স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় উত্তাল ঢাকা নগরী । সেই উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে নগরবাসীদের মাঝে । ছড়িয়ে পড়ে শাহেদ-আসমানীর দাম্পত্য জীবনেও । অনিশ্চিত, অস্থির মার্চের প্রহরগুলোয় খুব সামান্য বিষয় নিয়ে এই দম্পতি জড়িয়ে পড়ে তুমুল ঝগড়ায় । সেই ঝগড়ার মাঝেও তাদের ভালবাসার প্রকাশটা হুমায়ূন আহমেদ ফুটিয়ে তুলেছেন অসামান্য দক্ষতায় ।
অত্যধিক রাগের কারণে আসমানী শাহেদকে ‘রাগ কুমার’ বলে ডাকে প্রায়ই । আমিও আসমানীকে একটা নাম দিয়েছি – ‘রাগ কুমারী’ । তাদের মধুর দাম্পত্য কলহে নতুন মাত্রা যোগ করে তাদের আদুরে জেদী কন্যা রুনি । বুঝতেই পারছেন পাঠক, ‘রাগ কুমার’ ও ‘রাগ কুমারী’-র রাগের কিছুটা সেও পেয়েছে । তাকে আমি ডাকব ‘রাগ কন্যা’ বলে ।
এই ত্রয়ীয় মধুর রাগ-অনুরাগের ঘটনাগুলোর ফাঁকে ফাঁকে যোগ হয়েছে ইতিহাসের নীরস বিষয়গুলোও । লেখক এমন সুন্দরভাবে তা বিবৃত করেছেন যে, পড়তে বসলে ওঠতে ইচ্ছে করে না । চলুন- ‘রাগ কুমার’, ‘রাগ কুমারী’ ও ‘রাগ কন্যা’-র গল্পটা শুনি ।
আগের পর্বগুলোঃ
জোছনা ও জননীর গল্পঃ ( ১ম পর্ব)
জোছনা ও জননীর গল্পঃ (২য় পর্ব)
জোছনা ও জননীর গল্পঃ (৩য় পর্ব)
জোছনা ও জননীর গল্পঃ (৪র্থ পর্ব)
ঘটনাপ্রবাহ
শাহেদ-আসমানীর মাঝে বেশ কয়েকবার রাগ-অনুরাগের ঘটনার মধ্য দিয়ে কাহিনী এগিয়ে চলে । ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ ও অন্যান্য ছোটখাট ঘটনাও আছে । শেষ পর্যন্ত ঘটনা থমকে দাঁড়ায় ২৫ মার্চের ভয়াল কালো রাতে । পাঠক, সেই কঠিন সময়ে কোথায় রাগ কুমার ? কোথায় রাগ কুমারী ? সেসব জানতে হলে আসুন আমার সাথে ।
ফাল্গুনের শুরুতে কাহিনীর শুরু । শাহেদের বড়ভাই ইরতাজউদ্দিন অনেক কষ্টে খুঁজে পায় শাহেদের বাসা । তার কিছুক্ষণ আগে রাগ কুমারী রাগ কুমারের সাথে তুমুল ঝগড়া বাঁধিয়ে রিকশা নিয়ে চলে গেছে মার বাড়ি – কলাবাগানে । একটা অভিনব আইডিয়া রাগ কুমারের মাথায় আসে - একটা বেবিট্যাক্সি নিয়ে রায়ের বাজার থেকে বৌয়ের আগেই শ্বশুরালয়ে পৌঁছে যাবে । ওদের বাসার বারান্দায় গম্ভীরমুখে বসে খবরের কাগজ পড়তে থাকবে, হাতে চায়ের কাপ । কিন্তু বড়ভাই এসে পড়ায় পরিকল্পনাটা ভেস্তে গেল ।
