প্রায় খুবই গুরুত্বপুর্ন একটা পরিক্ষা শেষ হয়েছে।ঢাকা যাবার খুব ইচ্ছে ছিল তখন।কি কারনে জানিনা,তবে সত্যিই খুব ইচ্ছে করছিল ঢাকা যেতে।অন্যদিকে বাসায় কেউ নেই।আমি,আমার মা,আমার বোন,আমার বাবা আর আমার দাদা।দাদীর বয়স হয়েছে।বুড়ো বয়সে সবারই কত কিছুই না করতে ইচ্ছা করে।বাবার মত নিয়ে দাদী গিয়ছে তার মুমুর্ষ মামাকে শেষ দেখা দেখবার জন্য।ওদিকে ঢাকা যাওয়ার তারিখ চলেই আসল।ডিসেম্বরের ৭তারিখের টিকিট কেটেছি।দাদী ফিরলে তবেই যাবো।কিন্তু শুনলাম সেখানে গিয়ে দাদীও খানিকটা অসুস্থ হয়ে পড়েছে।আর কি অগ্যতভাবে নিজের মনের মধ্যে থাকা ইচ্ছাটা শেষ করে দিলাম মনের মধ্যেই।
ঢাকা না যেতে পারায় মনটা এমনিতেই খুব খারাপ।বাবা ব্যাপারটা লক্ষ্য করতে পেরেছিল।দাদাও পেরেছিল।তাই দাদা বাবাকে বলল একটু যাতে বাইরে নিয়ে যায়।বাবাও রাজী হল।গল্পের মত হলেও সত্য পরিবারের মধ্যে বড়ই আল্লাদের ছেলে আমি।একা কিছুতেই কেউ ছাড়তে চায়না কোথাও।এত বুঝাই যে আমি বড় হয়েছি কে শুনে কার কথা! বন্ধু-বান্ধব সব ঘুড়তে গিয়েছে এখানে ওখানে আমিই শুধু পারলাম না।যাক গে যা গেছে তা নিয়ে চিন্তা না করাটাই শ্রেয়।
অবশেষে,ডিসেম্বরের ৮তারিখ বাবার সাথে গেলাম বাবার দোকানে।কতই না গ্রাম্য রাস্তা দিয়ে নিয়ে গেল বাবা।একা হলেও কম উপভোগ করিনি সময়টুকু।সেই ২০০৯ সালের কথা!যদিও তখন আমরা শহরে থাকতাম,বাবার দোকান ছিল গ্রাম সাইডেই।আমরা ২০০৩ সালের আগ পর্যন্ত গ্রামেই ছিলাম।ঠিক গ্রামেও না।শহরীয় গ্রাম বলা যায়।যখন থাকতাম সেই সময় বাবা দোকান করেছিল ওখানে।তারপর শহরে আসার পরেও বাবা সেখানের মায়া আর ছাড়তে পারেনি।ওখানেই রয়ে গেছে।
যাই হোক।সকাল ৬টার দিকে রওয়ানা দিলাম বাবার সাথে।বাবার একটা খানদানি সাইকেল ছিল সেটাতে চড়েই গিয়েছিলাম।যাওয়ার পথে গ্রাম্য রাস্তা।অনেকটা নিরিবিলি।যেতে যেতে অনেক সময় লেগে গিয়েছিল।ভোর ৭টার দিকে গ্রাম্য রাস্তার পাশ দিয়ে দেখলাম ধান ক্ষেত।ক্ষেতের এক পাশে দেখলাম গরু ঘাস খাচ্ছে।অন্যপাশে গৃহিনীর ঘরের চালের উপর দিয়ে ধোঁয়া উড়ে যাচ্ছে।ঘরের চাল ঠিক নয় ধানের খড়ের চাল।কেউ শ্বাস নিলেও মন হয় সেই চালের উপর দিক থেকে শোনা যাবে।সাইকেলের পিছনে বসে আমি উপভোগ করছি ব্যাপারটা।বাবা দেখাচ্ছে এই জায়গাটায় অমুক থাকত এই জায়গাটায় তমুক থাকত ইত্যাদি।একটা নাম বলে অন্য একটা নাম বলতে যাওয়ার সময় আগেরটা ভুলে যেতাম,এত কঠিন নাম ছিল একেকজনের।
ওইদিকে দেখলাম কিছু মানুষ চাদর মুড়ি দিয়ে বসে বসে আগুন পোহাচ্ছে।আবার কিছু মানুষ মাথায় বিদেশীদের টুপির মত পড়ে গরু নিয়ে মাঠে যাচ্ছে।এরা আর কেউই নয় আমাদের দেশের কৃষক!রাস্তার পাশেই একটা বাড়ি থেকে কেমন একটা ঝাঝালো গন্ধ আসতেছে।বোধ করলাম হয়ত আলুভর্তা দিয়ে ভাত খাবে বলে মরিচটাকে ভালভাবে পুরিয়ে নিচ্ছে।আমার চোখে তখনো খুব ঘুম ঘুম কাজ করছে।আমার ঘুম এত তাড়াতাড়ি কখনোই ভাঙে না।আর এরা উঠে খাবার দাবার খেয়ে কাজেও লেগে পড়েছে একেকজন।বড়ই আশ্চর্য হলাম।বাবা এত এডভানশড।
বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম-“বাবা এরা এত তাড়াতাড়ি কিভাবে উঠে বলতো?”
বাবা হেসে বললেন-“আমি কিভাবে উঠি? যখন ক্ষুধার জ্বালায় পেট জ্বলবে তখন তোকেও এদের মত এত তাড়াতাড়িই ঘুম থেকে উঠতে হবে”
আমি শুনে হতবাক।কিছুই বললাম না।অনেক কিছুই স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলাম তাই হয়ত চুপ ছিলাম।কিছুক্ষন বাদে এভাবেই ঘুরতে ঘুরতে চলে এলাম বাবার দোকানে।ছোট মনে হলেও ব্যাপারটা খুবই উপভোগ্য ছিল আমার কাছে।আমার যাত্রা এখানেই শেষ!
সবচাইতে মজার ব্যাপার হলো।এরা আমাদের মত মধ্যবিত্ত নয়।এরা আমাদের থেকেও ধনী।সুখের দিক থেকে।মনোভাবের দিক থেকে।আত্মমর্যাদার দিক থেকে।তবুও আজকাল অনেকের মুখেই শুনা যায় –“ গরিবের আবার আত্মমর্যাদা”। কিন্তু কথাটা যে আসলেই একটা উপহাস মাত্র তার প্রমান আমি নিজেই!
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে নভেম্বর, ২০১৫ দুপুর ২:০৭