somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

“জোছনা ও জননীর গল্প” – মুক্তিযুদ্ধের শুরুর কথা (৩য় পর্ব)

২৭ শে আগস্ট, ২০১৬ রাত ১২:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



পাঁচ শত পাঁচ পৃষ্ঠার বিশাল উপন্যাস “জোছনা ও জননীর গল্প”-কে বর্ণনার সুবিধার জন্য আমি দুইভাগে ভাগ করেছি “মুক্তিযুদ্ধের শুরুর কথা” ও “মুক্তিযুদ্ধের নয়মাসের কথা”। “মুক্তিযুদ্ধের শুরুর কথা” বলতে লেখক ব্যয় করেছেন এক শত ছত্রিশ পৃষ্ঠা, যা পুরো উপন্যাসের কলোবরের এক চতুর্থাংশ। উপকূলীয় বিশাল ঝড়ের পূর্বাভাস যেমন প্রকৃতিতে পাওয়া যায়, শান্তিপ্রিয় বাঙালি জাতির জীবনেও মুক্তিযুদ্ধের পূর্বের সেই ভয়ংকর, অশান্ত সময়ের একটা চিত্র লেখক অত্যন্ত যত্ন নিয়ে হৃদয় দিয়ে নিজের/অন্যের অভিজ্ঞতা দিয়ে এঁকেছেন। আমি চেষ্টা করেছি সেই আবেগটা ধরে রেখে বিভিন্ন ঘটনার মাধ্যমে তাঁর চিত্রিত অসামান্য কিছু চরিত্রকে পাঠকের কাছে তুলে ধরতে। এই প্রয়াসের অংশ হিসাবে উপন্যাসটা পড়তে যেয়ে বারবার মনে হয়েছে সেই সব পাঠকের কথা, যারা এর বিশাল কলোবর দেখে বইটা পড়তে গিয়ে পিছিয়ে এসেছেন। তাই বাঙালির শ্রেষ্ঠ সময়কে ঘিরে প্রিয় লেখকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাসের সাথে পাঠকের পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য প্রথম পাতা থেকে শেষ পাতা পর্যন্ত আমি হেটে যাব, কুড়িয়ে নেব মনিমানিক্য যা পাই – সঙ্গী হওয়ার জন্য সকলের প্রতি রইল আহ্বান।

আগের পর্বগুলোঃ

জোছনা ও জননীর গল্প - ভূমিকা (১ম পর্ব)
জোছনা ও জননীর গল্প - পূর্বকথা (২য় পর্ব)

মাওলানা ইরতাজউদ্দিন, শাহেদ, আসমানী ও আরো অনেকের গল্পগুলো বলে যাব “মুক্তিযুদ্ধের শুরুর কথা” পর্যন্ত একের পর এক, তারপর শুরু করবো “মুক্তিযুদ্ধের নয়মাসের কথা” – যেখানে দেখা হবে আরো অনেকের সাথে।

আজ বলবো নীলগঞ্ছ হাইস্কুলের আরবি শিক্ষক মাওলানা ইরতাজউদ্দিন কাশেমপুরীর ঢাকা শহরের গল্পটা, নীলগঞ্ছের গল্পটা অন্যদিন।

