আকাশের সাথে হেলান দিয়ে যে ছয় ছয়টা সবুজ পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে তারই পাশে মুকু রাজার রাজ্য । মুকু রাজার রাজ্যে সবাই খুব সুখী জীবন যাপন করে । সবুজ পাহাড়ের গা ঘেঁষে সমতল জমি, আর তাতে চাষ হয় নানা রকম শস্য।
মেঘেরা দলে দলে যাওয়ার পথে পাহাড়ের গায়ে বৃষ্টি ছড়িয়ে দিয়ে যায় । আর তাতেই লক লকিয়ে বেড়ে উঠে নানা রকম সবুজ গাছেরা ।
একদিন পূর্ণিমার রাতে , চারদিকে চাঁদের আলোয় ঝলমল করছিল। সেই রাতেই মুকু রাজার স্ত্রী মানে রাজ্যের রানী এক ছোট শিশুর জন্ম দিলেন ।
খবর শুনে রাজা যার পর নাই আনন্দিত। দৌড়ে চলে আসলেন উপরে যেখানে শিশুটি রাখা আছে । অন্দর মহলের দরজায় আসা মাত্র তিনি শুনলেন শিশুটি একটি কন্যা শিশু ।
তিনি অত্যন্ত রাগন্নিত হলেন। ভেতরেও গেলেন না শিশুটিকে দেখলেনও না। উজিরকে নির্দেশ দিলেন শিশুটিকে যাতে দাইমাকে দিয়ে দেওয়া হয়। কন্যা শিশু তিনি চান না ।
রানী দৌড়ে এলেনঃ
- মহারাজা এ কেমন অবিচার ! আমার ছোট্ট শিশু কি অন্যায় করেছে ? মেয়ে হওায়াটাই কি তার অপরাধ ?
- চুপ কর রানী । এই বংশের সব রানীরাই পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছে । পুত্র সন্তান বড় হয়ে রাজ্যের দায়িত্ব নিবে প্রজার ভাল মন্দ দেখবে ।
- আর তুমি কিনা জন্ম দিয়েছ কন্যা ! এই কন্যাসন্তান দিয়ে আমি কি করব ?
- না মহারাজা , আপনি অন্যায় করছেন , রানী কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন ।
রাজা কোন কথাই শুনলেন না । কন্যাটির মুখও দেখলেন না। দাইমাকে দিয়ে দিলেন । দাইমাকে দূর পাহাড়ের কাছে তার বাড়িতে চলে গেল ।
রানী কেঁদে কেঁদে বুক ভাসালেন। রানীর দুঃখে সেদিনের চাঁদটাও মেঘে ঢেকে গেল।
সেই থেকে কি যে কি হল । পুত্র হয়নি বলে রাজা মন মরা হয়ে থাকেন আর কন্যাকে হারিয়ে রানী ।
রানী বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত রাজ বাড়ীর ছাদে গিয়ে বসে থাকতেন আর দূরে ছয় পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন। রানীর সেই দীর্ঘশ্বাস বাতাসে ছড়িয়ে মেঘেদের কাছেও পৌঁছে যেত এমন ।
মুকু রাজার দেশের যে কি হল কে জানে । আস্তে আস্তে ছয় পাহাড়ের গায়ে মেঘেদের আনাগোনা কমতে লাগলো । এক সময় পাহাড়ের গায়ে মেঘ আসাই বন্ধ হয়ে গেল।
মেঘ নেই তাই বৃষ্টিও ঝরে পড়ে না আর । পাহাড়ের সবুজ গাছেরা বিবর্ণ হতে শুরু করল । রাজ্যের সব নীল পুকুর ,খালগুলি শুকিয়ে যেতে শুরু করল। মাটি হয়ে গেল কঠিন , ফেটে হয়ে গেল চৌচির । সে মাটির ফাক দিয়ে কোন সবুজ চারা উঁকি দেয় না আর ।
