সাত সকালে ঘুম ভেঙ্গে দরজা খুলতেই হাজেরাবুয়া নোটিস দিলো। তাকে আজ এক্ষুনি এই মুহুর্তে দেশের বাড়ি যেতেই হবে। তার একমাত্র পু্ত্র শয্যাগত। আজ সকালেই ফোন এসেছে তাকে নাকি বাস্না না মাস্না কি যেন করেছে তার শ্বাসুরবাড়ির লোকজন, তাই তাকে এখুনি সেই বাস্না না মাস্না কি যেন শব্দটা ঠিক মনে নেই সেটা কাটাতে দেশের বাড়ি যেতেই হবে।
এই দিকে আমার যে কাল সকাল ৮:৩০ থেকে বিকাল ৫:০০ পর্যন্ত ট্রেইনিং এর ঝামেলা আছে। আমার শ্বসুর নিজেও তিনি অসুস্থ, দেবরের আজ সাড়ে বারোটায় কেমিস্ট্রি পরীক্ষা সেসব জানা সত্বেও হাজেরাবুয়ার আমার এই সব ছোটখাটো ঝামেলা নিয়ে বিন্দুমাত্র অনুশোচনা বা চিন্তা করার অবকাশ ছিলো না। সে পত্রপাঠ বিদায় চায় ও বেশ কিছু টাকাও তার প্রয়োজন। আর তার কাছে আছেই তো দিনরাত্রীর সেবা প্রদানকারী ব্যাংক আমি অসহায়া। কি আর করা? পৃথিবীতে কর্মজীবি মহিলার জন্য একজন রাঁধুনী বুয়া সোনা, রুপা, হীরা বা মনি মানিক্যের চাইতেও অনেক বেশী দামী। কাজেই যতদূর সম্ভব তার হাতে গুঁজে দিয়ে বললাম, এর বেশী এখন আমার কাছে আর নেই।
অসন্তুষ্ট হলেও বুঝা গেলো বিষম অবিবেচক (যা তার নানা কাজে প্রমানিত) এই হাজেরাবুয়া কখনও কখনও সে তার চোখে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ধনী মহিলা আমি (বিলগেটসের বউ বা কন্যা) মনে হওয়া মানুষটিকে মনে মনে ক্ষমা করেন। মুখখানা যতদূর সম্ভব ভালো মানুষ বানিয়ে বললেন , "হ হ বুজি বুজি বুজি, সব সময় তো আর হাতে টাকা পয়সা থাকেনা, মাসের শেষ, তোমাদেরও হাত খালি, সে কি আমি আর আমি বুজিনা, আমি সবই বুজি......( মনে মনে ইচ্ছে হচ্ছিলো কি বলতে সে আর নাই বা বললাম) .......
চলে গেলেন হাজেরা বুয়া। আর আমি রান্নাঘরের মাঝখানে হা করে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম। সকালের নাস্তা, দুপরের খাবার, বিকালের ....... সব খানাপিনা ঘরবাড়ির কাজকর্মগুলো চক্রাকারে ছোটবেলায় পড়া ব্যাঙের জীবনচক্র বা বিভিন্ন সাইকেল বুঝাতে যেমন এ্যরো দিয়ে দিয়ে গোলাকার চক্রটা বুঝানো হয় তেমনি করে ঘুরছিলো আমার চোখের সামনে বা মাথার ভেতরের সৃষ্ট দৃশ্যাবলীতে।
কিন্তু এসব সিনেমা ভেবে বা কল্পনা দৃশ্যে দেখে তো আর আমার চলবেনা। এক মুহুর্ত সময় এখন আমার কাছে এক এক বছরের সমান, কাজেই কোনোমতেই কালক্ষেপন সম্ভব না । অলরেডী ছয়টা চল্লিশ, কাজেই কোমরে আঁচল বেঁধে ঝাঁপিয়ে পড়লাম সংসার সমুদ্রে। অনেকদিন পর মনে পড়লো আমার দাদী মাঝে মাঝেই যখন শেষ বয়সে উদাস হতেন, বলতেন, উনআশিটা বছর কাটিয়ে দিলাম এই সংসার সমুদ্রে। সেই সংসার সমুদ্র যে ঠিক কি রকম তা এতদিনেও আমি ঠিক জানিনা।
আসলে জীবনের এতটা দিনতো বাবার বাড়িতেই ছিলাম আর বাবার বাড়িতে নাকি মেয়েরা যে সুখে থাকে সেই সুখের সমাপ্তি হয় বিয়ের সাথে সাথে এমনি শুনেছি মা খালাদের কাছে। যদিও বেশীদিন হয়নি আমার সেই দুঃখের দিন শুরু মানে বিয়ের বয়স। তবুও এই কমদিনে আমি ততটা কোনো দুঃখ বুঝিনি। বরং বিয়ে, হানিমুন, দাওয়াৎ, আত্মীয়-স্বজন, উপহারের বাইরে বাকীটা সময় তো অফিসেই কাটে। কাজেই দুঃখ তেমন বুঝিনি। মজাতেই আছি মনে হয়। রান্নাবান্নার তদারকী করেন শ্বাসুড়ি হুইল চেয়ারে বসেই আর আছেন আমাদের দশভূজা হাজেরাবুয়া। কাজেই ছিলাম মোটামুটি নিশ্চিন্তি। এইবার বুঝি সুদে আসলে নিশ্চিন্তিতা বের হলো!
