নিশুথি রাত। অন্ধকার গাড় ছায়া ফেলেছে চারপাশে। মাঝে মাঝে ঝিঁঝিঁর সরব উপস্থিতি। এছাড়া সব শুনশান। কত বর্গ মাইল জুড়ে একটি মানুষেরও সাড়া নাই। দুচার ঘর মানুষ দূরে দূরে বিচ্ছিন্ন ভাবে বসবাস করে। সব বাড়ির আলো নিভানো। গভীর ঘুমে নিমগ্ন মানুষ। কোথাও অন্ধকার ছাড়া কোন আলো নেই। নাহ্ আলো আছে আকাশ জুড়ে অসংখ্য আলোর কণা ঝকঝক করছে হীরের মতন। দীগন্তরেখায় তার কিছু প্রতিফলন আমার চোখে ধরা পরছে। শুনসান এই রাত দুপুরে শুধু আমার চোখে ঘুম নাই।
ঘরের জানালায় চোখ রেখে দাঁড়িয়ে আছি অনেকক্ষণ। ভিতরের অস্থিরতা কিছুতেই স্থির থাকতে দিচ্ছে না আমাকে। এ ঘর ও ঘর করে বিভিন্ন দিকে চোখ ফেলে অস্থির হয়ে দরজা খুলে এসে দাঁড়ালাম আঙ্গিনায়। বাতাসের শব্দ আর মেঘের ভেলা চলমান গতিময়তা ধরে রেখেছে, সুপ্তির কোলে ঢলে পরা নিরব রাতের। গাছের পাতায় মায়াবী শব্দ। আর ঝরা পাতার আর্তনাদ। ছায়াছায়া অন্ধকার ধীরে পরিস্কার হয় চোখে। মনে হয় অন্ধকার নয় এক মৃদু আলোর ভুবনে আমি বসবাস করছি। চারপাশের রঙ সব রূপালি মেঘের রঙে আঁকা। অপার্থিব এক মায়াময় সময়। প্রকৃতির সাথে মেলবন্ধনে বেঁধেছে আমায়। অন্ধকারে দু একটা বুনো প্রাণী বেরুতে পারে। পারে আক্রমণও করতে। কিন্তু আমার সে সব মনে পরছে না। মনে পরছে না চারপাশে চোখ রেখে সতর্ক থাকার কথাও। দূরে কায়ওটি ডাকল প্রহর জানান দিয়ে। এসব কিছুই আজ আমার মনে রেখাপাত করতে পারছে না।
আমার মন আজ আকাশের কোলে বাঁধা। সৌর জগতে ঝড় উঠবে আর সে ঝড়ের তাণ্ডবে জাগবে রঙের বন্যা। সে রঙ নৃত্য করবে আকাশ জুড়ে। আমি যেখানে আছি সেখানে এই অপার্থিব আলো সহজে দেখা যায় না। তবে কদাচিৎ কখনও দেখা যায়। কয়েক বছর আগে দেখা গিয়েছিল। তবে তাও আমার খুব কাছাকাছি ছিল না সাত আট ঘন্টার ড্রাইভ করে আরো উত্তরে গেলে দেখা যেত। যারা সৌভাগ্যবান তারা দেখা পেয়েছিল, ঘরে বসেই। এবার সম্ভাবনা তিনদিন ধরে দেখা যাওয়ার সারা দেশ জুড়ে । খবরটাও পাওয়া গেলো আগে ভাগে। তাই এই অস্থিরতা রাত জাগা। বিরল একটি দৃশ্য দেখা পাওয়ার আকুলতায় আমি অস্থির।
যে সব জায়গায় সাধারনত সব সময় দেখা যায় অন্ধকারের আলো অরোরা। তারা দেখে ফেলেছে ছবি দিচ্ছে আহা কি অদ্ভুত বৈচিত্র পৃথিবীর। কিন্তু ছবি দেখা আর নিজ চোখে দেখার পার্থক্য অনেক। সেই অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে চাই আমি।অর্জন করতে চাই সে বিরল ভালোলাগা। নাছতে চাই অরোরার আলোর নীচে তার সাথে আমিও।
