somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

না বলা কথাটুকু

১২ ই এপ্রিল, ২০১০ রাত ৯:৩৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

স্বাধীনতার পর পরীক্ষা না দিয়েই সবাই অটোপ্রমোশন পেলো। আমিও ক্লাস সিক্সে উঠে গেলাম। আব্বার বদলী সুত্রে সিলেটে এসে ভর্তি হলাম সিলেট সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে। তখন বছরের মাঝামাঝি। কিন্তু সরকারি চাকুরেদের সন্তানের কোটায় সুযোগ পেলাম। নতুন স্কুল, নতুন মুখ তবে সবার সাথে মিশে যাবার গুন থাকার কারনে কোন অসুবিধেই হয়নি। কিছদিন পরে আরো একটি নতুন মুখ এলো। কী মিষ্টি চেহারা, কারো কন্ঠস্বর যে এতো মিষ্টি হতে পারে তা আগে জানা ছিলোনা। রেশমি ফাপানো চুল। আহ্লাদি কথা বলার ভঙ্গি। কিভাবে যেনো দুজনে হরিহর আত্মা বন্ধু হয়ে গেলাম। দুজন দুজনকে একদিন না দেখে থাকতে পারিনা। ওর নাম নিপা। বাবা ডাক্তার। ময়মনসিং থেকে এলেও পড়ালেখার হাতেখড়ি ইংলেন্ডে। আমার সাথে থেকে নিপাও গল্পের বইএর পোকা হয়ে উঠলো। বই পড়ার আগে আমার কাছ থেকে গল্পটা শুনেই নিপা কাঁদতো। ক্লাসে সবার কাছেই প্রিয় ছিলাম। তারউপর এমন বন্ধু পেয়ে আমি যেন আকাশে উড়ছিলাম। পরিক্ষার সময় আমার ঠিক পিছনের বেঞ্চেই ছিলো নিপা। বাংলা পরিক্ষার সময় ওকে খাতা দেখাতে হত। অবশ্য ইংরেজি পরিক্ষায় ও আমায় দেখাতো। ক্লাস সেভেনে উঠলাম। একসাথে বসা, গল্প চলতে থাকলো। স্কুল ছুটির পর আমরা গল্পে এতোটাই মশগুল থাকতাম, দিনের আলো নিভে রাস্তার আলো জ্বলে উঠেছিলো একদিন। আর একদিন সন্ধ্যায় হন্তদন্ত হয়ে ভাইয়া এসে আমাদের আবিস্কার করেন আমরা গল্পে মশগুল। গরমের দিনে তখন একমাস গ্রীস্মের ছুটি দেয়া হত। এর দুদিন আগে বাসায় ফেরার সময় অন্য রিক্সা থেকে একটি ছেলে একটি কাগজের টুকরো আমার কোলে ছুড়ে দেয়। গড়িয়ে পড়ে তা আমার পায়ের কাছে। কুড়িয়ে নিয়ে ঘামতে ঘামতে বাসায় এসেই বাথরুমে ঢুকে চিরকুটটা পড়লাম। গল্পের বই পড়ে পড়ে আমি অল্প বয়সেই অতি রোমান্টিক ছিলাম। তাই ধরে নিয়েছিলাম, ওটা নিশ্চয় আমাকে লিখা প্রেমপত্র হবে। আশা ভংগ হলো। আমাকেই লিখা, তবে প্রেমপত্র নয়। ইনিয়ে বিনিয়ে বোনের কাছে ভাইএর আকুতি। নিপাকে ছেলেটি কত পছন্দ করে তারই বর্ননা। আর আমাকে অনুরোধ, যেনো নিপার কাছে তার আকুতি বুঝিয়ে বলি। পরদিন স্কুলে চিঠিটা নিয়ে নিপা কে দেখালাম। কেনো যেনো নিপা চিঠিটি নিজের কাছে রাখতে চাইলো। আপত্তি করার কিছুই নেই। চিঠিটি আমাকে লেখা হলেও বিষয় বস্তু তো আমি নই। আমি সানন্দে চিঠিটি ওকে