somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

মৌতাত গোস্বামী শন্তু
একজন মানুষ হিশেবে সৎ, নির্লোভ, সত্যান্বেষী, সত্যবাদী হওয়াটা জরুরী হয়ে পরে বিশ্বমানবতার জন্য, সমাজের জন্য।একজন মানুষ হিশেবে সৎ, নির্লোভ, সত্যান্বেষী, সত্যবাদী হওয়াটা জরুরী হয়ে পরে বিশ্বমানবতার জন্য, সমাজের জন্য।

রফিক আজাদের কবিতা

২৪ শে মার্চ, ২০১৬ সকাল ৯:২১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ভাতদে হারামজাদা

ভীষণ ক্ষুধার্ত আছিঃ উদরে, শরীরবৃত্ত ব্যেপে
অনুভূত হতে থাকে- প্রতিপলে- সর্বগ্রাসী ক্ষুধা
অনাবৃষ্টি- যেমন চৈত্রের শষ্যক্ষেত্রে- জ্বেলে দ্যায়
প্রভুত দাহন- তেমনি ক্ষুধার জ্বালা, জ্বলে দেহ
দু’বেলা দু’মুঠো পেলে মোটে নেই অন্য কোন দাবী
অনেকে অনেক কিছু চেয়ে নিচ্ছে, সকলেই চায়ঃ
বাড়ি, গাড়ি, টাকা কড়ি- কারো বা খ্যাতির লোভ আছে
আমার সামান্য দাবী পুড়ে যাচ্ছে পেটের প্রান্তর-
ভাত চাই- এই চাওয়া সরাসরি- ঠান্ডা বা গরম
সরু বা দারুণ মোটা রেশনের লাল চাল হ’লে
কোনো ক্ষতি নেই- মাটির শানকি ভর্তি ভাত চাইঃ
দু’বেলা দু’মুঠো পেলে ছেড়ে দেবো অন্য-সব দাবী;
অযৌক্তিক লোভ নেই, এমনকি নেই যৌন ক্ষুধা
চাইনিতোঃ নাভি নিম্নে পরা শাড়ি, শাড়ির মালিক;
যে চায় সে নিয়ে যাক- যাকে ইচ্ছা তাকে দিয়ে দাও
জেনে রাখোঃ আমার ওসবের কোনো প্রয়োজন নেই।
যদি না মেটাতে পারো আমার সামান্য এই দাবী
তোমার সমস্ত রাজ্যে দক্ষযজ্ঞ কাণ্ড ঘ’টে যাবে
ক্ষুধার্তের কাছে নেই ইষ্টানিষ্ট, আইন কানুন-
সম্মুখে যা কিছু পাবো খেয়ে যাবো অবলীলাক্রমেঃ
থাকবে না কিছু বাকি- চলে যাবে হা ভাতের গ্রাসে।
যদি বা দৈবাৎ সম্মুখে তোমাকে ধরো পেয়ে যাই-
রাক্ষুসে ক্ষুধার কাছে উপাদেয় উপাচার হবে।
সর্বপরিবেশগ্রাসী হ’লে সামান্য ভাতের ক্ষুধা
ভয়াবহ পরিণতি নিয়ে আসে নিমন্ত্রণ করে।

দৃশ্য থেকে দ্রষ্টা অব্দি ধারাবাহিকতা খেয়ে ফেলে
অবশেষে যথাক্রমে খাবো : গাছপালা, নদী-নালা
গ্রাম-গঞ্জ, ফুটপাত, নর্দমার জলের প্রপাত
চলাচলকারী পথচারী, নিতম্ব প্রধান নারী
উড্ডীন পতাকাসহ খাদ্যমন্ত্রী ও মন্ত্রীর গাড়ী
আমার ক্ষুধার কাছে কিছুই ফেলনা নয় আজ
ভাত দে হারামজাদা,
তা না হলে মানচিত্র খাবো:


প্রতীক্ষা

এমন অনেক দিন গেছে
আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থেকেছি,
হেমন্তে পাতা-ঝরার শব্দ শুনবো ব’লে
নিঃশব্দে অপেক্ষা করেছি বনভূমিতে-
কোনো বন্ধুর জন্যে
কিংবা অন্য অনেকের জন্যে
হয়তো বা ভবিষ্যতেও অপেক্ষা করবো…
এমন অনেক দিনই তো গেছে
কারো অপেক্ষায় বাড়ি ব’সে আছি-
হয়তো কেউ বলেছিলো, “অপেক্ষা ক’রো
একসঙ্গে বেরুবো।”

এক শনিবার রাতে খুব ক্যাজুয়ালি
কোনো বন্ধু ঘোরের মধ্যে গোঙানির মতো
উচ্চারণ করেছিলো, “বাড়ি থেকো
ভোরবেলা তোমাকে তুলে নেবো।”
হয়তো বা ওর মনের মধ্যে ছিলো
চুনিয়া অথবা শ্রীপুর ফরেস্ট বাংলো;
-আমি অপেক্ষায় থেকেছি।

যুদ্ধের অনেক আগে
একবার আমার প্রিয়বন্ধু অলোক মিত্র
ঠাট্টা ক’রে বলেছিলো,
“জীবনে তো কিছুই দেখলি না
ন্যুব্জপীঠ পানশালা ছাড়া। চল, তোকে
দিনাজপুরে নিয়ে যাবো
কান্তজীর মন্দির ও রামসাগর দেখবি,
বিরাট গোলাকার চাঁদ মস্ত খোলা আকাশ দেখবি,
পলা ও আধিয়ারদের জীবন দেখবি,
গল্প-টল্প লেখার ব্যাপারে কিছু উপাদান
পেয়ে যেতেও পারিস,
তৈরী থাকিস- আমি আসবো”
-আমি অপেক্ষায় থেকেছি;

আমি বন্ধু, পরিচিত-জন, এমনকি- শত্রুর জন্যেও
অপেক্ষায় থেকেছি,
বন্ধুর মধুর হাসি আর শত্রুর ছুরির জন্যে
অপেক্ষায় থেকেছি-

কিন্তু তোমার জন্য আমি অপেক্ষায় থাকবো না,
-প্রতীক্ষা করবো।
‘প্রতীক্ষা’ শব্দটি আমি শুধু তোমারই জন্যে খুব যত্নে
বুকের তোরঙ্গে তুলে রাখলাম,
অভিধানে শব্দ-দু’টির তেমন কোনো
আলাদা মানে নেই-
কিন্তু আমরা দু’জন জানি
ঐ দুই শব্দের মধ্যে পার্থক্য অনেক,
‘অপেক্ষা’ একটি দরকারি শব্দ—
আটপৌরে, দ্যোতনাহীন, ব্যঞ্জনাবিহীন,
অনেকের প্রয়োজন মেটায়।
‘প্রতীক্ষা’ই আমাদের ব্যবহার্য সঠিক শব্দ,
ঊনমান অপর শব্দটি আমাদের ব্যবহারের অযোগ্য,
আমরা কি একে অপরের জন্যে প্রতীক্ষা করবো না ?

আমি তোমার জন্যে পথপ্রান্তে অশ্বত্থের মতো
দাঁড়িয়ে থাকবো-
ঐ বৃক্ষ অনন্তকাল ধ’রে যোগ্য পথিকের
জন্যে প্রতীক্ষমান,
আমাকে তুমি প্রতীক্ষা করতে বোলো
আমি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকবো অনড় বিশ্বাসে,
দাঁড়িয়ে থাকতে-থাকতে
আমার পায়ে শিকড় গজাবে…