রাগ কুমার-রাগ কুমারীর বড় বড় ঝগড়ার সবই অতি তুচ্ছ কারণে হয়েছে । এই যেমন আজকের ঝগড়ার বিষয়বস্তু বাথরুমের ছিটকিনি । আসমানী ছিটকিনি লাগাবার জন্য শাহেদকে তিনটা পেরেক কিনে আনতে বলে । শাহেদ বার বার ভুলে যায় । ব্যস, এক-কথা দু-কথায় দুজনেই পরস্পরকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করে । রাগ কুমারী রাগ করে চলে যায় মার বাড়ি ।
চারদিন পর এক সকালে হাতে ছোট্ট টিফিন কেরিয়ার ঝুলিয়ে বাসায় ফিরে । যেন তাদের মধ্যে কিছুই হয়নি এমনি ভাব নিয়ে রাগ কুমারকে রিকশা ভাড়া দিতে বলে । পিত্তি জ্বলে গেলেও রাগ কুমার কিছু বলতে পারে না । মেয়ের ব্যবহারেও শাহেদ অবাক । আসার পর থেকেই আঁকাআঁকি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে । বাবার সাথে যে এতদিন দেখা নেই, তাতে ভ্রুক্ষেপ মাত্র নেই । মেয়ের বাঁ হাতের আঙুলে একটা ব্যান্ডেজও বাঁধা । সেটা নিয়ে কোন কথা বলার সুযোগও মেয়ে বাবাকে দিচ্ছে না ।
টিফিন কেরিয়ারে করে আসমানী গরুর মাংস নিয়ে এসেছে । মাংস গরম করে চালের রুটি দিয়ে শাহেদকে নাস্তার জন্য ডাকে । নিজ থেকে ক্ষমাও চায় । কিন্তু রাগ কুমার এবার তার রাগ দেখায়, নাস্তা না করে একটা রিকশা নিয়ে মতিঝিলে অফিসের দিকে চলে যায় ।
অফিস থেকে ফেরার সময় শাহেদ এক সের রসগোল্লা কেনে আসমানীর জন্য । রসগোল্লা আসমানীর খুব প্রিয় । এটা নিয়ে সে নীরবে বলতে চায়, ‘আই অ্যাম সরি ।’ মেয়ের জন্য কেনে পাঁচটা মুনিয়া পাখি – খাঁচা সহ । কিন্তু বাসায় গিয়ে দেখে আসমানী মেয়েকে তার মার বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে, সেও যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে । নাস্তা না খাওয়ার প্রতিশোধ । শাহেদ ব্যথিত হৃদয়ে রসগোল্লার হাঁড়ি ও মুনিয়া পাখির খাঁচা নিয়ে তার বন্ধু গৌরাঙ্গের বাসার দিকে রওনা হয় - মেয়ের ওপর রাগ করে পাখিগুলো বন্ধুর মেয়েকে দিয়ে দিবে বলে মনস্থ করে ।
দুদিন যাবত রাগ কুমার-রাগ কুমারীর মধ্যে নিঃশব্দ ঝগড়া চলছে । এই ঝগড়ার জন্য আসমানীর দায়টাই বেশী । তাই শাহেদ কথা বলা বন্ধ রেখেছে । আসমানী চেষ্টা করছে বিভিন্নভাবে ওর সাথে কথা বলার জন্য ।
এবারের বিষয়টাও খুব তুচ্ছ । শাহেদের বড়ভাই ওদেরকে অতি সত্ত্বর নীলগঞ্জে যাওয়ার জন্য চিঠি দিয়েছে । শাহেদ আসমানীকে অনুরোধ করে নীলগঞ্জে যেতে । উত্তরে আসমানী বেশ কিছু আপত্তিকর কথা বলে । শাহেদ প্রতিবাদ হিসাবে বেছে নেয় মৌনতা, শুরু হয় দুজনের নিঃশব্দ ঝগড়া ।
