(মেলাঘরের প্রশিক্ষন ক্যাম্পের কিশোর গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি)
ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের একটি থানা মতিনগর। এখানেই প্রথম স্থাপিত করা হয় মুক্তিযুদ্ধের দুই নম্বর সেক্টরের অস্থায়ী সদর দপ্তর। পাকিস্তানী ফিল্ড আর্টিলারী ফায়ারের আওতার ভেতরে থাকায় প্রায়ই পাকিস্তানী আর্টিলারের গোলা এসে পড়তো মতিনগর এলাকায়। তাছড়া ভারতীয়দের সাথে তখনো সদর দপ্তর স্থাপনের স্থান নির্বাচন চূড়ান্ত হয়নি। পরবর্তীতে জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে ২ নম্বর সেকটরের সদর দপ্তর স্থান্তরিত করা হয় মতিনগর-ত্রিপুরা সড়কের পাশে ছোট ছোট পাহাড় ঘেরা বনাঞ্চল মেলাঘরে।
(মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ)
১৯৭১ এর সেপ্টেম্বর মাস। মেলাঘরের সদর দপ্তরে মেজর খালেদ(মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ), মেজর মতিন(মেজর জেনারেল এম এ মতিন) , এবং কেপ্টেন হায়দার(ক্যাপ্টেন এ টি এম হায়দার) কিছু একটা নিয়ে আলাপ করছেন। আলাপের মাঝখানে টেলিফোন বেজে উঠলো। মেজর খালেদ একটু বিরক্ত হয়ে টেলিফোনটি রিসিভ করলেন।ওপাশের কয়েক সেকেন্ডের কথা শুনেই তিনি বললেন; “সবাইকে চোখ বেঁধে রেখে দাও।” টেলিফোন রাখার পর আলোচনা চল্ল আরো প্রায় ঘন্টা দুয়েকের মত।আলোচনা শেষে তিনি মেজর কামরুল হাসানকে সাথে নিয়ে M-38 জিপে রওনা দিলেন কোনাবন ক্যাপ্টেন গফফারের সাব-সেক্টর সদর দপ্তরে। গাড়ি মেইন আর পি (Regimental Police) চেক পোস্ট পার হয়ে ১৫-২০ গজ পেরিয়ে গেছে।হঠাৎ মেজর খালেদ গাড়ি পেছাতে বললেন।তিনি গাড়ি থেকে নেমে আর পি চেক পোস্টের সামনে এসে দাড়ালেন যেখানে ৮/৯ জন চোখ বাঁধা অবস্থায় ১৪/১৫ বছরের কিশোরকে রাখা হয়েছিল।মেজর খালেদ আর পি হাবিলদারের কাছে জানতে চাইলেন; কেন এদের চোখ বেঁধে রাখা হয়েছে। হাবিলদার জানালো; স্যার আপনিইতো এদের চোখ বেঁধে রাখতে বলেছেন। মেজর খালেদের এবার হয়তো মনে পড়লো, আদেশ দিলেন ওদের চোখ খুলে দিতে। জিজ্ঞাসা করলেন ওদের, ওরা কি চায়। মুহুর্তের মধ্যে সবগুলো কিশোর ক্রোধে তাঁর উপর ফেটে পড়লো। এরা আর্মি চেনেনা, এরা মেজর চেনেনা, এরা সেক্টর কমান্ডার কি জানেনা। সবাই একসাথে চেচিয়ে উওঠলো, “আপনি আমাদের চোখ বাধার হুকুম দেবার কে? আপনার সাথে যুদ্ধ করতে না দিলে আমরা অন্য যায়গায় যুদ্ধ করবো। বাংলাদেশকি একাই আপনার?”
