এটা একটা কেস স্টাডির মত, তবে এরকম ছোট ছোট অনেক উদাহরণই হয়ত দেওয়া যায় । কিন্তু অামি এমন একজন ব্যক্তির কথা বলব, যাকে শুধু তার নিজের গ্রামের মানুষই না অাশেপাশের অন্যান্য গ্রামের মানুষও অত্যান্ত কৃপণ ব্যক্তি হিবেবেই চিনতো এবং এতটাই কৃপণ ছিল যে, উনি একজন মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও উনাকে সবাই মুঁচি বলে ডাকতো । অথচ, উনার প্রকৃত নাম ছিল অাফেল উদ্দীন মন্ডল । কিন্তু গ্রামের মানুষ তাকে চিনতো অাফেল মুঁচি নামে, এ নামে তাকে চিনতে কারো সমস্যা হতোনা । যদিও সে ছিল একজন নিরিহ কৃষক, জমিজমাও ভাল ছিল, ছিল অনেক গুলো ছেলে-মেয়ে, কিন্ত কোন ছেলেমেয়েকেই ভাল মত লেখাপড়া শেখাতে পারেনি । হয়ত এটাই ছিল তার জীবনের বড় ব্যর্থতা ।
সে সময় গ্রামে প্রচুর অাঁখের চাষ হতো এবং এগুলো মাড়াই করে গুড় তৈরী করা হতো সম্পূর্ণ ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য মাথায় রেখে । শীতের শুরুতে এই গুড় বানানোর মৌসুম শুরু হলে একেক দিন একেক জন কৃষক তার জমির অাঁখ কেটে এনে অাঁখ মাড়াই করা কলের কাছে জমা রাখত । এই অাঁখ সাধারনতঃ গ্রামের গরুওয়ালারাই কেটে দিতো, বিনিময়ে তারা অাঁখের মাথার অংশ কেটে রাখত গো-খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করার জন্য এবং তারা বড় বড় ৪/৫টা করে অাঁখ নিতো খাওয়ার জন্য । এছাড়া অন্যদেরও সেদিন অবাধ স্বাধীনতা ছিল ২/১টি অাঁখ নেওয়ার । এতে কোন কৃষকই অাপত্তি করতো না । ব্যতিক্রম ছিল শুধু অাফেল মুঁচির বেলায় । সে গরুওয়ালদেরকে ১টার বেশি অাঁখ দেবেনা, অন্যদেরকে তো দেবেই না । যা তার চরিত্রের চরম কৃপণতারই বহিঃপ্রকাশ ছিল । এ ছাড়া সে নিজেও ভাল কিছু ভোগ করতো না, ঠিক মত বাজার করতো না, খাওয়া-দাওয়া করতো খুব হিসেব করে খরচ বেড়ে যাওয়ার ভয়ে । তবে টাকা পয়সা জমিয়ে সে কোন অকাজ-কুকাজে ব্যয় করতো না, শুধু জমি কিনতো । অার এই জমিই একদিন তার জীবনে সব চেয়ে বড় অভিশাপ বয়ে অানলো ।
শুধুমাত্র জমির ভাগাভাগি নিয়ে তার বড় ছেলে খুন হলো অারেক ছেলের হাতে । বাবা হিসেবে এর চেয়ে কষ্টের হয়ত অার কিছুই হতে পারেনা । সে তখন নিজেই বাদী এবং বিবাদী । এক ছেলে লোকান্তরে অারেক ছেলে পলাতক অাসামী । এ অবস্থায় তার জীবনের হিসেবটাই পাল্টে গেল । সে পরিবর্তণ হতে শুরু করল । জীবন, সংসার, ছেলেমেয়ে, জমিজমা সব কিছুই তার কাছে তুচ্ছ মনে হতে লাগল । অার হবেই বা না কেন, যে জমির জন্য সে নিজেকে কত ভাবে বঞ্চিত রেখেছে, ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ এর কথা ভেবে, অার সেই জমিই কিনা এক ছেলে অারেক ছেলেকে খুন করালো !
একটা অাদর্শ গ্রাম বলতে যা বোঝায়, তার সব কিছুই ছিল অাফেল মুঁচির গ্রামে, শুধু ছিলোনা একটা কলেজ । গ্রামের মানুষ এ অভাবটি দীর্ঘদিন থেকে অনুভব করে অাসছিল, কিন্তু কলেজ নির্মাণের সব পরিকল্পনা পাকাপাকি হওয়ার পরও শুধু জায়গার অভাবে তা নির্মাণ করা সম্ভব হচ্ছিল না । কারণ একটা কলেজের জন্য শুধু একটু জায়গা হলেই হবেনা, তার জন্য মাঠ দরকার, থাকতে হবে যোগাযোগের ব্যবস্থা । অবশেষে গ্রামের সবাইকে অবাক করে দিয়ে এই অাফেল মুঁচি অাসলো কলেজ নির্মাণের জন্য জমি দান করতে; তাও অাবার এক দুই বিঘা না, সাত বিঘা এবং সেটা রাস্তার সাথে । তবে তার শর্ত একটাই, এখন থেকে কেউ তাকে অার অাফেল মুঁচি নামে ডাকতে পারবে না ।
কলেজ হলো । মটর সাইকেলের পিছনে বসে অাছে অাফেল উদ্দিন মন্ডল, গলায় তার ফুলের মালা, তাকে সারা গ্রাম ঘুরানো হচ্ছে । এর অাগে গ্রামে এত বড় ত্যাগী ও উদার অাফেল উদ্দীনকে কেউ দেখেনি । অনেকের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কলেজটি তার নামে করা হয়নি, তবে তাকে সমাহিত করা হয়েছে কলেজ ক্যাম্পাসে । জানিনা, তিনি মারা যাওয়ার অাগে এ ধরণের কোন ইচ্ছা প্রকাশ করে গিয়েছিলেন কিনা ।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই অক্টোবর, ২০১৮ রাত ৯:৩৯