মাওলানা ইরতাজউদ্দিন কাশেমপুরী

ঘটনাপ্রবাহ

কমলাপুর রেলস্টেশনে প্রায় ষাট বছর বয়সী মাওলানা ইরতাজউদ্দিন ডান হাতে একটা রাজহাঁস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন – উপন্যাসের শুরু এখানেই। মুখভর্তি সাদাকালো দাড়িওয়ালা স্থূলকায় বেঁটে মাওলানা ইরতাজউদ্দিন শিক্ষকতার পাশাপাশি নীলগঞ্ছ জুমা মসজিদে শুক্রবার ইমামতিও করেন। এই বিশাল পক্ষীর ঠোকরে তাঁর বা হাতের কনুই থেকে রক্ত ঝরছে, উৎসুক জনতা তাঁকে ঘিরে বেশ মজা পাচ্ছে। সেই মজাটা আরো বেড়ে গেল যখন পক্ষীটা একই জায়গায় আবার ঠোকর দিল। শহুরে মানুষের নিষ্ঠুরতার তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে ফাল্গুনের শুরুতেও গরমে ঘামছেন উনি, মালিবাগে ছোট ভাই শাহেদের বাসায় যাওয়ার জন্য একটা রিকশায় ওঠলেন। রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে উত্তপ্ত শ্লোগানের নগরী ঢাকার রূপ দেখতে দেখতে দেখতে একসময় পৌছে গেলেন শাহেদের বাসায়। কিন্তু ওরা বাসা বদল করে অন্যত্র চলে গেছে। তাই তিনি আবার কমলাপুর স্টেশনে ফিরে এসে ওখানেই রাত কাটান।পরদিন বুদ্ধি করে শাহেদের বাসার ঠিকানা জোগাড় করে রায়েরবাজারে ওর বাসার পৌছান।কিন্তু ভাতিজি রুনি ও ওর মা আসমানীকে বাসায় না পেয়ে ক্ষুদ্ধ হন। শাহেদ ওনাকে শান্ত করার জন্য ওদের আনতে কলাবাগানে শাশুড়ির বাড়িতে যান। ওদের ওখানে না পেয়ে ব্যথিত হৃদয়ে আবার বাসায় ফেরেন।

অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যতে কী অনায়াস বিচরণ

উপন্যাসের কাহিনী লেখক এমনভাবে বর্ণনা করেছেন যে, পাঠককে একসময় থেকে আরোক সময়ে নিয়ে গেছেন অনায়াস দক্ষতায়। ওয়েব পেজের লিঙ্ক ধরে ব্যবহারকারী যেমন ঘুরে বেড়ায় সাইট থেকে সাইটে,তেমনি কিছু লিঙ্ক লেখক ব্যবহার করেছেন। এই যেমন মাওলানা ইরতাজউদ্দিন শাহেদের দেয়া দুধ খেতে খেতে দুধের লিঙ্ক ধরে চলে গিয়েছেন এক বছর আগে শান্তাহার স্টেশনে-যেখানে দেখা হয়েছে মাওলানা ভাসানীর সাথে, তার সান্নিধ্যে মুগ্ধ হয়েছেন, ট্রেন মিস করেছেন উনার সাথে মোনাজাতে অংশ নিয়ে।

মাওলানা ইরতাজউদ্দিনের জ্বর জ্বর ভাবের লিঙ্ক ধরে শাহেদ পাঠককে শুনিয়েছেন দু’ভাইয়ের মধুর সম্পর্ক ও তাদের পরিবারের কিছু করুণ কাহিনী।

বারন্দায় বসে মাওলানা ইরতাজউদ্দিন ঘুম তাড়ানোর জন্য তার বিয়ের দিনের লিঙ্ক ধরে চলে গিয়েছেন সুদূর অতীতে, বিবাহ ভঙ্গের করুণ বেদনায় পাঠক হয়েছে মর্মাহত।

একান্তে দেখা

এক বড়ভাই তার খুব ছোটভাইকে মার স্নেহ দিয়ে লালন-পালন করছেন, তার বুকে মাথা না রাখলে ছোট ভাইয়ের ঘুম আসে না-এই ছবিটা চোখে ভাসলেই হৃদয়টা মাওলানা ইরতাজউদ্দিনের এক অসহায় ছোটভাইয়ের ভাই না হয়ে বাবা হয়ে ওঠার গল্পটা মনকে নাড়া দেয়। টাইফয়েড আক্রান্ত ক্লাস থ্রি পড়ুয়া ছোটভাইকে টানা আটদিন কোলে করে বসে ছিলেন – ভাবা যায়! মা ছাড়া এমন স্নেহের দাবী আর কেউ কি মেটায়?

