ডিসেম্বর মাস, বিজয়ের মাস । শীতের সকালে নরম রোদ জানালা গলে তোহা সাহেবের পিঠে হালকা পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে । খাটের ওপর বসে উনি খবরের কাগজ পড়ছেন । সকালের নাস্তা হয়ে গেছে । পান চিবুতে চিবুতে বড় ছেলেকে ডাকলেন, হাদি ।
হাদি ক্রিকেট খেলতে মাঠে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল পাশের ঘরে । জ্বি, বাবা – বলে সাড়া দিয়ে বাবার সামনে এসে হাজির হলো ।
ছেলেকে ফুলপ্যান্ট পরা দেখে উনি বুঝতে পারলেন মাঠে খেলার সাথীরা অপেক্ষা করছে । ছুটির দিন ছাড়া উনি সময় করতে পারেন না । তাই দরকারী কথা ছুটির দিনেই সারতে হয় ।
‘হাদি, মাঠে খেলতে যাচ্ছিস ?’
‘জ্বি, বাবা ।’
‘পড়ালেখা কেমন চলছে ?’
‘ভাল ।’
‘ভাল হলেই ভাল। এবার পরীক্ষার রেজাল্ট কী ?’
হাদির মধ্যে একটা লাজুক ভাব এসে যায় । মুখ নিচু করে আস্তে করে বলে, ফার্স্ট হয়েছি ।
তোহা সাহেবের শুকনো ছোট মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, খাড়া নাকের উপর চেপে বসা চশমাটা বাম হাত দিয়ে উপরে ঠেলে দিয়ে ছেলের দিকে তাকান।
কিছু একটা বলে ছেলেটাকে উৎসাহিত করা দরকার । প্রতিবছর এই রকম ভাল রেজাল্ট করে আজ ছেলেটা নবম শ্রেণিতে । বাবা হিসাবে গর্বে বুকটা ভরে ওঠে। কিন্তু চুপচাপ স্বভাবের তোহা সাহেবের কিছু বলা হয়ে ওঠে না । সারা বছর উনি ছেলে-মেয়ের লেখাপড়ার কোন খোঁজ নেন না । কিন্তু বছর শেষে একদিন সবার রিপোর্ট কার্ড দেখেন ।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে হাদিকে বলেন, সবাইকে এখানে আসতে বল, রিপোর্ট কার্ড সহ ।
হাদি প্রথমেই রান্নাঘরে ওর মার কাছে যায় । উনি স্বামী ও নিজের জন্য চা তৈরি করছেন । হাদি মার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিস ফিস করে বলে, মা, বাবা সবার রেজাল্ট দেখতে চাইছে ।
আতিয়া বেগম ছেলের কথা শুনে দ্রুত চায়ে চিনি মিশিয়ে নাড়তে থাকেন – ছেলে-মেয়েরা ওদের বাবার মুখোমুখি হওয়ার আগেই চা নিয়ে স্বামীর কাছে পৌছাতে হবে । বড় ও মেজ ছেলে ছাড়া সবার রেজাল্ট খারাপ । দেখলেই তোহা রাগ করবে, প্রতিবছর যেমন করে । আর রাগ ওঠলে ওর হিতাহিত জ্ঞান থাকে না ।
দীর্ঘদেহী পাতলা গড়নের তোহা সাহেব কিছুটা কুঁজো হয়ে খবরের কাগজের ওপর ঝুকে আছেন । আতিয়া চায়ের কাপটা স্বামীর দিকে এগিয়ে দিয়ে মৃদু হাসতে হাসতে বলে, নাও, চা খাও ।
তোহা সাহেব চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে বলেন, কই, তোমার রাজপুত্ররা ?
আতিয়া খাটের একপ্রান্তে বসেন । দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা হাদি, টিপু, ফয়েজ ও জামাল গুটি গুটি পায়ে ঘরে ঢোকে । হাদি রিপোর্ট কার্ডগুলো বাবার সামনে বিছানায় রাখে – সবার ওপরে হাদিরটা, সবার নীচে মুন্নীরটা । মুন্নী ওদের একমাত্র বোন, জানুয়ারীতে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিল ।
তোহা সাহেব বড় ও মেজো ছেলের কার্ড দুটা উনার বাম পাশে আর অন্যগুলো ডান পাশে রাখলেন । মুখ গম্ভীর । দাঁড়িয়ে থাকা ফয়েজ ও জামালের দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকালেন – ওরা মাথা নিচু করে মেঝের দিকে তাকালো । এবার বৌয়ের দিকে ফিরলেন, মুন্নী কই ?
আতিয়া হড়বড়িয়ে বলে ওঠেন, এই তো পাশের ঘরে । ফাহাদ ঘুমাচ্ছে । ওর পাশে আছে । তুমি ওকে কিছু বলো না ।
ছোট ছেলের কথায় তোহা সাহেবের মনটা নরম হয়ে যায় । তুলতুলে ছোট্ট দুটো হাত । দাঁত শুন্য মাড়ির খিল খিল হাসি । সারা ঘরটা ভরিয়ে রাখে ।
কার্ডগুলো আতিয়ার দিকে ঠেলে দিয়ে উনি বললেন, এগুলো নিয়ে যাও । আর সবাই আমার সামনে থেকে দূর হও ।
সবাই হাঁপ ছেড়ে বাঁচল । ধীর পায়ে চার ভাই ঘর পেরিয়ে বাইরের দরজার কাছে গেল । তারপর সিঁড়িঘর থেকে ধুপ-ধাপ আওয়াজ পাওয়া গেল । দে ছুট । মাঠের দিকে । সেখানে সবাই জড়ো হয়েছে ব্যাট আর টেনিসবল নিয়ে ।
মুন্নী পাশের ঘর থেকে কান পেতে সব শুনছিল । বিপদ কেটে গেছে বুঝতে পেরে মুন্নী ঘুমন্ত ফাহাদের কপালে একটা আদর দিয়ে দেয় । ওর খেলার সাথীরা ওকে প্রায়ই ডাকে । ও যায় না । ওর সব খেলা এখন এই ছোট্ট জীবন্ত খেলনাটার সাথে ।
চলবে..
শামছুল ইসলাম
৩১-০৩-২০১৭
সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে মার্চ, ২০১৭ সকাল ১১:১৫