শস্যক্ষেত গুলোও শুকিয়ে কাঠ । পানি না থাকাতে মাছেরাও মরে যেতে লাগলো । পানির অভাবে রাজ্যে হাহাকার লেগে গেল । মানুষজন দুর্ভিক্ষে আর অনাহারে মরতে শুরু করল।
ছোট্ট পুকুরের পচা ঘোলা পানি নিয়ে শুরু হল মারামারি । রাজ্য অশান্তিতে ভরে গেল। মকু রাজা খুব চিন্তিত হয়ে পড়লেন। রাজ্যের কোষাগার থেকে টাকা আর স্বর্ণ মুদ্রা খরচ করে অন্যদেশ থেকে খাদ্যশস্য কিনে এনে বিনামূল্যে প্রজাদের বিলিয়ে দিলেন । কিন্তু এভাবে আর কত ! তিন বছরে রাজ কোষাগারও শুন্য হতে শুরু করল।
প্রজারা অনাহারে, তৃষ্ণায় মরতে লাগল। মকু রাজা প্রজাদের অবস্থা নিজ চোখে দেখার জন্য ঘোড়ায় চড়ে রাজ্যে ঘুরতে বের হলেন। ঘুরতে ঘুরতে তিনি ছয় পাহাড়ের পাদ দেশে এসে পৌঁছলেন।
দুপুর বেলা মাঠের প্রান্তে গাছের নিচে বসে ঝিমুচ্ছিলেন এক শ্মশ্রুমণ্ডিত বৃদ্ধ। হাতে একটা লাঠি ।
রাজাকে দেখে ম্লান হাসলেন। তার পর একা একাই বলতে লাগলেনঃ আমার একটা ভেড়ার পাল ছিল । তিনশ ভেড়া ছিল তাতে। পানি আর খাবারের অভাবে সব শেষ। হয়ত আমিও মরে যাব আজ কাল ।
তবে মহারাজ একটা কথা বলিঃ
" কন্যা আর পানি, স্রষ্টার কল্যাণ জানি ।
কন্যাকে দূরে ঠেলে আপনি পথভ্রষ্ট , স্রষ্টাও আজ বেজায় রুষ্ট ।
ফিরিয়ে আনুন কন্যা , জড়িয়ে ধরুন বুকে । রাজ্য ভরে যাবে মঙ্গল আর সুখে । "
রাজা অবাক হয়ে বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে রইলেন। বৃদ্ধ উঠে দাড়ালেন তার পর আবার বলতে লাগলেনঃ
"আরও আছে কথা অতীব গোপন ।
মহারাজার নিকট তা আমার সমর্পণ ।"
মকু রাজা বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন , কি সে গোপন কথা ? আমায় বলুন বৃদ্ধ ।
বৃদ্ধ উদাস ভঙ্গিতে ঝলসে যাওয়া হলুদ মাঠের দিকে তাকিয়ে রইলেন , তার পর বললেনঃ
"কন্যা সে তো শুধু কন্যা নয় ,
পাহাড়ি পাথরে পায়ের ছোঁয়ায় জলের নহর বয় । "
তার মানে কি ? রাজা জানতে চাইলেন । কিন্তু বৃদ্ধ আর সেখানে দাঁড়ালেন না । কিছু বললেনও না । মাঠের প্রান্তে হন হন করে হেটে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
রাজা রাজবাড়ীতে ফিরে এলেন। তিনি অনেক চিন্তা করলেন। নিজের ভুল তিনি বুঝতে পারলেন। অনুতপ্ত হলেন । রানীর কাছে ক্ষমা চাইলেন । দাইয়ের কাছে দূত পাঠালেন রাজকন্যাকে ফিরিয়ে আনতে । রাতে রাজ প্রাসাদের ছাদে বসে রানীকে সব খুলে বললেন। কিন্তু বৃদ্ধের শেষ কথাটি তিনি বুঝতে পারেন নি ।
কন্যা সে তো শুধু কন্যা নয় ,
পাহাড়ি পাথরে পায়ের ছোঁয়ায় জলের নহর বয় ।