সে যাইহোক, তাই বলে আমার ভাবনা চিন্তা, দুশ্চিন্তা, নিশ্চিন্তা দিয়ে তো আর পৃথিবী চলবেনা কাজেই এক ঝলক ভেবে নিলাম সিস্টেম এ্যান্ড ইনস্ট্যান্ট ডিসিশান-
১. ফ্রিজ থেকে ৪টে ডিম বের করে পোচ
২. শ্বুসরের স্যুপের চিকেন আর ভেজিটেবল সি্দ্ধ
৩. ফ্রিজ থেকে পাউরুটি, জেলী, চিজ
কিন্তু ফ্রাইপ্যানটা যে কোথায় লুকিয়ে রেখেছে হাজেরাবিবি খোদা জানে! খুঁজে পেতে বের করলাম যদিও । উফ! চোখ ঘড়ির কাঁটায় । সময় নেই সময় নেই। ফ্রাইপ্যানটা চুলোয় বসিয়ে একটু তেল দিয়ে এক সাথে টপাটপ ভেঙে দিলাম একই সাথে ৪টা ডিম। তাড়াতাড়ি সেটা ঢাকনা চেপে নামিয়ে রাখলাম একা একা কিছুটা পানিপোচ টাইপ কিছু একটা হোক। আরেক হাতে শ্বসুরের চিকেন ভেজিটেবল ফ্রিজ থেকে বের করে সসপ্যানে সিদ্ধ দিলাম। হাজেরাবুয়ার মত দশভূজা না হতে পারি, তেশোভুজা বা চেশোভূজার হবার ট্রাই তো করা যেতে পারে। সে যাইহোক সিদ্ধ চিকেন আর ভেজে একটু নুন, গোলমরিচে কি ভুতুড়ে স্যুপ হলো আল্লাহ জানে । শ্বসুর অবশ্য পরে বলেছিলেন ভালো হয়েছিলো কিন্তু তার আসল মনের কথা জেনেছিলাম আরও পরে।
কোনোমতে টেবিলে নাস্তা সাজিয়ে দিয়ে, মাথায় ঝপাঝপ পানি ঢেলে ছুটলাম অফিসে। সাত সকালে সেখানে গিয়ে আমি এবার হাজেরা বুয়ার পন্থা অবলম্বন করলাম। ছুটি চাই। ছুটি চাই। যে কোনো মূল্যে আমার আজ দুপুরের পর ছুটি চাই। নইলে বাড়িতে সবাই না খেয়ে থাকবে।শুরু হলো ব্যাঙের লাইফ সাইকেলের মত ছুটি সাইকেল। হাজেরা বুয়া তার থেকে আমি, এরপর কি হ্যাসব্যান্ড, দেবর সবাইকে ছুটি নিতে হয় নাকি কে জানে! এতদিনের চাকুরীতে কখনও লেট না করার সুবাদে ও বিয়ে উপলক্ষেও খুব কম ছুটি নেবার কারণে আমার ছুটি অল্পেই মন্জুর হয়ে গেলো।
বাসায় ফিরতে ফিরতেই চিন্তা করে ফেল্লাম কি করে সামলাবো এত দিক। না, হার মানলে তো চলবেনা। হাজেরাবুয়া যদি পেরে থাকে, আমার মা খালা দাদি নানীরা, ফুপু, চাচী, বান্ধবীরা যদি পেরে থাকে, আমি কেনো নয়? কাজেই আমাকে কি করতে হবে? প্লানিং, সুষ্ঠ প্লানিং এবং সিস্টেমে কি না হয়।