এমনিভাবে আটচল্লিশ ঘণ্টা পেরিয়ে যায় । ৭ মার্চের ছুটির সকালে শাহেদ বাইরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলে আসমানী তাকে যেতে বারণ করে । রুনির জ্বর । ওকে ডাক্তারের কাছে নেওয়ার অনুরোধ করে । কিন্তু শাহেদ সন্ধ্যায় মেয়েকে ডাক্তারের কাছে নেওয়ার কথা বলে বাসা থেকে বেরিয়ে আসে । আসমানী তাকে সতর্ক করে দেয় যে, ফিরে এসে শাহেদ তাকে বাসায় পাবে না ।
শাহেদ রিকশা করে আগামসি লেনে বন্ধু নাইমুলের বাসায় যায় । বন্ধু তাকে না জানিয়ে আজই বিয়ে করতে যাচ্ছে । তাই বন্ধুর ওপর অভিমান করে দুপুরের আহার না করেই রেসকোর্সের দিকে এগোতে থাকে । লাখ লাখ লোক রেসকোর্সে জড়ো হয়েছে । জনসমুদ্র থেকে ভেসে আসে বিভিন্ন স্লোগান – ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো ।’ অনেকে বাচ্চাকাচ্চাও নিয়ে এসেছে । এক বাবার ঘাড়ে বেণি দুলানো এক মেয়ে ঘুরছে । মুগ্ধ চোখে এই দৃশ্য দেখতে দেখতে শাহেদের রুনির কথা মনে পড়ল । রুনি তার বাবার ঘাড়ে চড়ে মানুষের সমুদ্রের এই অসাধারণ দৃশ্য উপভোগ করত ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ভরাট গলা ভেসে আসছে ।
‘আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি । ..... ’
সুন্দর এক সকালে সুন্দর করে শাড়ি পরে রাগ কুমারী হাসিমুখে এক কাপ চা নিয়ে রাগ কুমারকে দেয় । রাগ কুমার চায়ে চুমুক দিয়ে দৈনিক ইত্তেফাকের পাতায় আগুনগরম খবর পড়তে ব্যস্ত হয়ে পড়ে । কিন্তু বাসায় চাল-ডাল, চা, চিনি কিছুই নেই । তাই আসমানী জোর করে শাহেদকে সংসারের জন্য চা, চিনি, রেজার ব্লেড আর রুনির জন্য হাতিমার্কা খাতা কিনতে দোকানে পাঠায় । মেয়ে সেই খাতায় আঁকবে । মিনিট দশেকের মধ্যেই শাহেদ সব কিনে বাসায় ফেরে । কিন্তু খাতার কভারে হাতির ছাপ না থাকায় রাগ কন্যা জেদ ধরে । সে তার বাবার হাত থেকে খবরের কাগজ নিয়ে ছিঁড়ে ফেলে । মেজাজ ঠিক রাখতে না পেরে শাহেদ মেয়ের গালে চড় বসিয়ে দেয় । গাল কেঁটে রক্ত বেরোয় । তাই দেখে আসমানী শাহেদের ওপর খুব রাগ করে । শাহেদের মনটা খারাপ হয়ে যায় – ও বাসা থেকে বেরিয়ে অফিসের দিকে চলে যায় ।
অফিস থেকে বন্ধু নাইমুলের বাসা হয়ে শাহেদ দুপুর দুটার দিকে বাসায় ফিরে । ফেরার পথে ছটা হাতিমার্কা খাতা, রঙ-পেনসিল কিনে মেয়ের জন্য । আর আসমানীর রাগ ভাঙানের জন্য কিনে একটা রাগভাঙানি-শাড়ি । শাড়ির সঙ্গে ছোট্ট কাগজে নোট লেখে – ‘জান গো! কেন এমন করো ?’
