somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সাজেক কাহন: মেঘের ভাঁজে আর পাহাড়ের খাঁজে সাজানো আশ্চর্য রূপকথা

০৩ রা জানুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ১২:৫৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

রুইলুই কথন
ভোর ৫টায় যখন আমরা মেলা দিই তখন চারপাশে আবছা আঁধার। আগমনী শীতের কুয়াশা সেই অন্ধকারকে আরো জমাট বেঁধে রাখে। যাওয়ার পথে একটা দোকানে আমরা খেয়ে নেই পরটা আর ডাল। পাহাড়ি মরিচ-মসলামিশ্রিত তীব্রঝালের খাবার খেয়ে অন্য রকম স্বাদ পাই।
গন্তব্য সবুজ সাজেক। সাজেকের রূপ তার সবুজ পাহাড়ে, সাদা মেঘে, সফেদ কুয়াশায়। বাংলাদেশের সবুজ পাহাড় তার পরতে পরতে লুকিয়ে রেখেছে অসীম সৌন্দর্য। সেই সৌন্দর্যসন্ধান কেউ খুজে পায়, কেউ খুজে নিতে পারে না। যারা সেই সৌন্দর্যের সাক্ষী তারা সারাজীবন সে সময়টুকু লালন করে রাখে পরম যত্নে।

স্বর্ণালি রবিরশ্মি
পাহাড়ের বুক বেয়ে চলে গেছে সাজেকের পথ। সে পথের দুপাশে শুধুই সবুজ রূপকথা। সেই রূপকথায় রাজকন্যের মত হাজির হয় সাদা মেঘ। নোনা জলের নীল সমুদ্র দেখেছিলাম। এবার দেখেছি মেঘ কুয়াশার সাদা সমুদ্র। সবুজ বনের মাঝে যেমন পাহাড়ি ঝিরিগুলো বয়ে চলে তেমনি সবুজ রূপকথার মাঝে দিয়ে চলে গেছে সাজেকের পথ। কখনো উঁচু, কখনো নিচু , দুপাশে গিরিখাত, আঁকাবাঁকা ভয়ঙ্কর সুন্দর পাহাড়ি পথ। প্রকৃতির রোলার কোস্টারের সে পথ শুধুই রোমাঞ্চকর। কখনো উচু কোণে, ত্রিকোণমিতির খটমটে ভাষায় ৬০ ডিগ্রি কোণে একবার উপরে নিয়ে যাবে আবার কখনো ১৮০ ডিগ্রি বাঁক নিয়ে নিচের দিকে নামতে থাকবে!
আমরা যেতে থাকি সেই ভয়ঙ্কর সুন্দর পথ দিয়ে। ভোরের প্রথম আলো ফোটার আগে। কিশোরীবেলায় সময় যত যায়, মেয়েরা তত সুন্দর হয়। ভোর থেকে সময় যত গড়ায়, সেই পথের রূপ যেন ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করে! একটা উচু পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে শুরু করার মুহূর্তে সেই রূপ যেন তার সমস্ত সৌন্দর্য নিয়ে আমার সামনে জুড়ে বসে। দূরে পাহাড় হেলান দিয়ে আছে আকাশে। মাঝে বিশাল গিরিখাত। আর সেখানে শীতের চাদরের মত সাদা কুয়াশা পাহাড়ের শরীরে দিচ্ছে উষ্ণতা। সেই চাদর সরিয়ে পুবাকাশে মায়াবি আবির ছড়িয়ে সূর্য তার মুখখানি দেখায় আমাকে। ডিমের কুসুমের মত সে সূর্য তার মিহি রবিরশ্মি বিলিয়ে দেয় সবার চোখেমুখে। ঘোরলাগা সে সূর্যোদয়ের আলো মেখে আমরা ছুটি সাজেকের পানে।


সাজেকের পথরোমাঞ্চ

ঘণ্টাখানেক পথরোমাঞ্চের পর আমরা পৌছি বাঘাইহাট থেকে সাজেক। পুরো পথের অপরূপ সৌন্দর্য তখনো আমাকে আছন্ন করে রেখেছে। তাই চান্দের গাড়ির ভটভট শব্দের পর সাজেকের হঠাৎ নীরবতা অসহনীয় লাগে নি। আসলে তখনো বুঝিনি সামনে আরো অসহনীয় সৌন্দর্য অপেক্ষা করে আছে।
সাজেক শুরু হয় রুইলুই পাড়া দিয়ে। সাজেকের প্রথম গ্রাম। পিচঢালা পথ আর পরিচ্ছন্ন ফুটপাথের পাশে গড়ে ওঠা গ্রামের বাড়িগুলো ছনের আর টিনের। বাংলাদেশের পতাকার রঙ লাল আর সবুজ এর আদলে রাঙানো বাড়িগুলো সাজেকে স্বাগত জানায়। বাড়িগুলোর সামনে ছোট কিন্তু সাজানো ফুলের বাগান। এরপর আছে সাজেক রিসোর্ট, যেখানে সেনাবাহিনীর যত্নের ছাপ স্পষ্ট। ছনের কটেজ, হেলিপ্যাড, দোলনা, সুর্যঘড়ি, লাল টিনওয়ালা বসার জায়গা। আছে আলো রিসোর্ট আর রুন্ময় রিসোর্ট- আরামে থাকার সব সুব্যবস্থা। আমরা সে ব্যবস্থায় প্রস্থান করে যাত্রা করি আরো উচুতে উঠার।

