বালক দলের সবাই মহাখুশী। কারণ বড় রাস্তা (মিরপুর রোডকে এই নামেই ডাকতাম) পার হয়ে ধানমন্ডি ৮ নং মাঠ হয়ে লেকের পাড় মসজিদে যাওয়ার অনুমতি কোন অভিভাবকই দিবে না। কিন্তু খুশু ভাইয়ের সাথে থাকবে, এর চে বড় সার্টিফিকেট আর কি হতে পারে।
বেশ কিছুদিন লেকের মসজিদে শান্ত-শিষ্ট লেজ বিশিষ্ট সুবোধ বালকের মত খুশু ভাইয়ের নেতৃত্বে নামাজ পড়লাম। তখন মসজিদের উপরে ছিল টিন আর পাশে ছিল বাঁশের বেড়া। বেড়ার ফাঁক গলে রোদেরা খেলা করত। মসজিদের দক্ষিণ দিকটা আমার পছন্দের ছিল, সেখানে বসে বায়ে তাকালে ছোট মাঠটা পেরিয়ে লেকের পানি দেখা যেত, দু'একটা বড় গাছ ছিল। সেই বয়সে নানা কারণে আমার গ্রামের বাড়িতে যাওয়া হয়নি, এই এক খন্ড প্রকৃতি আমার ছোট্ট হৃদয়ে আমার অজান্তেই জায়গা করে নিয়েছিল। কিন্তু সেই অনাবিল আনন্দে একদিন ছেদ পড়ে - একদিন নামাজ চলাকালীন সময়ে দুষ্ট বালকের দল ধাক্কা-ধাক্কি, হাসা-হাসিতে মেতে ওঠে। সুতরাং লেকের পাড় মসজিদ থেকে নির্বাসিত হয়ে আবার কলোনীর মসজিদে যাতায়াত শুরু। বালক দলের দুষ্টুমি যেমন থামে না, থামে না মসজিদ বদল।
খুশু ভাই এই নিয়ে বালক দলকে বকা-ঝকা করলেও, কাউকে দল থেকে বাদ দিত না - বড় ভাইয়ের মত আগলে রাখত। ফুটবল, ক্রিকেট খেলার সময় আমরা যখন দুই দলে ভাগ হয়ে যেতাম, উনি সবসময় দুর্বল খেলোয়াড় নিতেন। কিন্তু তাও উনার দল অধিকাংশ সময় জিতত।
উনি জোরালো শট নিতে পারতেন, একাই ৩-৪ জন খেলোয়াড়কে কাটিয়ে গোল করতে পারতেন। আবার ক্রিকেটে উনার দ্রুত গতির বল চোখে দেখাই মুশকিল হতো এবং ব্যাটিংয়ে উনাকে আউট করা খুবই কঠিন ছিল।
খেলা-ধূলায় যেমন এক নম্বর তেমনি পড়া-শোনাতেও। উনি ছিলেন ধানমন্ডি সরকারি বালক বিদ্যালয়ের ফার্স্ট বয়। স্কুলে ও কলোনীর মসজিদে, কুরআন তেলোয়াতের ১ম পুরস্কারটা উনিই পেতেন।
এত গুণী একজন মানুষের সান্নিধ্য আমার জন্য অবশ্যি বিশেষ একটা পাওয়া। এই পাওয়ার খাতাটা আরো সমৃদ্ধ হয়েছিল যখন একদিন বিকেলে উনি আমাদের নিয়ে নতুন একটা বিষয়ের অবতারণা করলেন - দেশ ও রাজধানীর নাম। সবাইকে বললেন, "কোন দেশের রাজধানী কী?" - এটাই আমাদের বিকেলের আড্ডার বিষয়। খেলা-ধূলা বাদ দিয়ে এই আড্ডার একটা কারণ ছিল। তখন বর্ষাকালে বৃষ্টিতে আমাদের সামনের মাঠে হাঁটু পানি হয়ে যেত, সন্ধ্যার পর ঘরে বাবার পাশে বসে কত ব্যাঙের ডাক শুনেছি। তাই মাঠের এক কোণে, একটু উঁচুতে, যেখানে পানি জমত না - সবাই গোল হয়ে বসে গল্প করতাম। সেই সময়ে শেখা, বহু রাজধানীর নাম এখনো আমার মনে আছে। তো এমন একটা সুন্দর আড্ডার কথা কলোনীর অনেকের কানেই গেল। এখানো একটা কথা যোগ করি, এই বালক দলে অতি ভ্দ্র কিছু ছেলে কখনো আসত না, সম্ভবতঃ তারা তাদের ছেলেদের বখে যাওয়ার ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। এমনি এক বালক বিদ্যুৎ। উনার মা খুশু ভাইকে ডেকে পাঠালেন এবং বিদ্যুৎকে আমাদের সাথে বৈকালিক আড্ডায় দেখে শুনে রাখার অনুরোধ করলেন। বিদ্যুতের মা কলোনীর কারো সাথে তেমন মিশত না। এখন কারণটা বুঝি, উনার স্বামীর সাথে উনার ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছিল। আজকের সমাজে এটা অনেকটাই স্বাভাবিক হলেও তখনকার সময়ে এটা কিন্তু ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিত। সেই থেকে বিদ্যুৎ আমাদের বৈকালিক আড্ডা, ফুটবল , ক্রিকেট - সবকিছুর সদস্য হয়ে গেল।সে অত্যন্ত মেধাবী ছিল এবং সেই একমাত্র সেইন্ট যোসেফ স্কুলে পড়ত। তবে এটাও মনে আছে, তার বাবা তাকে দেখতে মাঝে মাঝে আসত। সে খুব চাপা স্বভাবের ছিল, কিন্তু যেদিন তার বাবা আসত, সেদিন তার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠত। খেলা-ধূলায় সে মোটামুটি হলেও দেশ-রাজধানীতে তার সাথে পারা কঠিন ছিল। ওর মা ধানমন্ডি কামরুন্নেসা স্কুলের শিক্ষিকা ছিলেন এবং বাসাটা উনার নামে বরাদ্দ ছিল। বিদ্যুতের আগমনে আমাদের চাঁদা তোলার দুরূহ কাজটা অনেক সহজ হয়েছিল, আমাদের অবস্থা বুঝে বিদ্যুৎ ওর মার কাছ থেকে টাকা আনত। বিদ্যুতের মাকে আমি কদাচিত হাসতে দেখেছি, উনি খুব নীতিবান ছিলেন, বিদ্যুতের বাবার কাছ থেকে ভরণপোষনের জন্য কোন টাকা নিতেন না। যদিও বিদ্যুতের ডাক্তার বাবার পক্ষে দুই ছেলে-মেয়ের (বিদ্যুতের ছোট একটা বোন ছিল) ব্যয় বহন করা কোন ব্যাপার ছিল না। কি ভাবে উনি সন্তানদের মানুষ করেছেন, সেই গল্প আর এক দিন।
আজ মহিয়সী সেই মার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে শেষ করছি।
১০ মে ২০১৬
ঢাকা
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই মে, ২০১৬ সকাল ১১:১৪