আমার প্রতীক্ষা তবু ফুরোবে না…



তোমার দু’চোখ শুধু জেগে থাকে

তোমার দু’চোখ শুধু জেগে থাকে, অন্য কিছু নয়—
নিভে গেছে সকল প্রদীপ, সভ্যতার সূর্যাস্তের
পর চারদিক বড়বেশি শুনশান—উড়ে গেছে
‘মূল্যবোধ’-নাম্নী সংরক্ষিত গ্রন্থের সকল পাতা—
পৃথিবীর মূল্যবান গ্রন্থগুলি সফেদ কাগজ
ছাড়া আর কিছু নয়—বন্ধুত্বের সর্বশেষ রজ্জু
ছিন্নভিন্ন, বিশ্বস্ত ব্যাংকের ভল্ট থেকে সঙ্গোপনে
উধাও হয়েছে শেষ সোনাদানা, কংক্রিটের শক্ত
বাড়িগুলি লন্ডভন্ড, মুখ থুবড়ে প’ড়ে আছে সব
পথের ওপরে—সবকিছু বিনষ্ট, বিধ্বস্ত, দগ্ধ…
চতুর্দিকে আহাজারি—ধ্বংসযজ্ঞ ঘ’টে গেছে ক্ষুদ্র
এই গ্রহটিতে অকস্মাৎ—আমারও অস্তিত্ব ঘিরে
চারপাশে ঝ’রে যায় হলুদ পত্রালি—সবুজের
সমারোহ নেই—সশব্দে উপড়ে যাচ্ছে গাছপালা
ঘূর্ণিঝড়ে, প্রচণ্ড তাণ্ডবে ছিন্নভিন্ন লতাগুল্ম,
পশু ও শিশুর কান্না একাকার হ’য়ে বাজে কানে,
অনিবার্য অগ্নিকাণ্ড ঘ’টে যাচ্ছে লোকালয়জুড়ে,
সবগুলি গ্রাম আর গৃহস্থের বিন্যস্ত আকাশ,
সব—সবকিছু—লেলিহান শিখার সম্মুখে নত—
ক্ষেত-খামারের থেকে শুরু ক’রে সমুদ্র অবধি
মানুষের দগ্ধ হাতে প’ড়ে দূষিত হয়েছে খুব,
সিংহাসন থেকে শুরু ক’রে তার রান্নাঘর-অব্দি
মানুষ নিজের হাতে, খেলাচ্ছলে, পুড়িয়ে দিয়েছে!
অনিবার্য অগ্নিকাণ্ড ঘ’টে যায় লোকালয়জুড়ে,
অন্য কিছু নয়—জেগে থাকে শুধু তোমার দুচোখ


নগর ধ্বংসের আগে

নগর বিধ্বস্ত হ’লে, ভেঙ্গে গেলে শেষতম ঘড়ি
উলঙ্গ ও মৃতদের সুখে শুধু ঈর্ষা করা চলে।
‘জাহাজ, জাহাজ’ – ব’লে আর্তনাদ সকলেই করি –
তবুও জাহাজ কোনো ভাসবে না এই পচা জলে।

সমুদ্র অনেক দূর, নগরের ধারে-কাছে নেই :
চারপাশে অগভীর অস্বচ্ছ মলিন জলরাশি।
রক্ত-পুঁজে মাখামাখি আমাদের ভালবাসাবাসি;
এখন পাবো না আর সুস্থতার আকাঙ্খার খেই।

যেখানে রয়েছো স্থির – মূল্যবান আসবাব, বাড়ি;
কিছুতে প্রশান্তি তুমি এ-জীবনে কখনো পাবে না।
শব্দহীন চ’লে যাবে জীবনের দরকারী গাড়ি –
কেননা, ধ্বংসের আগে সাইরেন কেউ বাজাবে না।

প্রোথিত বৃক্ষের মতো বদ্ধমূল আমার প্রতিভা –
সাধ ছিল বেঁচে থেকে দেখে যাবো জিরাফের গ্রীবা।।


নত হও, কুর্নিশ করো

হে কলম, উদ্ধত হ’য়ো না, নত হও, নত হতে শেখো,
তোমার উদ্ধত আচরনে চেয়ে দ্যাখো, কী যে দু:খ
পেয়েছেন ভদ্রমহোদয়গণ,

