জয় বেহিসেবী মানুষ;হিসেব করে কখনোই চলা হয়নি।হেঁটে চলার পথ সে রিকশায় গিয়েছে,রিকশার পথটা সিএনজিতে...তাই সবাই যেটা পুঞ্জীভূত করার চিন্তায় থাকে;সেটা জয়ের করা হয়ে উঠেনি কখনোই।ভোগেছে অনেক সেটার জন্যই।অনেক কিছু হারিয়েছে,যা হারাবার নয়,তা'ও!।একটা সময় ছিল,গ্রাম থেকে শহরে উঠে আসতে তাকে সংগ্রাম করতে হয়েছে।পড়ালেখা চালিয়ে যেতে তাকে কাধে কোদাল তুলে নিতে হয়েছে,তাতেও যখন হতো না তখন চাতকের মতই ওপরের দিকে তাকিয়ে কতকাল কেঁদেছে সে খবর পাড়ার প্রতিটা বেওয়ারিশ কুকুর আর বাঁশ ঝাড়ের পাশের ঐ একলা ব্রীজটাই জানে।যখন সে এসএসসি দিচ্ছিল;ফর্ম পূরনের টাকাটা জোগাড় করতে পারছিল না,কোনভাবেই।হঠাৎ করেই একদিন একটা ছাগলের বাচুর তাদের উঠোনে এসে ধরা দিল,অনেক খোঁজা হলো তার মালিক কে,পাওয়া গেল না।বাচুরটার গায়ে অনেক আটালী পোঁকায় রক্ত চুষছিল।জয় বাচুরটাকে গোসল করিয়ে গায়ে বনাজী ঔষধ লাগিয়ে সুস্থ করে,সে ছাগলটা একটা সময় জয়ের স্বপ্ন পূরনের উপাদান হয়ে যায়: ওটা জয়কে হয়তো অদৃশ্য কোন শক্তিই দিয়েছে।এরপর ও তার দুর্দশা যায়নি।যখন সে এইচএসসি দিবে তখনও ফর্ম পূরনের টাকার কথা ভেবে অানমনে রাস্তায় হাঁটছিল আর ভাবছিল এবার আর বোধয় পড়ালেখাটা হবে না। এটা ভাবতে ভাবতেই রাস্তার কাছায় জমানো বালিতে উদাসীন ভাবে লাথির ভঙ্গিতে পা চালাচ্ছিল;হঠাৎই তার চোখ চকচকে কিছু একটা ধরা দেয়। সে হাতে নেয়,'কানের দুল'।সে তার পাশের দু'বন্ধুকে দেখায় সেটা।তারা হাসতে হাসতে বলে-নে,এইটা তোর বৌকে দিস!
জয় আজো তার সে বন্ধুদের দেয় ধন্যবাদ দেয়,যদি তারা দুলটা ফেলে দিত অথবা নিজেরা নিয়ে যেত,হয়তো তার পড়ালেখাটাই হতো না।সেই দুলটা বিক্রির টাকায় তার ইন্টারের ফর্ম পূরন যে হয়েছে।অদৃশ্য শক্তির প্রতি তার বিশ্বাসের ভিতটা আরো মজবুত হয় যখন সে ইন্টারে অসুস্থ থাকার পরও কলেজে ফার্স্ট হয়।পড়ালেখার নেশাটা তাকে পেয়ে বসে,সাথে পরিবারের বংশগত দারিদ্রতা।দুটোকেই সে লালন করে,ছিড়তে চায় পারে না।সেটা ছিড়তে সাহায্য করে তার বড় ভাইয়ের এক বন্ধু।তিনিই জয় একজোড়া কবুতর উপহার দিয়েছিল ই্ন্টারে ভাল রেজাল্ট করায়।জয় আর বেশি কিছু চাইতে পারে নি।তাই সে অদৃশ্য সে শক্তির কাছেই চায়: যেন সে ইংরেজিতে অনার্স করতে পারে। জয়ের আ্ত্ন বিশ্বাস এতটাই ছিল যে অদৃশ্য সে শক্তিটা জয়ের সবকথাই শুনছেন,এটাও শুনবেন।