বাসায় এসে কোনোমতে সেদিন আলুভর্তা, ডিমের তরকারী আর ভাত ডালে চালিয়ে দিলাম। শুধু একটু বুদ্ধি খাঁটিয়ে আলুভর্তাটা মাখন দিয়ে, ডিমের তরকারীতে ধনেপাতা, টম্যাটো এইসব দিয়ে চাইনিজ স্টাইলে কর্ন ফ্লাওয়ার গুলিয়ে কি হলো ঠিক জানিনা কিন্তু মনের মাধুরী মিশিয়ে রান্না করে ফেললাম। সেসব রান্নার ত্রুটি ঢাকতে বেছে নিলাম এক কুটকৌশলী বুদ্ধি। সুন্দর সুন্দর সব ক্রোকারিজ বিয়েতে পাওয়া যা কাবার্ডে সাজানো ছিলো সেসব নামিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে দিলাম টেবিলে, এমনকি এক সেট ন্যাপকিন পর্যন্ত। ভু্ট্টা ভুট্টা বাটিতে সালাদ, মুরগীর ডিমের বাসনে ডিমের তরকারী আরও নানারকম বড়ই সৌন্দর্য্য বাসন কোসনে আমার বড়ই সৌন্দর্য্য তরকারীগুলি সাজিয়ে সবাইকে যখন খেতে ডাকা হলো সবার আগে সবচাইতে খুশী হল আমার দেবরজী। সে তো প্রশংসায় পঞ্চমুখ। বাহ ভাবী বাহ!! ন্যাপকিনে মুখ মুছে ঢেকুর তুলে আমার শ্বসুরজীও বললেন, বাড়িতেই তো রেস্তোরা বানিয়ে দিলে বৌমা।
শুধু আমার শ্বাসুড়ীর মুখ আষাড়ের অন্ধকারর। কারণ বুঝিনি প্রথমে। কিন্তু পরে বুঝলাম এই সব ভালো ভালো বাসন কোসনের অপব্যাবহার তার মোটেও পছন্দ হয়নি। যদিও সেসব আমার বিয়েতেই পাওয়া তবুও সেসবের যথার্থ ব্যাবহারের প্রকৃত মালকীন তিনি আর তার অনুমতি না নেওয়ায় তিনি ইষৎ, না না ইষৎ না বেশ রুষ্ঠ হয়েছেন আমার উপর তা বোঝা গেলো। যাইহোক আমার তখন এক খেলা খেলা নেশায় পেয়েছে। এসব দেখবার সময় কই?
প্লানিং, সিস্টেম এ্যান্ড ম্যানাজিং এভরিথিং- দ্যা সংসার সমুদ্র
স্বামীদেবতা তখনও ফেরেননি। তার ফিরতে সেই সন্ধ্যা। দেবরকে বললাম, আমাকে নিয়ে একটু আগোরা যেতে পারবে? সে সানন্দে রাজী হলো আমার ড্রাইভার হতে। লিস্ট করে রেখেছিলাম আগেই। কাজেই লিস্ট দেখে দেখে-
১। ট্রিকস
২।ভিমবার
৩।ননস্টিক ফ্রাইপ্যান ছোট ও বড়
৪।সসপ্যান ছোট ও বড়
৫।মসলার কনটেইনার সেট
৬। কিচেন টাওয়েল
৭।ফ্রিজে খাবার রাখা প্লাসটিক বক্স ১ ডজন
৮। গরুর মাংস ৫কেজি
৯।বিফস্টেক মাংস
১০। রুপচাঁদা মাছ
১১।রুইমাছের বড় পিস করা প্যাকেট
১২। কর্ন ফ্লেক্স
১৩। দুধ, চা চিনি এবং টিব্যাগ
১৪। ঢেরস, বেগুন ইত্যাদি ইত্যাদি ইতাদি...