অতএব, নত হও, বিনীত ভঙিতে করজোড়ে
ক্ষমা চাও, পায়ে পড়ো, বলো: কদ্যপি এমনটি হবে না, স্যার,
বলো: মধ্যবিত্ত হে বাঙালী ভদ্রমহোদয়গণ,
এবারকার মতো ক্ষমা করে দিন…

বলো হে কলম, হে বলপেন, হে আমার বর্বর প্রকাশ-ভঙিমা-
এই নাকে খত দিচ্ছি আর কখনো গালমন্দ পারবো না,
আপনাদের ভন্ডামিকে শ্রদ্ধা করতে শিখবো,
আপনাদের অপমান হজম করার অপরিসীম ক্ষমতাকে সম্মান করবো,
আর কোনদিন এমনটি হবে না, হে মহামান্য মধ্যবিত্ত রুচিবোধ,
আপনাদের মতো সব অপমান হ’জম করে, এখন থেকে,
নাইট সয়েল বানিয়ে ফেলে দেবো শরীরের বাইরে-
হে বন্য লেখনী, হে অমোচনীয় কালি, হে ইতর বলপেন,
নত হও, নত হতে শেখ..
শান্ত হও, ভদ্র হও ভদ্রলোকের মতো
আড়াল করতে শেখো অপ্রিয় সত্যকে,
প্রিয় মিথ্যা বলা শিখে নাও, বিক্রি করে দাও তোমার বিবেক-
উচ্চারন কোরো না এমন শব্দ, যা শুনে আহত হবেন তাঁরা-
নত হও, নত হ’তে শেখ;
তোমার পেছনে রয়েছে যে পবিত্র বর্বর মন ও মস্তিস্ক
তাকে অনুগত দাসে পরিণত হ’তে বলো,
হে আমার অবাধ্য কলম, ক্রোধ সংবরণ করো,
ভদ্রলোকের মতো লেখো, ভদ্রলোকদের দ্্বারে ধর্না দিও-
শিখে নাও সাজানো-গোছানো প্রভুপ্রিয় বাক্যাবলি…

হে কলম, এইবার নত হও, নতজানু হও,
শিখে নাও শিক্ষিত শিম্পানজিদের আচরন-বিধি,
অতএব, নত হও, নত হ’তে শেখো, নতজানু হও।।



যদি ভালবাসা পাই


যদি ভালবাসা পাই আবার শুধরে নেব
জীবনের ভুলগুলি
যদি ভালবাসা পাই ব্যাপক দীর্ঘপথে
তুলে নেব ঝোলাঝুলি
যদি ভালবাসা পাই শীতের রাতের শেষে
মখমল দিন পাব
যদি ভালবাসা পাই পাহাড় ডিঙ্গাবো
আর সমুদ্র সাঁতরাবো
যদি ভালবাসা পাই আমার আকাশ হবে
দ্রুত শরতের নীল
যদি ভালবাসা পাই জীবনে আমিও পাব
মধ্য অন্তমিল।



লোকটি তবে কবি ছিলো?

সুখে তারও লোভ ছিলো -চিরকাল অ-সুখে ভুখেছে!
মাথার অসুখ ছিলো, লোকটির -বুকের, দাঁতের-
নিত্যসঙ্গী গিঁটেবাত, হাঁটতো তাই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে;
শেষদিকে শ্বাসকষ্ট -নিঃশ্বাসের জন্যে একবুক
বাতাসও তা ভাগ্যে বরাদ্দ ছিলো না! -লোকটির
শরীরে অসুখ ছিল নানা -এজন্যে সে আজীবন
লাঞ্চিত হয়েছে আর অপমান সয়েছে অনেক!
সমাজও ছিলো না তার, বলতে গেলে, সামান্য প্রভাবও;
লোকটির কোনো গুণই, কোনদিন, সমাজ দ্যাখেনি।

