৫ ডিসেম্বর ১৯৫৬ তারিখে আলেগ্রিয়া ডি পিওতে আক্রান্ত হবার পর চে-র দল ফিদেল ক্যাস্ট্রোর সঙ্গে পুনর্মিলিত হয় ২১ ডিসেম্বরে । আহত চে গুয়েভারাসহ অন্যান্যদের দ্রুত চিকিৎসার পাশাপাশি চলতে থাকে সম্ভাব্য গেরিলা যুদ্ধের পরিকল্পনা এবং প্রস্ততি । অবশেষে ১৭ই জানুয়ারি ১৯৫৭ তারিখে লা প্লেটো যুদ্ধে বিদ্রোহী বাহিনী দখল করে নেয় ক্ষুদ্র একটি সেনা শিবির এবং সংহত করে তাদের অবস্থান । সে বছর মার্চের মধ্যে গ্রাম্য কৃষক আর শহুরে মধ্যবিত্ত তরুণ প্রজন্মের নতুন নতুন সদস্যদের যোগদানের মধ্য দিয়ে গেরিলা বাহিনী নতুনভাবে সংগঠিত হয় ।
ফিদেল তার যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুদের মাধ্যমে নিউইয়র্ক টাইমস এর এক সাংবাদিকের কাছে সাক্ষাৎকার দেন । যা প্রকাশের পর এই গেরিলা বাহিনীর অদম্য মনোভাব, বারবার বিপর্যয়ের পরও অবিরাম লড়াই এর বার্তা সারা বিশ্বের বিপ্লবীদের মধ্যে উদ্দীপনা সৃষ্টি করে এবং আতংকিত করে তোলে বাতিস্তা সহ মার্কিনীদের । ফিদেল ক্যাস্ট্রোর মনোভাব নিয়ে চে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “তার বিশ্বাস অসম্ভব ধরনের, যখন তিনি মেক্সিকো থেকে কিউবার উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন তখন অবশ্যই সেখানে পৌঁছাবেন, যখন সেখানে আছেন অবশ্যই যুদ্ধ করবেন আর যুদ্ধ যখন করবেন অবশ্যই জিতবেন” !
গেরিলারা ২২ জানুয়ারি ১৯৫৭ তারিখে সরকারি বাহিনীর একটি সেনা কলামের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে তাদের অনেক ক্ষতি সাধন করতে সক্ষম হয় । এরই মধ্যে ঘটে এক মর্মান্তিক ঘটনা । ছাত্র সংগঠন “স্টুডেন্ট ডিরেক্টরেট” এর বিদ্রোহী যোদ্ধারা হাভানায় প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের উপর বড় ধরনের আক্রমণ চালায় । আক্রমণ ব্যর্থ হয়, অল্পের জন্য প্রেসিডেন্ট বেঁচে যান এবং জোসে এন্তোনিও, ইচেভেরিয়াসহ অনেক ছাত্র ঐ অপারেশনে নিহত হয় । এরপর মে মাসের ২৭-২৮ তারিখে সিয়েরা মিয়েস্ত্রা-র এল ইউভেরো যুদ্ধে বিদ্রোহী বাহিনী বড় ধরনের বিজয় অর্জন করে । একটি শক্তিশালী সেনা গ্যারিসন তাদের দখলে চলে আসে । ঐ বছরের ৫ জুন তারিখে চে গুয়েভারা মেজর হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন এবং বিদ্রোহী বাহিনীর চতুর্থ সেনা কলামের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন ।
চে’র লেখা কবিতাঃ
‘চল যাই
এই অজানা পথে
সবুজ কুমির মুক্ত করি যাকে তুমি ভালোবাসো
আর চল যাই আমাদের কপাল থেকে
সব অপমানের দাগ মুছে ফেলি আমাদের গভীর বিদ্রোহের ধার দিয়ে
আমরা অবশ্যই করবো জয় নয়তো নেবো মৃত্যু
আর যদি লোহা এসে আমাদের পথে এসে দাঁড়ায়
আমেরিকান ইতিহাসের পথের যাত্রী
এই আমাদের গেরিলা হাড় ঢেকে দেবার জন্য
চাইব কিউবান অশ্রুর চাদর
এর বেশি কিছু নয়’ ।
(চে গুয়েভারা, ‘ফিদেলের জন্য গান’ থেকে)
যুদ্ধের শেষপর্ব সম্পর্কে ফিদেল ক্যাস্ট্রো বর্ণনা দিচ্ছেন এভাবেঃ
