ-ওকে জিজ্ঞেস করে, কার সাথে আমার যোগাযোগ আছে...গেট-টুগেদারে দাওয়াত পাইনা, কেউ আমার নাম্বার জানেনা, অনেক ইমেইল, অনেক ফেইসবুকের-ওয়ালপোস্ট...আমি চুপ। মনে হতো ৬ বছরের কামলা-খাটার পর আমি মিনিমাম একবছর খালি বাসায় থাকবো। অখন্ড অবসর নিয়ে। খালি মা-মেয়ে আর ঘরবাড়ি। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং, অনলাইন যোগাযোগ, মোবাইলের বিল গোনা (বেকার হওয়ার পর বুঝতে পেরেছি ফোনবিল কী জিনিস), কিচ্ছু না। নিজের ভেতরকার "আমি" টাকে ফিরে পেতে চাইছিলাম শুধু নিজের মাঝে থেকে, আমার মেয়েদের সাথে সময় কাটিয়ে।
খুব ভাল উদ্যোগ। আসলে এই মোবাইল-ইন্টারনেট যতই উপকারী হোক না কেন...ভীষণ দায়বদ্ধ করে ফেলে। যোগাযোগ টিকিয়ে রাখার দায়বদ্ধতা। সামাজিক প্রাণী হিসেবে আমরা মানুষরাই এই মাধ্যমগুলোর উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ি নিজের চারপাশে অন্যমানুষের আনাগোনা তৈরী করার জন্য। তবে যখন "নিজেকে" নিয়ে থাকার তাগিদটা প্রবল হয়ে যায়; এই যন্ত্রগুলো তখন বাহুল্য মনে হয়।
আমি চট্টগ্রাম ছেড়ে যখন ঢাকায় এলাম, রোকেয়া হলের ঠিকানায় চিঠি লিখে পাঠাতো আমার মা। সেই আম্মু এখন প্রতিদিন তিন-চারবার ফোন করে, এসএমএস করে। কত সহজ হয়ে গেছে যোগাযোগ!! কিন্তু সেই চিঠিগুলো, বারবার এপিঠ-ওপিঠ করে পড়তাম। আমার রুম-মেটরাও পড়তো। একজন মা-য়ের চিঠিতে সবার ব্যাপারে খোঁজখবর থাকতো। "শেলীকে বোলো মন দিয়ে পড়তে"... "দীপুকে জানিয়ো ওর রেজাল্টে আমি খুব খুশী হয়েছি"..."তোমাদের সবার জন্য রইলো অনেক দোয়া। ইতি-আম্মু।"
আমার প্রেম হলো, ক্লাসমেটের সাথে। ক্লাসে দুইপ্রান্তে বসে দুইজন খালি দুজনকে চিঠি লিখতাম। দিনশেষে ও বাসায় চলে যেত, আমি ফিরতাম হলে। পরদিন সকালে খুব সংকোচ নিয়ে ওর পকেটে একটা চিঠি ঢুকিয়ে দিতাম। সেই কার্ডফোনের লাইনে দাঁড়িয়ে প্রতি-রাতে ফোন করার সময় মনে হতো "কবে আমার একটা মোবাইল ফোন হবে?" হলোও মোবাইল ফোন একদিন। বন্ধ হলো চিঠি লেখা। ইতি হলো কার্ডফোনের লাইনে দাঁড়ানোর। কিন্তু এই সহজ যোগাযোগ, জীবন থেকে কী যেন একটা ছিনিয়ে নিয়ে গেল।
অনলাইনে এখন ব্লগ লিখা যায়, ডাইরির ভাত মরেছে। আমার সাহেব অফিসে খবরের কাগজ পড়েন আর আমি অনলাইনে। ঘরে আর খবরের কাগজের স্তুপ হয়না। সেদিন অনেক পুরনো এক উপন্যাস ইন্টারনেটে গিয়ে পড়লাম। গান শুনি ল্যাপটপে, ডাউনলোড করে।
কী যেন নেই, কী যেন হারিয়ে গেছে। মনে হয় যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলছি প্রতিনিয়ত। ভয় পাই, যন্ত্রনির্ভর জীবনযাত্রায় আমি যন্ত্রের মতো কাঠখোট্টা হয়ে যাচ্ছি...
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই অক্টোবর, ২০০৯ রাত ৩:২০