তাই বাবা-মা যখন দারিদ্রতার দোহায় দিয়ে শহরে যেতে বারণ করলো,জয় কিছু বলে নি। অনেক সখের কবুতর জোড়া বিক্রি করে ৬৫০ টাকা পকেটে নিয়ে ছুটে যায় শহরে,এ শহরে পরিচিত বলতে শুধুই তার কলেজের একজন,যে ভার্সিটি ভর্তির কোচিং করছে। জয় তার কাছেই যায়,তার হাতে ৬০০ টাকা দেয়,ফর্ম কেনার জন্য আর প্রস্তুতির জন্য একটা বই কেনার জন্য।সে কোচিং থেকে মোটা একটা বই জয়কে কিনে দেয়।বাদলা সেটা নিয়ে গ্রামে ফিরে আর তন্ন তন্ন করে প্রতিটা পাতা।একটা দীর্ঘ সময় পর রেজাল্ট দেয়। জয় আর তার সে কলেজ বন্ধু রেজাল্ট খুঁজতে থাকে...শেষ দিক থেকে খুঁজে তারা।খুঁজতে খুঁজতে তার বন্ধুটা পায় এগারশো সিরিয়ালের কোথাও!অর্থাৎ সাবজেক্ট পাওয়া হয়তো হবে না,আর পেলেও বাংলা কিংবা ইতিহাস ছাড়া কিছু জুটবে না।জয়ের মনটা প্রায় ভেঙ্গে যাবার অপেক্ষায় চোখ বুলাতে থাকে প্রথম লিস্টটায়।প্রথম লিস্টের নিচ দিক থেকে উঠে আসে একদম প্রথম সিরিয়ালে...জয়,কেঁদে দেয়।সে নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারে না।সে তার বন্ধুকে ডেকে তাই নিশ্চিত হয়,না ওটা তারই রোল ছিল!এরপরও প্রতিটা দিন তাকে শহরে ঠিকে থাকার জন্য সংগ্রাম করতে হয়েছে।কাঁচা বাজারে মসল্লা বিক্রি করতে হয়েছে,মাটি কাটতে হয়েছে। এতকিছুর পরও একটা জিনিস হয়েছে,ইংরেজিতে তার অনার্স আর মার্স্টাস ডিগ্রীটা হয়েছে।সাথে জুটেছে মনের কথা শুনার মতো কিছু মানুষ,তাদের কেউ কেউ আবার মনের গহীনেও ঢুকে গিয়েছে,যেটাকে সমাজ ভালোবাসা বলে।কিন্তু বাদলা চাতক,তৃষ্ণাত্ব চাতক।তাই ওর পাশে থাকেনি। যার আজীবন পাশে থাকার কথা ছিল সেও। নেশা তাকে এই পোড়া শহরে ডেকে এনেছিল,পড়ালেখাটা হয়তো হয়েছে,কিন্তু তার কাদা-মাটি মন পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে।তার এখন ভীষণ মিস করে তার শৈশব আর গ্রাম সাথে সেই ছয়দিনের ছোট বাচ্চা দেয়া কবুতর জোড়া,যেটা ভার্সিটির ভর্তি ফর্ম কেনার জন্য তাকে বিক্রি করতে হয়েছে।
কিন্তু জয় তার নিজেকে অবাক করে কিছু অদৃশ্য নোট জমা করেছিল একাউন্টে আর পুরাতন ডায়েরীতে।ভেবেছিল কাউকে কখনোই কিছু দেয়া হয়নি;কিছু একটা দেবে।সেটা আদৌ হয়ে ওঠেনি।তবে,সেই নোটগুলো জীবনে অন্যকিছু নিয়ে এসেছে: জয়ের আমিকে মেলে ধরার সুযোগ।"জলরঙ বসন্ত" কাব্যগ্রন্থটি জয়ের ভিতর অন্য একটি মানুষের জন্ম দিয়েছে।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে আগস্ট, ২০১৭ রাত ১২:১০