৫
ফাহাদ অসুস্থ ।
তাকে দেখতে পাড়া-প্রতিবেশীরা প্রায়ই আসেন । কেউ কেউ ভরসা দেন । কারো কারো কথায় মনে আরো ভয় ঢ়ুকে যায় । দিন যায় । প্রতিবেশীদের যাতায়াত কমে আসে । তবে এখন সন্ধ্যা হলেই তোহা সাহেব বাসায় ফিরছেন । আতিয়া খুশি । দুজনে চা খেতে খেতে গল্প করে । ফাহাদের সমস্যা হবে, তাই তোহা সাহেব বাইরে গিয়ে সিগারেট খান । আতিয়ার কড়া হুকুম ।
ফাহাদের অপারেশন করতে অনেক খরচ হবে । সেই টাকা কীভাবে জোগাড় করা যায় তাই নিয়ে আতিয়া স্বামীর সাথে আলাপ করেন । কোনো ভাবেই হিসাব মিলে না । হঠাৎ আতিয়ার মনে পড়ে যায়, একসময় গেন্ডারিয়ায় একটা বাড়ি ও মিরপুরে কিছু জমি কিনেছিল হাদির বাবা । তখন তাদের সংসার ছোট ছিল আর তোহার হাউজির নেশাও ছিল না । আতিয়া সন্ধ্যায় চা খেতে খেতে কথাটা তোলে, বলে, এই, একটা কথা মনে পড়েছে ।
‘কী কথা ।’
‘গেন্ডারিয়ার বাড়িটার যে ভাড়া পাও তা এখন থেকে আমাকে দিবা ?’
তোহার কাপের গরম চা মুখে না যেয়ে জামায় পড়ে । উনি দাঁড়িয়ে জামার চা ঝাড়েন ।
আতিয়া বললো, জামাটা খুলে দাও । ভিজিয়ে দি । না হলে চায়ের রং ওঠবে না ।
আতিয়া একটা জামা নিয়ে এসে স্বামীকে পরতে দেন । তারপর আবার আগের কথায় ফিরে আসে, আগামী মাস থেকে ভাড়াটা আমি চাই ।
তোহা নিশ্চুপ ।
আতিয়া বলেই চলেছে, তোমার স্যুটকেসের ভিতর থেকে বাড়ি আর জমির দলিলটা বের কর । ফাহাদের চিকিৎসার জন্য দরকার হলে জমিটা বেচব । জমির দামটা তোমার মনে আছে ?
‘না, মনে নেই ।’
‘ঠিক আছে । চাবিটা দাও । খুলে দেখি ।’
তোহা সাহেব ওঠে যান । কিছুক্ষণ খুঁজে এসে বলেন, চাবিটা পাচ্ছি না । মনে হয়, অফিসে রেখে এসেছি ।
আতিয়া স্বামীর ওপর খুব বিরক্ত হন । কিন্তু নিজেকে শান্ত রেখে বলেন, কাল অফিস থেকে চাবি নিয়ে আসবে ।
এরপর থেকেই তোহা সাহেব অনেক রাত করে বাড়ি ফিরতে লাগলেন । আতিয়া ওর সাথে চাবির প্রসঙ্গ তুললেই কথা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেয় ।
ছুটির দিন । আতিয়া মনে মনে ঠিক করেছে, আজ স্যুটকেসটা খুলতেই হবে । সকালের নাস্তা করে স্বামীকে চা দিল । তারপর কোনোরকম ভূমিকা না করে সরাসরি তোহাকে বললো, চাবিটা পেয়েছো ?
তোহা জবাব দেয় না ।
‘ঠিক আছে, তাহলে আমি একটা চাবি বানিয়ে নেব তালাওয়ালা আসলে।’
চায়ের কাপটা টেবিলের ওপর ওল্টে দিয়ে তোহা সাহেব গট গট করে হেঁটে ঘরে গেলেন । আতিয়া হাঁ করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলো । ঘোর না কাটতেই আতিয়ার সামনের টেবিলে চাবিটা ছুঁড়ে ফেলে তোহা দরজা খুলে বাইরে চলে গেল ।
একটা অজানা আশঙ্কায় আতিয়ার হাত-পা অবশ হয়ে গেল । বড় ছেলেকে ডাকলেন । হাদি সামনে এসে দাঁড়ালো । চাবিটা হাতে নিয়ে অন্য হাতে ছেলের একটা হাত ধরে ঘরের দিকে গেলেন । খাটের নিচ থেকে স্যুটকেসটা হাদিকে বের করতে বললেন ।
স্যুটকেস খোলা হলো । তোহার বিভিন্ন রকম ফাইল-পত্রে ঠাঁসা । এক এক করে সব মেঝেতে নামানো হলো । সমস্ত ফাইল তন্ন তন্ন করে খোঁজা হলো । কোথাও নেই দলিল দুটো । আতিয়ার মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে । ফাইলগুলোকে এদিক-সেদিক ছুঁড়তে লাগলেন পাগলের মত । হাদি ভয় পেয়ে গেল ।
‘মা, তোমার কী হয়েছে ?’ বলে ও ভয়ে চেঁচাতে থাকে । টিপু, ফয়েজ, জামাল, মুন্নী সবাই ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে ।
হাদির মা মেঝেতে বসে কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বিলাপের সুরে বলে, তোর বাবা তোদের সর্বনাশ করেছে । বাড়ি, জমি সব বিক্রি করে দিয়েছে । জুয়া খেলে সব উড়িয়ে দিয়েছে ।
মুন্নী মার গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে । সবার চোখে পানি, হাদি ছাড়া । ওর বুকটা ফেটে যায়, কিন্তু চোখে পানি আসে না । আহ্, কী কষ্ট !!!
কান্নাকাটির শব্দে পাশের ঘরে ফাহাদের ঘুম ভেঙ্গে গেছে । সেও গলা ছেড়ে কাঁদছে ।
হাদি ওকে কোলে করে এ ঘরে নিয়ে আসে ।
ছেলেকে দেখে আতিয়ার শোক আরো বেড়ে যায় । ‘হায়, আমার ফাহাদের কী হবে ?’ বলে আতিয়া জ্ঞান হারিয়ে ফেলে ।
হাদি ছুটে পাশের বাসার খালাম্মা ডেকে আনে । উনি চোখে-মুখে পানি ছিটিয়ে আতিয়ার জ্ঞান ফেরান ।
আতিয়া ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে । আর কিছুক্ষণ পর পর বলে, আমার ফাহাদের কী হবে ।
চলবে....
০৬/০৪/২০১৭ ইং
আগের পর্ব গুলোর লিংকঃ
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই এপ্রিল, ২০১৭ সকাল ৯:০৮