শরীরে অসুখ ছিল -ছিলো না চোখের কোনো দোষ,
এবং জিহ্বাও তার অসম্ভব অনাড়ষ্ট ছিলো …

শেষোক্ত দোষের জন্যে লোকটির মৃত্যুদন্ড হয়।।



ভালোবাসার সংজ্ঞা

ভালোবাসা মানে দুজনের পাগলামি,
পরস্পরকে হৃদয়ের কাছে টানা;
ভালোবাসা মানে জীবনের ঝুঁকি নেয়া,
বিরহ-বালুতে খালিপায়ে হাঁটাহাঁটি;
ভালোবাসা মানে একে অপরের প্রতি
খুব করে ঝুঁকে থাকা;
ভালোবাসা মানে ব্যাপক বৃষ্টি, বৃষ্টির একটানা
ভিতরে-বাহিরে দুজনের হেঁটে যাওয়া;
ভালোবাসা মানে ঠাণ্ডা কফির পেয়ালা সামনে
অবিরল কথা বলা;
ভালোবাসা মানে শেষ হয়ে-যাওয়া কথার পরেও
মুখোমুখি বসে থাকা।



যাও, পত্রদূত

যাও পত্রদূত, বোলো তার কানে-কানে মৃদু স্বরে
সলজ্জ ভাষায় এই বার্তা: “কোমল পাথর, তুমি
সুর্যাস্তের লাল আভা জড়িয়ে রয়েছো বরতনু;
প্রকৃতি জানে না নিজে কতোটা সুন্দর বনভূমি।”
যাও, বোলো তার কানে ভ্রমরসদৃশ গুঞ্জরণে,
চোখের প্রশংসা কোরো, বোলো সুঠাম সুন্দর
শরীরের প্রতি বাঁকে তার মরণ লুকিয়ে আছে,
অন্য কেউ নয়, সে আমার আকণ্ঠ তৃষ্ণার জল:
চুলের প্রশংসা কোরো, তার গুরু নিতম্ব ও বুক
সবকিছু খুব ভালো, উপরন্তু, হাসিটি মধুর!

যাও পত্রদূত, বোলো “হে মাধবী, কোমল পাথর,
দাঁড়াও সহাস্য মুখে সুদূর মধুর মফঃস্বলে!
বিনম্র ভাষায় বোলো, “উপস্থিতি খুবই তো উজ্জ্বল,
যুক্তিহীন অন্ধ এক আবেগের মধ্যে, বেড়াজালে,
আবদ্ধ হয়েছো উভয়েই, পরস্পর নুয়ে আছো
একটি নদীর দিকে—বোলো তাকে, “অচ্ছেদ্য বন্ধন
ছিঁড়ে ফেলা সহজ তো নয় মোটে, কোমল পাথর!”
যাও পত্রদূত, বোলো—ভালোবাসা গ্রীষ্মের দুপুর?
নীরব দৃষ্টির ভাষা-বিনিময়—দিগন্ত সুদূর?



তোমার কথা ভেবে

তোমার কথা ভেবে রক্তে ঢেউ ওঠে—
তোমাকে সর্বদা ভাবতে ভালো লাগে,
আমার পথজুড়ে তোমারই আনাগোনা—
তোমাকে মনে এলে রক্তে আজও ওঠে
তুমুল তোলপাড় হূদয়ে সর্বদা…
হলো না পাশাপাশি বিপুল পথ-হাঁটা,
এমন কথা ছিল চলব দুজনেই
জীবন-জোড়া পথ যে-পথ দিকহীন
মিশেছে সম্মুখে আলোর গহ্বরে…


চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া

স্পর্শকাতরতাময় এই নাম
উচ্চারণমাত্র যেন ভেঙে যাবে,
অন্তর্হিত হবে তার প্রকৃত মহিমা,-
চুনিয়া একটি গ্রাম, ছোট্ট কিন্তু ভেতরে-ভেতরে
খুব শক্তিশালী
মারণাস্ত্রময় সভ্যতার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে।