১৫।মুরগী পিস করে কাটা প্যাকেট
বাসায় ফিরে প্রথমে কিচেনের সব ড্রয়ার, পাল্লা ঘেটে হাড়ি কুড়ি, কড়াই মড়াই সরিয়ে দিলাম স্টোররুমে। এমনকি অকারণে রাখা বিভিন্ন টিনের কৌটায় কোনোটাতে সুজি, কোনোটাতে ময়দা কোনোটাতে পাপড় কোন জনমে তার আগমন ঘটেছিলো কে জানে এবং তা খাবার অযোগ্য হয়ে পড়েছে কিন্তু চির আবাস গড়েছে সেখানে, সবকিছু দূর করে রান্নাঘর ঝেড়ে মুছে ঝকঝকে, তকতকে করে ট্রিকস, ভীমবার সাজিয়ে দিলাম সিঙ্কের ধার ঘেসে। সাথে নতুন কেনা সাবানদানীটা ঝুলিয়ে দিলাম উপরে, ফুলো ফুলো সুন্দর মাজুনী সহ।
ফ্রাইপ্যান, চামচ হুকে ঝুলিয়ে দিয়ে, সসপ্যান অন্যান্য থালা প্লেট তাকে সাজিয়ে, সব মসলার কনটেইনার ও চাল ডাল পোলাউ চাল কনটেইনারের ভরে ভরে, হাত মোছা টাওয়েল, প্লেট মোছা টাওয়েল সব যথার্থ স্থানে ঝুলিয়ে যখন কিচেনের দিকে তাকালাম। নিজের কিচেন নিজেই চিনতে পারছিলাম না। মনে হলো সেটা কোনো বিদেশী ম্যাগাজিনে দেখা ছবি ছবি কিচেন। বাহ ! নিজের অজান্তেই নিজের কাজের তারিফ করে ফেললাম। যদিও তখন ঘেমে নেয়ে ভুত হয়ে উঠেছি আমি। ছুটলাম গোসল করতে। দেবরকে আবারও রিকোয়েস্ট করলাম একখানা টেবিল ফ্যান কিচেনে সেট করে দিতে। রাতে ভুনা খিচুড়ি আর মাংসভুনা খাবার প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে শিঘরি করে একখানা টেবিল ফ্যান সেট করে দিলো সে কিচেনে। আহ !! আর কি চাই? রান্নাবাটি খেলা তো মোটেও নিরানন্দ কিছু নয়।
বিকেলে টুনা ফিসের টিন কেটে আর ব্রাউনব্রেডে গাজর, কাঁচামরিচ দিয়ে বানালাম মজাদার স্যান্ডুইচ। চায়ের সাথে এই টা পেয়ে আমার শ্বসুর, দেবর এমনকি স্বামীদেবতাও মহা আনন্দিত হল। শুধু আমার শ্বাসুড়ি ছুঁয়েও দেখলেন না, তিনি টুনা ফিস ঘেন্না করেন, তিনি দুটি টোস্ট চায়ে ভিজিয়ে খেলেন। এমনকি আমার দেবরজী যে কিনা এক গ্লাস পানি গড়িয়ে খায়না সেও আমার সাথে টিভির সামনে বসে বসেই স্যান্ডুইচের রুটি গুলোর ধার কেটে দিলো। আমার কিন্তু একটু পরিশ্রম হলেও মজাই লাগছিলো এই সংসার সংসার খেলা। কারণ বিয়ে হয়ে এই পর্যন্ত আমি শ্বাসুড়ি ঠাকরুন আর হাজেরাবুয়ার কারণে কিচেনের হাড়ি ছুঁয়েও দেখার সুযোগ পাইনি। একদিন নুডুলস বানাতে গিয়েছিলাম, সে কি বকা ঝকা , হাজেরা বুয়া বলে এই তো ভুল করলে এতটুকু পানি, ততটুকু তেল। যেন সে ছাড়া এই দুনিয়ার কেউ কিছুই জানেনা রান্না বান্নার।
আমার সুষ্ঠ প্লানিং এ্যান্ড সিস্টেমের দরুন আর কোনো কাজেই কোনো ঝামেলা হলোনা। গটাগট আমি রেঁধে ফেললাম গরুর মাংস ভুনা, যদিও আদা বাটা, রসুন বাটা আর এক বক্স পেয়াজ বাটাও ফ্রিজে ছিলো। না থাকলেও কই বাৎ নেহি, হেরে যাবো ? কোনোভাবেই না। ব্লেন্ডারও রেডি ছিলো, যা একটু সময় লাগতো বেশি এই যা। চড়িয়ে দিলাম পোলাউ চালে আর মুগের ডালে ভুনা খিচুড়ি। রাতের বেলা আবার নতুন রকম টেবিলের সাজসজ্জা, লেবু, আচারে, সালাদে পরিবেশিত হলো আমার সৌজন্যে ভুনাখিচুড়ি গরুর মাংস ডিনার নাইট। সবার মুখে আনন্দের হাসি, দেবরজী বললেন, ভাবী তোমার হাতের রান্না অমৃত! আমি তোমাকে পেঁয়াজ মরিচ কেটে দেবো, বাসন মেজে দেবো হাজেরা বুয়ার আর আসার দরকার নেই, যা সব অখাদ্য রাঁধে!