এই কথার কি অর্থ হতে পারে রানী ? মুকু রাজার রানী ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমতি । তিনি বললেন , মহারাজ আপনার কন্যাকে ফিরিয়ে এনে কালই তাকে ছয় পাহাড়ের সব চেয়ে উঁচু পাহাড়ে নিয়ে যেতে হবে । এবং সেখানে আপনি এবং আমি ছাড়া আর কেউ যেতে পারবে না ।
দাইয়ের কাছ থেকে রাজকন্যাকে ফিরিয়ে আনা এত সহজ ছিল না । তাকে রাজ্যের একটি গ্রাম লিখে দিতে হল ।
সকাল বেলায় যখন রাজকন্যা ঘোড়ার জুরি গাড়িতে এসে পৌছাল রাজবাড়ীতে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল । তিন বছর বয়সী রাজকন্যা যেন ছোট একটা ডানাকাটা পরী। মুখের আধো আধো বোল আর খিল খিল হাসিতে মুখরিত রাজ প্রাসাদ । রাজা রাজকন্যাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন ।
বিকেলেই রাজা আর রানী তাকে ছয় পাহাড়ের সবচেয়ে উঁচু পাহাড়টাতে নিয়ে গেলেন ।
দূর থেকে রাজ প্রাসাদ দেখা যাচ্ছিল। পুরো রাজ্যকে মনে হচ্ছিল ঝলসানো এক নগরী। মকু রাজার মনের অনুতাপ আর পাপবোধ কয়েক ফোটা অশ্রু হয়ে গড়িয়ে পড়ল ।
কিছুক্ষণ পর রাজা অবাক হয়ে দেখলেন রাজবাড়ীর দিক থেকে অসংখ্য মেঘের দল ধেয়ে পাহাড়ের দিকে আসছে। রাজকন্যা পাহাড়ের উপর পাথরে পাথরে দৌড়ে খেলে বেড়াচ্ছিল ।
রাজা আর রানী অত্যন্ত অবাক হয়ে দেখলেন প্রত্যেকটি পাথরের উপর থেকে যখন রাজকন্যা দৌড়ে যাচ্ছে পাথরের নিচ থেকে ঠিকরে বের হচ্ছে জলধারা । সেই জলধারাগুলো একত্রিত হয়ে গড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে নিচে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রচণ্ড গতিতে নিচে নেমে এল এক পাহাড়ি ঝর্ণা ।আর তার পানি নদী হয়ে বইতে শুরু করল পাহাড়ের নিচ দিয়ে । স্বচ্ছ , টলটলে তার জল ।
রাজবাড়ীতে ফিরে এলেন তারা । রাজবাড়ী থেকেও শোনা যাচ্ছিল ঝর্ণার শব্দ । রাত্রেই মেঘ ডাকতে শুরু করল । ঝম ঝম করে নেমে এল বৃষ্টি । বৃষ্টি আর ঝর্ণার শব্দে রাজকন্যাকে বুকে জড়িয়ে শান্তিতে ঘুমিয়ে গেলেন রানী। এমন শান্তির ঘুম রাজা বহুদিন ঘুমাননি ।
রাজকন্যার নাম রাখলেন ইরাবতী। নদীর নামও তাই। কিছুদিনের মধ্যেই সবুজ শস্য শ্যামলে ভরে গেল ছয় পাহাড়ের অঞ্চল। মেঘেরাও ফাঁকি দিল না আর। মুকু রাজার রাজ্য আবার সুখ শান্তিতে ভরে উঠল ।
ইরাবতী খিল খিলিয়ে ঘরময় ঘুরে বেড়ায় । আর রাজা রানীকে বলে ;
কন্যা সে তো শুধু কন্যা নয় ,
পাহাড়ি পাথরে পায়ের ছোঁয়ায় জলের নহর বয় ।
উৎসর্গঃ
আমাদের শিশুদের মধ্য থেকে রুপকথা পড়ার অভ্যাস একদম হারিয়ে গেছে । কিন্তু রুপকথা না পড়লে কল্পনার জগত তৈরি হবে কিভাবে ? তাই এ লেখার ক্ষুদ্র প্রয়াস ।
গল্পটি প্রিয় ব্লগার হাসান মাহবুব ভাইকে উৎসর্গ করলাম। আশা করি তিনি এক পূর্ণিমা রাতে তার শিশুকে গল্পটি পড়ে শোনাবেন ।