এমন একটা ভালবাসার ভরপুর মানু্ষের জীবনে বিয়ের আসর থেকে যখন বউ পালিয়ে যায়, তখন মনটা ভেঙ্গে যায়। কিন্তু কি আশ্চর্য, জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসেও তিনি তাঁকে স্বপ্নে দেখেন। একটি সন্তানের জন্য মনের অজান্তে ভালবাসা বেড়ে ওঠো, আসমার কোলে তাকে দেখেন – তার নাম জানতে চান।

মিথ্যা কথা বলা পছন্দ করেন না। তাই প্রথমে ছোটভাইকে খুশি করার জন্য মিথ্যা কথা বললেও পরে শাহেদকে জানান যে নষ্ট দুধ খেতেও তার ভালই লেগেছে।

এমনি একজন স্নেহপরায়ণ মহৎ মানুষের সাথে “জোছনা ও জননীর গল্প” উপন্যাসে পরিচিত হয়ে ভাললাগছে।

যে কথাগুলো বারবার পড়লেও পুরনো হয় না -- এপিগ্রাম

১। জাতি হিসেবে বাঙালির উপদেশপ্রীতি আছে।

২। বয়সকালেই মানুষ ছোটখাটো ভুল করতে থাকে। ছোটখাটো ভুল করা যখন অভ্যাস হয়ে যায় তখন করে বড় ভুল।

৩। মানুষের সঙ্গে মানুষের তফাত করা যায়, ছায়ার সঙ্গে ছায়ার তফাত করা যায় না। ঢাকা হলো ছায়ামানুষের দেশ। ছায়ানগরী।

৪। শাশুড়ি হলেন মাতৃসম। তার সেবা করলে মাতৃ্ঋণ শোধ হয়। তোর জন্মের পর পর মা মারা গেলেন। তুই তো আর মাতৃঋণ শোধ করার সুগোস পাস নাই। পিতৃঋণ শোধ না করলে চলে, মাতৃঋণ শোধ করতে হয়।

৫। অক্ষম এবং দুর্বল পুরুষরাই শুধু স্ত্রীর সঙ্গে রাগারাগি করে।

৬। মানুষমাত্রই ভুল করে, তবে তার সুবিধা হচ্ছে সে ভুল শোধরাবার সুযোগ পায়।

দু’টি কথা

রাজহাঁসটাকে তার সঙ্গীর কাছ থেকে মাওলানা ইরতাজউদ্দিন ছিনিয়ে এনেছিলেন, তাঁর মনও খারাপ হয়েছিল। সেই রাজহাঁসটা কী ১৯৭১ সালের কঠিন সময়টায় পরিবার বিচ্ছিন্ন শত শত মানুষের রূপক?

মাওলানা ইরতাজউদ্দিন ও নীলগঞ্ছের গল্পটা নিয়ে আসছি আগামী পর্বে।

নোট: আমি খুবই কম জানা একজন যা তা লেখক। আমি আমার সেই জানার অভাবটা পূরণ করে নেই বিদগ্ধ সহ ব্লগার ভাইদের মন্তব্য পড়ে। আমার এই পোস্টে হাসান মাহবুব ভাই যখন মন্তব্যে লিখলেন : 'এপিগ্রাম গুলো দারুণ'। আমি অবাক হলাম, আমার পোস্টে কোথাও তো 'এপিগ্রাম' শব্দটা ব্যবহার করিনি। তাই যথারীতি গুগল মামার স্মরণাপন্ন হয়ে বিষয়টা জানলাম। বুঝলাম, 'যে কথাগুলো বারবার পড়লেও পুরনো হয় না' শিরোনামে আমি যা লিখেছি তাকেই 'এপিগ্রাম' বলে। তবে নিজের জিনিস তো, তাই মায়া ছাড়তে পারলাম না- ওটাকে রেখে হামা ভাইকে সম্মান জানিয়ে পাশে যোগ করলাম 'এপিগ্রাম' ।


চলবে.....

ঢাকা
২৭ আগস্ট ২০১৬
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে আগস্ট, ২০১৬ সকাল ১১:২৮
১৩টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দেশ এগিয়ে যাচ্ছে; ভাবতে ভালই লাগে

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:০৩


বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল নেতিবাচক। একই বছরে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ১ শতাংশ। ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×