যুদ্ধের শেষপর্বে আমরা ছিলাম ৩ হাজার, যদিও নির্ধারক যুদ্ধটি করেছি ৩ শ’ জন । অন্যদিকে পাহাড়ে শেষ বড় আক্রমনে বাতিস্তা বাহিনীতে ছিল প্রায় ১০ হাজার । এই যুদ্ধ চলে ৭০ দিন । প্রায় ৩৫ দিন ধরে তারা একটানা আক্রমণ করে, এরপরের ৩৫ দিন ছিল আমাদের আক্রমণ । ফলাফল হল আমরা সবচাইতে ভালো একটি ব্যাটালিয়নকে ধ্বংস করলাম, আটক করলাম ৫ শ’ জন এবং মর্টার, বাজুকা ও ট্যাংকসহ বিপুল অস্ত্রসস্ত্র । আমাদের থিসিস হলঃ যদি কৃষক জনগণের সমর্থন থাকে এবং বিপ্লবী সামরিক নেতাদের কোন বড়ধরনের ভুল না হয় তাহলে কোন বিপ্লবী আন্দোলন বা গেরিলা আন্দোলনকেই পরাজিত করা সম্ভব নয়’ ।
নতুন বছরে বাতিস্তা সরকারের পতন এবং ফিদেলের মুসা যাত্রাঃ
মার্কিন সাংবাদিক লি লকওড তাঁর এক বন্ধুর অনুরোধে কিউবায় চলমান গেরিলা যুদ্ধ সম্পর্কে জানতে কিউবা হাজির হন ১৯৫৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর রাতে এবং ঘটনাক্রমে ক্ষুদ্রসংখক বিদেশির একজনে পরিণত হন যারা এক বিশাল ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হতে পেরেছিলেন । তাঁর লেখায় সেই ঐতিহাসিক দিনের বর্ণনাঃ ‘নতুন বছরে যে আনন্দ উল্লাস শুরু হয় তা অব্যাহত থাকে আটদিন । আনন্দ উল্লাসের সাথে সেইদিন চারিদিকে ছিল গুলির শব্দ । ফিদেল ক্যাস্ট্রোর বিদ্রোহী বাহিনী আর তাদের সাথে হাভানার মানুষেরা, যাদের প্রায় প্রত্যেকের হাতেই বন্দুক বা রাইফেল ছিল, বিভিন্ন কোণায় তারা বাতিস্তা বাহিনীর সাথে শেষ যুদ্ধ করছিলেন । দীর্ঘ পথ পেরিয়ে সিয়েগো দে আভিলা শহরে পেলাম ফিদেল ক্যাস্ট্রোকে । সেখান থেকে আমরা তাঁর সিয়েরা মেইস্ত্রা থেকে হাভানা পর্যন্ত দীর্ঘ ধীর এবং উল্লাস উচ্ছ্বাস ভরা যাত্রার পেছনে যুক্ত হলাম । প্রতিটি স্থানে সারাদিন ধরে মানুষ অপেক্ষা করেছে ফিদেলকে একনজর দেখবার জন্য । প্রতিটি প্রাদেশিক রাজধানীতে ফিদেল বক্তৃতা দিয়েছেন চার, পাঁচ, ছয় ঘণ্টা । কয়েকদিন পর ফিদেল যখন হাভানায় বক্তব্য রাখলেন প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের সামনে তখন সেখানে ৫ লক্ষ মানুষ । তারপর তিনি এক সময় নেমে এসে প্রবেশ করলেন জনসমুদ্রে । কোন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নেই, যেন সমুদ্রের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন । চারিদিকে চিৎকার ‘ফি-দেল’ ‘ফি-দেল’ । সামনের সমুদ্র সরে যাচ্ছে, ফিদেল এগিয়ে যাচ্ছেন আবার পেছনে সমুদ্র ভরাট হয়ে যাচ্ছে । এ যেন লোহিত সাগর ভেদ করে মুসা নবীর সেই অলৌকিক যাত্রা’…!
উৎসঃ
চে গুয়েভারার ডায়েরি
বিপ্লবের স্বপ্নভুমি কিউবা
উইকিপিডিয়া
উৎসর্গঃ নিভৃতচারী সেইসকল মানুষ যারা বাস্তবতার কষাঘাতে প্রতিনিয়ত জর্জরিত হয়েও অবিচল আস্থায় বাঁচিয়ে রেখেছেন তাদের অমূল্য বিবেক সম্বল ।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে আগস্ট, ২০১৪ দুপুর ১২:৫৪