আমি পরিশ্রান্ত হলেও এই কথায় মহা আনন্দিত হলাম। কিন্তু শ্বাসুড়ি বললেন, "কয়দিন আর! প্রথম প্রথম অনেক মজা লাগবে তারপর শুরু হবে, কত ধানে কত চাল। অমন অনেক দেখেছি, নতুন নতুন তো ঝকঝকে থালা বাটি হাড়ি কড়াই এরপর আর কদিন শখ থাকে দেখা যাবে।" শ্বসুর বললেন, "আহা থাকুক না যদ্দিন থাকে। বউমা কাল আমাদেরকে কি খাওয়াবে? নাকি সারপ্রাইজ দেেবে?" আমি যদিও শ্বাসুড়ির কথায় একটু দমে গেছিলাম কিন্তু শ্বসুরের কথায় আবার উৎসাহিত হয়ে উঠলাম।
পরদিন খুব ভোরে উঠে নাস্তা ও অন্যান্য সকল খাবারের যোগাড় য্ন্তর করে রাখছি । কখন যেন পেছনে স্বামী দেবতা এসে দাঁড়িয়েছেন জানিনা। তিনি বললেন, আমি কি তোমাকে হেল্প করতে পারি? আমার এত্ত লজ্জা লাগছিলো কারণ তখন আমি পেঁয়াজ কুচি করতে গিয়ে চোখের জলে নাকের জলে একাকার। তিনি আমাকে সরিয়ে দিয়ে চাকু দিয়ে পেঁয়াজ কুচি করতে শুরু করলেন। আমি অবাক! আরে সে দেখি এই কাজে আমার চাইতে বেশি পারদর্শী।
হঠাৎ পেছনে দেখি শ্বাসুড়ী ঠাকরুন কখন যেন হুইল চেয়ারে করেই এসেছেন। ছেলেকে কিচেনে পেঁয়াজ কাটতে দেখে তিনি মনে হলো পৃথিবীর কোনো অষ্টম আশ্চর্য্য দেখছেন। তার বিস্ফারিত দৃষ্টিতে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। বললাম "মা চা খাবেন?" তিনি কিছু না বলে ফিরে গেলেন তার রুমে। বুঝলাম ছেলের পেঁয়াজ কাটা দৃশ্যটা তার হজম হয়নি মোটেও। কিছু পরে তার রুমে নাস্তা দিতে গিয়ে শুনি তিনি বড় মেয়েকে নিউজিল্যান্ডে ফোন করে বলছেন, "জীবনে কোনো ছেলেকে এক গ্লাস পানি ঢেলে খেতে দেইনি। তোমার বাবাকে সারাজীবন মাথায় করে রেখছি। কিচেনের চেহারা সে কোনোদিন দেখেনি। আর আজ কালকার মেয়েগুলা এত সেয়ানা!! এতই ..ছলাকলা রঙঢঙ্গে ভুলাতে........ জানে......."
থমকালাম। তারপর রুমের টেবিলে নাস্তা রেখে চলে আসলাম। ডাইনিং রুমে এসে দেখলাম টেবিলে কে যেন জাগে পানি ঢেলে রেখেছে। সবার প্লেট থালা যার যার চেয়ারের সামনে সুন্দর করে সাজানো সাথে পানি ভরা গ্লাস ঢাকনি দিয়ে ঢাকা। ঠিক এই কটা দিন আমি যেমনভাবে সাজিয়ে দিয়েছি। একি ভুতুড়ে কান্ড! কে করলো সেসব!! দেখি শ্বসুরমশাই হাতে তার রুমে রাতে রাখা পানির বোতল- গ্লাস নিয়ে ঢুকছেন। আমাকে দেখে বললেন, "বৌমা তুমি সারাদিন চাকুরি করে এত কষ্ট করছো। নতুন নতুন মজাদার খাবার বানাচ্ছো, তোমার যত্ন আত্তিতে তো আমার অরুচী কেটে গেছে। নতুন নতুন খাবারের আশায় থাকছি রোজ রোজ।এখন থেকে আমিও যতদূর পারি তোমাকে সাহায্য করবো, হাজেরাবুয়া ফিররে না আসা পর্যন্ত। টেবিলে থালা প্লেট দেওয়া, পানি ঢালা এসব তো আমিই পারি। কাজ তো আর বেশি না, শুধু সময়ের ব্যাপার। তোমারতো বিশ্রামের দরকার আছে।" চোখে পানি এসে গেলো । বলতেই পারলাম না বাবা আপনাকে এই বয়সে এসব করতে হবেনা। তার আগেই দেখি দেবরও এসে দাঁড়িয়েছে, দুষ্টুটা বললো, "আর আমাকে দিয়ে ঘর ঝাঁড়া, বাসন মাজা সবই করাতে পারো ভাবিজী তার বদলে আজ চাই ফ্রায়েড রাইস আর চিকেন চিলি।"