বাসায় তালা । শাহেদ কলাবাগানে শাশুড়ির বাসায় যায় । সেখানেও নেই । শাড়িটা ওখানেই রেখে বিভিন্ন জায়গায় ওদের খোঁজে । ঘড়ি নেই বলে শাহেদ বুঝতে পারছে না রাত কত । রাস্তায় লোক চলাচল নেই । রিকশাও চলছে না । কিছুদূর পর পর বাস্তায় ব্যারিকেড ।
শাহেদ রাস্তায় হাঁটছে তার বৌ ও মেয়ের খোঁজে, এমন সময়ে মিলিটারি নামল শহরে । ২৫ মার্চের ভয়াল কালো রাত, সালটা ১৯৭১ – শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ ।
একান্তে দেখা – শাহেদ-আসমানী
শাহেদ-আসমানী ঝগড়ার পর কেউ কারো কাছে নতি স্বীকার করতে চায় না । কিন্তু একজনের জন্য আরেক জনের ভালবাসা, সহানুভূতির শেষ নেই । পেরেক নিয়ে শাহেদকে কড়া কথা বলার পর মুহূর্তে আসমানী ভাবে, বাড়িওয়ালার ছেলে মজনুকে পাঠালেই তো হতো । শাহেদের জন্য এমন একটা কিছু করতে চায়, যাতে সে খুশি হয়ে যায় । অবশ্য সেই পদ্ধতিটা ব্যবহার করতে তার খুব লজ্জা লাগে ।
আসমানীর তীব্র কথার আড়ালে ওর নরম মনটার খবরও লেখক আমাদের দিয়েছেন । শাহেদের জীবনটাকে আসমানী কয়লা বানিয়ে ফেলেছে – এই কথা শুনে আসমানীর চোখে পানি এসে যায় । শাহেদের কাছ থেকে চোখের পানি গোপন করার জন্য সে রান্না ঘরে চলে যায় ।
শাহেদও কিন্তু খুব ভাল স্বামী । আসমানীর সাথে রাগারাগি করার পর মুহূর্তেই তার অনুশোচনা হয় – কিছু একটা করে আসমানীকে খুশি করতে চায় । বেবিট্যাক্সি নিয়ে শাশুড়ির বাসায় দ্রুত যাওয়ার পরিকল্পনা তারই অকাট্য প্রমাণ ।
আসমানীর রাগভাঙানোর জন্য শাহেদের আন্তরিকতা প্রশ্নাতীত । আসমানীর জন্য রসগোল্লা, রাগভাঙানি শাড়ি কেনা বুঝিয়ে দেয় ও রাগ কুমারীকে কত ভালবাসে ।
এমন চমৎকার একটা জুটির ঝগড়া দেখে পাঠক হিসাবে হৃদয় ভেঙে যায়, আবার ‘জান গো! কেন এমন করো ?’ নোটটা পড়ে হৃদয় কানায় কানায় ভরে যায় ।
যে কথাগুলো বারবার পড়লেও পুরনো হয় না - এপিগ্রাম
১। কবিতা একবার পড়লে অনেকক্ষণ মাথায় থাকে । কবিতার শব্দগুলি না থাকলেও ছন্দটা থাকে । ট্রেন চলে যাবার পরেও যেমন ট্রেনের ঝিক ঝিক শব্দ মাথায় বাজতে থাকে সে-রকম ।
২। স্ত্রীরা স্বামীর যে-কোনো বিষয়ের প্রতি অতিরিক্ত আগ্রহকেই সন্দেহের চোখে দেখে ।
৩। আসমানী শাহেদকে বলে, দোকানে ভালোবাসা কিনতে পেলে তোমাকে সের খানেক ভালোবাসা কিনতে বলতাম ।
দুটি কথা
শাহেদ একটা রিকশা নিয়ে বন্ধু নাইমুলের বাসায় যাচ্ছিল । মধ্যবয়স্ক রিকশাওয়ালা শাহেদের সাথে অনেক কথা বলে । স্বাধীন হলে, “খাওয়া-দাওয়া, কাপড়-চোপড় সব দিব এসটেট” – রিকশাওয়ালার এই প্রশ্নে শাহেদ নীরব থাকে । আজও আমরা নীরব হয়ে আছি ।
গৌরাঙ্গের গল্পটা নিয়ে আসছি আগামী পর্বে।
চলবে.....
ঢাকা
২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০১৭ সকাল ৮:২০