পরিবারের লোকদের বলেছিলাম চলো বেড়িয়ে আসি আরো উত্তরে। সারা সময় শীতে থেকে তারা ক্লান্ত। আর শীতের জায়গায় তারা যেতে চায় না। যেখানে গ্রীষ্মেও শীতের বাতাস বয়। আর গ্রীষ্মের সময় অরোরা দেখা যায় না। দেখা যায় শরৎ এবং বসন্তের সময়। যে শীত আমাদের দেশে হাড় কাঁপিয়ে দেয়, গ্রীষ্মের সময় তার চেয়েও অনেক বেশী অনুভুত হয় শীত ওসব জায়গায়। আরো একটা বিষয়। ঠিক দেখা যাবে কি যাবেনা। এরও কোনও নিশ্চয়তা নেই। যেমন ভূমিকম্পের খবর আগে আগে বলা যায় না। তবে বিজ্ঞানীরা এখন চেষ্টা করছে আগে খবর দেয়ার সঠিক সময়টি খুঁজে পাওয়ার। সেই জন্যই জানা গেছে আজ রাতে তার আগমন বার্তা। আর কেউ যাক বা না যাক, কোন এক সময় আমি একাই হাঁটা দিব সেই উত্তরের সন্ধানে। কাটিয়ে আসব কিছু দিন অপেক্ষায়। প্রিয় ভালোবাসার দেখা পাওয়ার জন্য।
একবার অবশ্য খুব কাছাকাছি চলে গিয়েছিলাম। আর হাজার কিলোমিটার গেলেই কয়েক রাত তাকে খুঁজে দেখার সুযোগ ছিল তার দেখা পাবার আরাধনা করার চেষ্টা চালানো যেত। কিন্তু একজন সঙ্গী হয়েছিল আমার সে ভ্রমণে, পথে বেড়িয়েই যার ঘরে ফেরার টানছিল সারাক্ষণ। ষোল হাজার কিলোমিটারের পথকে আঠারো না করেই ফিরে আসতে হয়েছিল তার তাড়নায়।
আমি ভুলে যাই ঘর গৃহস্থালী পথে বেরুলে। পথ আর আমার মনের গ্রন্থী বাঁধা এক সাথে। খুঁজে খুঁজে দেখতে চাই প্রতিটি পথের শেষ সীমানা।
সারাদিন মেঘলা আকাশ আমার অনেক মন খারাপ করে রাখল। তবে সন্ধ্যা বেলার আলোর ঝিলিক আমাকে আশার আলো দেখাল। হয়তো বা আজ তার সাথে দেখা হয়ে যাবে আমার। মাথার উপর মেঘের ছাউনি প্রবল হলেও দিগন্ত ছিল খোলা মেলা। সেদিক দিয়ে যদি খানিক ঝিলিক আমি দেখতে পাই। তার অপেক্ষায় এই রাত জাগা। চারপাশে গাছ গাছালীর ছায়া আকাশটা পুরো দেখতে দিচ্ছে না বলে। মাঝ রাতে গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে গেলাম। আরো খোলা মেলা আকাশের নীচে। মাঠের পাশে গাড়ি থামিয়ে। শুনশান গভীর রাতে প্রকৃতি দেখছি আমি একা। ভয় ডর আমার কখনই নাই কোন কিছুতে তবে মানুষ হলো যত ভয়ের সম্ভাবনা। সে সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া গেলো এবং সেটা সম্ভব হলো এই দেশে আছি বলেই। গাড়ি নিয়ে ছুটে চলে গেলাম বাড়ি ছেড়ে অনেক দূরে, খোলা প্রান্তরে। আপন মনে প্রকৃতি ভোগ করলাম কয়েক ঘণ্টা ধরে। আমার কাঙ্খিত উত্তরের আলোর নৃত্য দেখা হলো না। তবে মেঘের আড়ালে জাগা আধ ভাঙ্গা চাঁদের আলোর "মুন হোলো" নৃত্য দেখতেও মন্দ লাগল না।
যখন পুরো আকাশ আরো ঘন মেঘে ঢেকে গেলো তখন নিরাশ হয়ে ঘরে ফিরলাম। ভোর হওয়ার তখন বেশী দেরী নাই। তবে মন্দ লাগল না একাকী নিরব রাতের আকাশ উপভোগ করতে। মাঝ রাতে খোলা আকাশের নীচে একা দাঁড়িয়ে থাকার অভিজ্ঞতা অর্জনটাও অনেক মধুর। আর যদি চেষ্টা না করে বিছানায় শুয়ে থেকে পরদিন জানতাম অনেকেই অরোরার আলো দেখেছে তখন তো নিজেকেই কামড়ে খেতে ইচ্ছে করত। তার চেয়ে এই ভালো, কিছু তো পাওয়া হলো। আবারও অপেক্ষা। না হয় চলে যাবো নরওয়ে, ন্যদারল্যোন্ড বা ফিনল্যান্ড যেখানে ঘরে শুয়ে থেকে দেখতে পাবো আলোর নৃত্য সাথে দেখা হবে নতুন একটি দেশ। তবে একবার আমার তার সাথে দেখা করতেই হবে, যেভাবেই হোক।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ দুপুর ১:৫৯