উপলদ্ধি হলো, পৃথিবীতে সব কিছুর মূল্যই একেবারে কম নয়। কখনও কখনও তা অমূল্য বটে। যাইহোক আমি আমার নতুন জীবনে ভাড়ারঘর বা রসুই ঘরের কোনো কর্তৃত্ব পাইনি এখনও, চাইওনি সেই আগেরদিনের বৌদের মত। আমি তো বাসাতেই থাকি শুধু কয়েকঘন্টা। বাকী সময়তো অফিসেই কাটে। শুধু হাজেরা বুয়ার অনুপস্থিতিতে বাসার মানুষগুলোর যেন এতটুকু কষ্ট না হয় সেইটা ভেবেই নিজের বিশ্রাম বা কষ্ট উপেক্ষা করে এইসব করেছিলাম। আর করতে গিয়ে এক নেশায় পেয়ে বসেছিলো আমাকে।
নতুন নতুন রান্না, সুন্দর করে সবাইকে খাইয়ে তাদের মুখে তৃপ্তি দেখার লোভ বা এতটুকু উফ না করেও যেন সবাইকে নিয়ে হাসিমুখে থাকা যায় সেটাই হয়তো ছিলো আমার চাওয়া। জানিনা সেসব তবে ঘরকন্না খেলা তো বাঙ্গালী মেয়েদের ছোট থেকেই সহজাত এক স্বভাব। সেই কারণেই হয়তো এক মজার খেলায় মেতে উঠেছিলাম আমি। মনে হয়েছিলো কোনো কষ্টই কষ্ট না। সুষ্ঠ প্লানিং, সিস্টেম এর পরে যে কোনো কিছুই ম্যানাজ করে ফেলাটাও তেমন কঠিন না । আর এত শুধুই কয়েকটা মানুষের খানা তৈরী আর তাদের একটু যত্ন আত্তি। আর বুয়ার অনুপস্থিতিতে সবাই যে এগিয়ে এসে নানা কাজে একে অপরকে সহযোগিতা করলো এই কটাদিন তা যেন নতুন শ্বসুরবাড়িতে যতদিন এসেছি তার চাইতেও বেশি আত্মিক টানটা বাড়িয়ে দিলো শতগুণ।
সে যাইহোক এইভাবে কেটে গেলো সাত সাতটা দিন। সাত দিনের মাথায় হাজেরাবুয়া ফিরে আসলো। আবার সেই পুরোনো রুটিন। রুটি ভাজি আর চিকেন কারী বা মাছের ঝোলের সাথে ডাল। আমিও আবার ফিরে গেলাম পুরোনো রুটিনে। অফিস, টিভি, দাওয়াৎ খেতে যাওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি।
বিকেলবেলা শ্বাসুড়ি গল্প করছিলেন সেদিন হাজেরাবুয়ার সাথেই-
:আরে তুমি আঁদা রসুন পেয়াজ বাটা রেখে গিয়েছিলে ফ্রিজে আর মাছ ও কেটে রেখেছিলে, চিংড়িমাছ বেছে রাখা ছিলো তাই রক্ষা। নইলে ঐ দুদিনের খেলা খেলা রান্নাখেলার শখ কেমন দেখতাম। কথায় আছে না কত ধানে কত চাল........ সেটাই দেখার ইচ্ছা ছিলো আমার। তুমি এত তাড়াতাড়ি না ফিরলে সেটাই দেখা হত আর কি.......যত্তসব আদিখ্যেতা.....
আজকালকার মেয়েগুলো যেই না সব ছলাকলা জানে, আর জানবেনা কেনো বিয়ে হয় তো এক এক জনের তিরিশ বত্রিশ বছরে... পেকে ঝুনঝুনা হয়ে আসে...তারপর কত রকম রঙ্গ আর ঢঙ্গ......আমরা বাবা এসব বুঝিনি....
কিল খেয়ে কিল চুরি করার মত নিঃশব্দে ফিরে আসলাম নিজের রুমে...
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ১:২১