মধ্যরাতে চুনিয়া নীরব।
চুনিয়া তো ভালোবাসে শান্তস্নিগ্ধ পূর্ণিমার চাঁদ,
চুনিয়া প্রকৃত বৌদ্ধ-স্বভাবের নিরিবিলি সবুজ প্রকৃতি;
চুনিয়া যোজনব্যাপী মনোরম আদিবাসী ভূমি।
চুনিয়া কখনো কোনো হিংস্রতা দ্যাখেনি।
চুনিয়া গুলির শব্দে আঁতকে উঠে কি?
প্রতিটি গাছের পাতা মনুষ্যপশুর হিংস্রতা দেখে না-না ক’রে ওঠে?
– চুনিয়া মানুষ ভালোবাসে।

বৃক্ষদের সাহচার্যে চুনিয়াবাসীরা প্রকৃত প্রস্তাবে খুব সুখে আছে।
চুনিয়া এখনো আছে এই সভ্যসমাজের
কারু-কারু মনে,
কেউ-কেউ এখনো তো পোষে
বুকের নিভৃতে এক নিবিড় চুনিয়া।

চুনিয়া শুশ্রুষা জানে,
চুনিয়া ব্যান্ডেজ জানে, চুনিয়া সান্ত্বনা শুধু-
চুনিয়া কখনো জানি কারুকেই আঘাত করে না;
চুনিয়া সবুজ খুব, শান্তিপ্রিয়- শান্তি ভালোবাসে,
কাঠুরের প্রতি তাই স্পষ্টতই তীব্র ঘৃণা হানে।
চুনিয়া গুলির শব্দ পছন্দ করে না।

রক্তপাত, সিংহাসন প্রভৃতি বিষয়ে
চুনিয়া ভীষণ অজ্ঞ;
চুনিয়া তো সর্বদাই মানুষের আবিষ্কৃত
মারণাস্ত্রগুলো
ভূমধ্যসাগরে ফেলে দিতে বলে।
চুনিয়া তো চায় মানুষের তিনভাগ জলে
রক্তমাখা হাত ধুয়ে তার দীক্ষা নিক্।
চুনিয়া সর্বদা বলে পৃথিবীর কুরুক্ষেত্রগুলি
সুগন্ধি ফুলের চাষে ভ’রে তোলা হোক।

চুনিয়ারও অভিমান আছে,
শিশু ও নারীর প্রতি চুনিয়ার পক্ষপাত আছে;
শিশুহত্যা, নারীহত্যা দেখে-দেখে সেও
মানবিক সভ্যতার প্রতি খুব বিরূপ হয়েছে।

চুনিয়া নৈরাশ্যবাদী নয়, চুনিয়া তো মনেপ্রাণে
নিশিদিন আশার পিদ্দিম জ্বেলে রাখে।
চুনিয়া বিশ্বাস করে:
শেষাবধি মানুষেরা হিংসা-দ্বেষ ভুলে
পরস্পর সৎপ্রতিবেশী হবে।।



বৃষ্টি

খররৌদ্রময় এই দিন—
শ্যামল বাংলায় বুঝি ফের নেমে আসে খরা!
খরতাপে রুদ্ধশ্বাসক্ষুদ্র এই গ্রামীণ শহর,
এ রকম এই দিনে চেতনায়ও খরার প্রদাহ—
নির্বাচনে হেরে-যাওয়া প্রার্থী যেন: বিরক্ত, বিব্রত;
এ রকম দুঃসময়ে এল বৃষ্টির শব্দের মতো
সুখকর এই পত্র—প্রাগের প্রাচীর থেকে উড়ে!
কুপিত, বিব্রতকর এই রোদে খামটি খুলিনি;
আমি তো অপেক্ষা জানি: এই খররৌদ্রে কখনো কি
প্রিয় বান্ধবীর লেখা চিঠি খোলা চলে?
অতএব, রেখে দিই যত্ন করে নিজস্ব ড্রয়ারে!
১১ জুলাই রাতে অকস্মাৎ বৃষ্টি নেমে এল
যেন দীর্ঘদিন পর হঠাৎ হারিয়ে-যাওয়া আমার সন্তান
ঘরে ফিরে এল।
বাইরে এখন বৃষ্টি,
বৃষ্টির স্নিগ্ধতা বহু দিন পর যেন
আমার হূদয়ে প্রীত মধ্যযুগ ভরে দিয়ে গেল!