মেজর খালেদ হাঁসছেন। সে হাঁসির অর্থ আছে। সে হাঁসি আত্ববিশ্বাসের হাঁসি। সে হাসির অর্থ-এ প্রত্যয়ী জাতির যেভাবেই হোক, যতদিনেই হোক যুদ্ধে বিজয় অনিবার্য।এই কিশোরদের দিয়েই স্টুডেন্ট কোম্পানি এলাকায় সেদিনই সাময়িক ভাবে ১৮০ পাউন্ড তাবু লাগিয়ে তিনি তৈরী করলেন “ওয়াই প্লাটুন” (Young Platoon)। ২১ পাউন্ড ওজনের ব্রিটিশ ৩০৩ ব্রাউনিং (এলএমজি) এরা তুলতে পারত না ঠিকই, তার পরও এদের অসাধ্য এমন কিছুই ছিল না। এই ছেলেদের জন্য আলাদা ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হলো। কঠোর সে ট্রেনিং। পরিশ্রান্ত এই ছেলেদের কঠোর প্রশিক্ষণে কোনো আপত্তি নেই, ওরা বরং আগ্রহী। বুক ভরা সাহসী কিছু দুরন্ত কিশোর।
(প্রশিক্ষন ক্যাম্পে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা)
সীমান্ত এলাকা বক্সনগরে পাকিস্তানিদের প্রতিরক্ষা অবস্থান বাংলাদেশের ভেতরে। ওদের বাংকার, ওদের চলাফেরা দেখা যায়। কয়েক সপ্তাহ পর একদিন দিনের বেলায় মেজর খালেদ ছেলেদের নিয়ে গেলেন সেখানে। এই কিশোরদের তিনি পাকিস্তানি প্রতিরক্ষা অবস্থানের বাংকারগুলো দেখিয়ে বললেন, ‘যারা আমার সামনে শত্রুর ওই বাংকারগুলোতে গ্রেনেড ছুড়ে আসতে পারবে তাদের জন্য পুরস্কার এই ঘড়ি।’ অপারেশন খুবই ঝুকি পূর্ণ। তাঁর উপর আবার দিলের আলোতে।প্রতিরক্ষা এলাকায় এমনিতেই অনেক কড়া কড়ি থাকে। সেখানে কোনো বেসামরিক ব্যাক্তিকেই প্রবেশ করতে দেয়া হয় না, এটাই সামরিক শিক্ষা। ছেলেরা শুধু প্রতিরক্ষা এলাকাতেই প্রবেশ করবে তা নয়, তাঁদের শত্রুর বাংকার পর্যন্ত পৌছাতে হবে এবং সবাইকে একসাথে। এই ধরণের (দিনের রেইড) অপারেশন কেবল অভিজ্ঞ কমান্ডোদের দ্বারাই সফল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ছেলেদের কেউ শত্রু প্রতিরক্ষা অবস্থানে মারা গেলে বা ধরা পড়লে এদের মৃতদেহও পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। কারো কারো মা বাবা হয়তো জানেইনা এরা যুদ্ধে এসেছে। নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও এরা সামনে এগিয়ে গেল।গ্রামের ডান বাম দিয়ে অর্থাৎ শত্রুর প্রতিরক্ষার দুই পাশ দিয়ে আলাদা ভাবে ওরা গ্রামের ভেতর ঢুকে গেল।মেজর খালেদ তখনও নিশ্চল।তাঁর আস্থা আছে নিজের দেয়া প্রশিক্ষণ এবং দুরন্ত কৈশরের এই ছেলেদের উপর।তবুও উৎকণ্ঠায় প্রতিটি মুহূর্ত।
ঘড়ি পুরস্কারের জন্য নয়, অদম্য সাহস আর প্রবল দেশাত্মবোধই ছিল এই কিশোরদের। ভাবছেন খালেদ মোশাররফ বুঝি খুব নিষ্ঠুর প্রকৃতির মানুষ। মোটেও তা নয়।দিনের আলোয় সবার সামনে পাকিস্তানী ব্যাংকারগুলো প্রকম্পিত করে ধুলার আঁধার বানিয়ে ফেলল এরা। অপারেশন সাকসেস করে যখন ছেলেরা ফিরে এল, খালেদ অশ্রুসিক্ত চোখে ছেলেদের বুকে জড়িয়ে ধরলেন।যেন এক পিতা তাঁর সন্তানদের কাঁধে ওজন রেখে হাটতে শেখাচ্ছেন।মাত্রায় কে বড় তাঁর বিচারের কোনো অবকাশ নেই।
(মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফের একটি সাক্ষাৎকার)
এর কিছুদিন পর ওয়াই প্লাটুনে আরও কিছু ছেলে যোগ হলো। এদের বয়স আরও কম। এরা ক্লাস ফোর-ফাইভের ছাত্র। দুচোখ ভরা দুষ্টুমি। এদের আবাস ওয়াই প্লাটুনে হলেও লালমাটিয়ার আবদুল আজীজের (বীরপ্রতীক, ১০ অক্টোবর ১৯৯৯ সালে প্রয়াত) সামগ্রিক তত্ত্বাবধানে ওদের ন্যস্ত করা হয়, ট্রেনিংয়ের দায়িত্বসহ। ভারতের এই ক্যাম্পে এই শিশুদের কোনো আপনজন নেই। দুই পা এক করে স্থির হয়ে দাঁড়ানো ছিল এদের জন্য দুঃসাধ্য। দুটি চোখের মণি, দুটি হাত এবং দুটি পা সব সময়ই নড়ছে। এদের মধ্যে ঢাকার গ্রিন রোডের হাসান, প্রদীপ, শাহজাহান ছিল উল্লেখযোগ্য। ক্যাপ্টেন হায়দার আদর করে এদের নাম দিয়েছিলেন ‘ওয়াকিটকি (সহজে বহনযোগ্য স্বল্পদূরত্বে কথা বলার ছোট একধরনের বেতারযন্ত্র)। পরবর্তীতে ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় এরা বিরত্বের সাথে বিভিন্ন গেরিলা অপারেশনে অংশগ্রহণ করেন ।
তথ্য সূত্রঃ-
জনযুদ্ধের গণযোদ্ধা (মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়া)।
দৈনিক প্রথম আলো।
চিত্র- গুগল থেকে সংগ্রহীত।
ইউটিউব ভিডিও- অমি রহমান পিয়াল।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে মার্চ, ২০১৫ সকাল ১০:৫১