মেঘের ওপর বাড়ি

যাওয়ার পথ ছাড়াও রুইলুই পাড়ায় দেখা মেলে অনেক আদিবাসীর। এই সকালেই ক্যাঙ্গারুর মত বাচ্চা ঝুলিয়ে, কাধে কাঠ এবং হাতে কাস্তে নিয়ে বেরিয়ে পড়ছে কাজে। কেউ ফিরছে ঝুড়িভর্তি সবুজ কলা আর হাতে পাহাড়ি সবজি নিয়ে। প্রকৃতির আদিম সন্তানদের মতই তাদের কোন কৃত্রিমতা স্পর্শ করে নি। ছনের ঘর, রেশমের কাপড়, জুমের ফসল কিংবা ছড়ার পানি- সবখানেই প্রকৃতির আশীর্বাদ। যান্ত্রিকতা তাদের কাছে আগন্তুকের মত। পাহাড়ি বাচ্চাদের কৌতূহল তাদের চোখে, তাদের উচ্ছলতা আমাদের উচ্ছ্বসিত করে।
যথারীতি সাজেকে গিয়েই সবাই ছবি তুলতে শুরু করে। কেঊ দিএসেলার এ পোজ দেয়, কেউ মোবাইল তোলে সেলফি। এবার ইচ্ছে করেই নেয়া হয়নি দিএসেলার। টুকটাক সেলফি তোলা হল । আর তাতেই ছবিপর্ব ফুরিয়ে গেল।কিন্তু তাতে যে সময় বেচে গেল সে সময় কাটানো ছিল সাজেক ভ্রমণের সুন্দরতম মূহুর্ত। নিজের ভাগ্যকেই ধন্যবাদ দেই দিএসেলার না এনে সেই সময়টুকু পাবার জন্য!



কংলাক কথন
বাঘাইছড়ির উচু পাহাড় সাজেক। আর সাজেকের সবচেয়ে উচু পাহাড় কংলাক। কংলাক পাহাড়ের গায়ে পাহাড়িদের গাঁ, কংলাকপাড়া। সাজেকের শেষ গ্রাম কংলাক পাড়ায় আমাদের পা পড়ে আরো পরে।
রুইলুই পাড়ার পিচঢালা পথ পার হয়ে আমরা পথ ধরি লাল মাটির পথ। সে পথের দুপাশে কেবলই পাহাড়। তবে সব পাহাড়ই অনেক নিচে। যেহেতু সাজেক একটি উপত্যকা। উচ্চতাভীতিহীনদের জন্য সে দৃশ্য বড়ই দৃষ্টিসুখকর। মনে হয়, আমার চেয়ে উচুতে কেঊ নেই, আর সবাই নিচে! গোপনে প্যারাগ্লাইডিং করা সাধও জেগে ওঠে মনে!

রাঙামাটির রাঙাপথে

অনেকটা সমতল আর কিছুটা উচু পথ পার হই আমরা। এরপর সামনে আসে সবচেয়ে বড় টিলাটি, যার চূড়াই হল কংলাক। ইংরেজি এস এর মত বাঁকানো উঠার রাস্তা দেখে আমাদের অনেকেরই ভয় ধরে! সত্যিকার পাহাড় ট্র্যাকিং বুঝি এটাকেই বলা হবে! সবার হাতে হাতে তখন বাঁশের লাঠি। কেউ প্যান্ট গুটানো শুরু করে। কেউ রীতিমত পোজ দিয়ে ছবি তুলে তারপর যাত্রা শুরু করে। উঠার আগে আমরা ভাল করে পানি খেয়ে নেই। সব আয়োজন যেন এভারেস্টযাত্রা আনার বৃথা চেষ্টা।
মাত্র পাচ মিনিটেই আমরা পার হয়ে যাই সেই “দুর্গম” উচু পথ! আর উঠেই পানির তৃষ্ণা মনে হয় যেন আরো বেড়ে গেল। ঘামতে শুরু করি আরো আগেই। কোথাও বসে একটু জিরোতে পারলে মনে হল ভাল লাগবে।
তখনই আশীর্বাদ হিসেবে দেখি একটা চওড়া উঠানে পেতে রাখা কয়েকটা চেয়ার। গিয়েই বসে পড়ি ধুপ করে। একটা পাহাড়ি মেয়ে, চওড়া উঠানের মতই চওড়া শরীর, নাম আরতি লুসাই, সেখানে ছিল। আমাদের দেখে কথা বলল ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায়। তৃষ্ণা মেটাল পাহাড়ি ঝর্নায়। ক্লান্তি সরালো কলায় আর পাহাড়ি টানের কথায়।
সেই উঠান পার হয়ে আমরা যাই আরেকটু উচুতে। যেখানে উঠান নেই, উঠানের পাশে বাড়ি নেই, বাড়ির মাঝে মানুষ নেই। সেই উচু চূড়া কংলাক এ পৌঁছেই আবিষ্কার করি নতুন সাজেক। চারপাশে নিস্তব্ধ পাহাড়ের সারি। সেই নিস্তব্ধতা ভাঙতে নেই কোন মানবকন্ঠ, বরং একটানা গেয়ে চলে অনেক ঝিঝি পোকা। সেখানে গিয়ে আমরা আবার বসি। মেঘের সাথে পাহাড়ের মিতালি দেখি। সুর্যের আলোকরশ্মি সেই মেঘের ওপর তখন তীব্র আলো ফেলে চলছে। আর মেঘ সেই আলোর মাঝে হেটে চলেছে সাজেক উপত্যকা জুড়ে।

মেঘ পাহাড়ের মিতালি
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জানুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ১:০৬
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×