এখনো বাইরে বৃষ্টি: জানালায় জলের প্রপাত—
এই বুঝি প্রকৃষ্ট সময় যখন প্রশান্ত মন,
হূদয়ে যখন আর খেদ নেই কোনো, ভারাতুর
নয় আর মন, ক্রোধ নেই, ঘৃণা নেই—অবিশ্বাস্য
শান্তিপ্রিয় আজ এই মাঞ্চুরীয় রাখাল বালক;
হূদয়ে কোনোই শোক নেই—শোকানুভূতিও নেই—
অসম্ভব শান্ত আজ—সমাহিত—আমার হূদয়!
নষ্ট করে ফেলে-দেয়া জীবনের জন্য নেই কোনো
শোচনা ও তাপ;—বৃষ্টির সৌগন্ধে ভরে আছে মন!
মনে হচ্ছে আমার মতন সুখী কেউ নেই আর
পৃথিবীর কোনো প্রান্তে ১১ জুলাই এই রাতে!

২.
এখন আপনার চিঠি খোলা যায় এই পরিবেশে:
এ কী করেছেন! খামে ভরে কেউ কারুকে পাঠায়
গোবি-সাহারার দীর্ঘ হাহাকার, চীনের প্রাচীর?
স্তব্ধ হয়ে থাকি চিঠি পড়ে: সারাটা দুনিয়া জুড়ে
মানুষের এত দুঃখ—এর থেকে পরিত্রাণ নেই?
—বৃষ্টির প্রপাত শুনে, গাছের সবুজে চোখ রেখে
শিশুদের গালে চুমো খেয়ে আমরা পারি না ফের
এই দুঃখী গ্রহটির অন্তর্গত অসুখ সারাতে?



জীবন একটি নদীর নাম


জীবন একটি নদীর নাম,
পিতামাতার ঐ উঁচু থেকে
নেমে-আসা এক পাগলা ঝোরা—
ক্রমশ নিম্নাভিমুখী;
পাথুরে শৈশব ভেঙে
কৈশোরের নুড়িগুলি বুকে নিয়ে
বয়ে চলা পরিণামহীন
এক জলধারা—
গাঙ্গেয় ব-দ্বীপে বেলে-এঁটেল-দোআঁশ
মাটি ভেঙে-ভেঙে সামনে চলা
এক ক্ষুদ্র স্রোতস্বিনী;
এই বয়ে চলা পথে
বিভিন্ন বৃক্ষের সঙ্গে চলে
দ্বিরালাপ;
একবার এক বৃদ্ধ অশ্বথের সঙ্গে
হয় তার অল্পক্ষণ স্থায়ী
আদাব-সালাম বিনিময়,
তাকে বলেছিলো সেই বুড়ো:
“এ্যাতো তাড়াহুড়ো করো না হে,
ধীরে বয়ে যাও, তোমার চলার পথে
পড়বে অনেক বৃক্ষ— সবুজ, সতেজ—
তাদের শাখায় আছে পাখিদের প্রিয় ঘরবাড়ি,
পাখিদের শাবকেরা আছে— তাদের রয়েছে খুব
নরম পালক,
যেন ঐ বৃক্ষ আর তার আশ্রিতজনের
কোনো ক্ষতি না হয় তোমার দ্বারা;
যদি পারো ঊষর মাটির মধ্য দিয়ে
বয়ে যেয়ো, সর্বদা এড়িয়ে যেয়ো
পাখির নিবাস…
আমি তাকে কোনো কথাই পারিনি দিতে;
নদীর ধর্ম তো অবিরাম বয়ে চলা,
বহমান তার স্রোতধারা ভেঙে নিয়ে চলে
পাড়ের সমৃদ্ধ মাটি,
গৃহস্থের আটচালা, মাটির উনুন,
প্রবীণ লাঙল, ধানী মরিচের টাল,
তরমুজের ক্ষেত, পোষা বেড়ালের মিউ,
ফলবান বৃক্ষের বাগান, কাঁথা ও বালিশসহ সম্পন্ন সংসার।
তেমন আহ্লাদ নেই তার ভেঙে ফেলতে দু’পাড়ের
সোনার সংসার;
সে তো খুব মনস্তাপে পোড়ে,
নিরুপায় অশ্রুপূর্ণ চোখে
দীর্ঘশ্বাস চেপে সে-ও দু’পাড়ে তাকায়:
এক পাড়ে দাঁড়ানো নারীকে বাঁচাতে গিয়ে
অপর পাড়ের নিরুদ্বিগ্ন পাখিদের বাসা
তছনছ করে ছোটে,
তাকে তো ছুটতে হয়, সে যে নিরুপায়
তার কষ্ট থাকে তার বুকে;
তারও বুক ভেঙে যেতে পারে— বুকভাঙা অভিজ্ঞতা
তারও তো রয়েছে— থাকতে পারে, থাকে…
সে কথা ক’জন জানে।
নদীকে তোমরা জানো ভাঙচুরের সম্রাট!
দু’কূল-ছাপানো তার আবেগে উদ্বেল
পলি তোমাদের জীবনে কি এনে দ্যায়নি কখনো
শস্যের সম্ভার?



- মুক্তিযোদ্ধা, কবি ও সংগ্রামী সাহিত্যিকের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মার্চ, ২০১৬ সকাল ৯:২১
৯টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুরসি নাশিন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:১৫


সুলতানি বা মোগল আমলে এদেশে মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল৷ আশরাফ ও আতরাফ৷ একমাত্র আশরাফরাই সুলতান বা মোগলদের সাথে উঠতে বসতে পারতেন৷ এই আশরাফ নির্ধারণ করা হতো উপাধি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন আর আদর্শ কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৭

তার বিশেষ কিছু উক্তিঃ

১)বঙ্গবন্ধু বলেছেন, সোনার মানুষ যদি পয়দা করতে পারি আমি দেখে না যেতে পারি, আমার এ দেশ সোনার বাংলা হবেই একদিন ইনশাল্লাহ।
২) স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যাবে যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

কৃষ্ণচূড়া আড্ডার কথা

লিখেছেন নীলসাধু, ১৯ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:০২



গতকাল পূর্ব নির্ধারিত কৃষ্ণচূড়ায় আড্ডায় মিলিত হয়েছিলাম আমরা।
বছরের একটি দিন আমরা গ্রীষ্মের এই ফুলটির প্রতি ভালোবাসা জানিয়ে প্রকৃতির সাথে থাকি। শিশুদের নিয়ে গাছগাছালি দেখা, ফুল লতা পাতা চেনাসহ-... ...বাকিটুকু পড়ুন

সকাতরে ঐ কাঁদিছে সকলে

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২৯

সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে, শোনো শোনো পিতা।

কহো কানে কানে, শুনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গলবারতা।।

ক্ষুদ্র আশা নিয়ে রয়েছে বাঁচিয়ে, সদাই ভাবনা।

যা-কিছু পায় হারায়ে যায়,... ...বাকিটুকু পড়ুন

বসন্ত বিলাসিতা! ফুল বিলাসিতা! ঘ্রাণ বিলাসিতা!

লিখেছেন নাজনীন১, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:০৯


যদিও আমাদের দেশে বসন্ত এর বর্ণ হলুদ! হলুদ গাঁদা দেখেই পহেলা ফাল্গুন পালন করা হয়।

কিন্তু প্রকৃতিতে বসন্ত আসে আরো পরে! রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া এদের হাত ধরে রক্তিম বসন্ত এই বাংলার!

ঠান্ডার দেশগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×