দিয়ে দিলাম। পরদিন থেকে স্কুল একমাসের জন্য বন্ধ। আমি নানাবাড়ী কুষ্টিয়া চলে গেলাম। ফিরে এসে যেদিন প্রথম স্কুলে গেলাম, নিপাকে পেলাম না। দুদিন পর নিপা স্কুলে এলো। তবে অন্য সেকসনে গিয়ে বসলো। হতবাক আমি ছুটে গেলাম ওর কাছে, কি হয়েছে? কি ব্যাপার? ও ঠোটের উপর হাত রেখে বলল “টিফিনের সময় কথা হবে”। ওর চোখদুটো ছলছল। টিফিনের সময় যা শুনলাম, তাতে আমি স্তম্ভিত। ঐ চিঠিটা নিপা বাসায় নিয়ে বইএর ভাঁজে রেখেছিলো। সে চিঠি নিপার আম্মা বের করে পড়েছেন। পড়ে তো আমার উপর রেগে আগুন। নিপা যতই বোঝানোর চেষ্টা করেছে, যে আমার কোনই দোষ নেই, উনি তা মানতেই রাজি নন। হুকুম জারী হলো, আমার মত বাজে মেয়ের সাথে কোন মতেই নিপার মেলামেশা চলবেনা। নিপার ফুপুদেরকে বলা হলো, স্কুলে নিপার দিকে কড়া নজর রাখতে যাতে আমার সাথে না মিশতে পারে। স্কুলে এসে হেডমিস্ট্রেস কে বলে নিপাকে অন্য সেকসনে নেয়া হলো। নিপা আমার হাত ধরে বলছিলো, আমাকে কেউ আটকে রাখতে পারবেনা, আমি রোজ টীফিনের সময় তোমার সাথে কথা বলবো। আমরা দুজনই পুকুর পাড়ে চলে যাবো। করুন চোখে নিপা আরও কি বলেছিলো, আমার কানে কিছুই ঢুকেনি। অপমানে, লজ্জায় আমার কান-মাথা ঝা ঝা করছিলো। কোন অপরাধ না করেও কেনো আমায় শাস্তি পেতে হবে? বাসায় ফিরেও কাউকে বলতে পারিনি এ অপমানের কথা। তারপর নিপার সাথে আমার কথা হতো। কিন্তু কোথায় যেন তাল কেটে গিয়েছিলো। বাংলা পরীক্ষার সময় নিপার লেখা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি সিটে বসে থাকতাম। ওর ইচ্ছে মত আমার খাতা ওর কাছে টেনে নিয়ে ও লিখেছে। আমি বাধা দেইনি। কিন্তু ওর খাতা আমি আগের মত দেখতে পারিনি। টিফিনে ক্লাসে না থাকলে নিপা এসে আমার খাতায় অনেক কিছু লিখে যেতো। ওকে আমি খুব ভালোবাসতাম। কিন্তু এক অপমানবোধ আমাকে কুড়ে কুড়ে খেয়েছে। স্কুল জীবন শেষ করে নিপা ঢাকায় চলে গেলো। আর ওর সাথে আমার দেখা হয়নি। বিয়ের বেশ অনেক বছর পর ঢাকায় এক আত্মিয়ের বাসায় নিপার আম্মার সাথে দেখা।
উনার উচ্ছসিত ব্যাবহারে মনেই হয়নি আমি বাজে মেয়ে। উনার কাছেই জানলাম, নিপা ঢাকা ভার্সিটি থেকে আই,আর
থেকে মাস্টার্স করে এখন স্বামীর সাথে জাপান থাকে। তারপর লোকমুখে শুনেছি, নিপা কানাডা আছে, ফুটফুটে দুটি
বাচ্চা আছে ওর। নিপার পরে আমার জীবনে বন্ধু হিসেবে আর কেউ আসেনি। এমনিতেই আমার চারি পাশে অনেকেই
ছিলো, আছে, কিন্তু আমি কাউকেই বন্ধু মনে করতে পারিনি। সবার সাথে সু-সম্পর্ক। অনেকের কাছে নিপার ঠিকানা
ফোন নম্বর জানতে চেয়েছি। কিন্তু পাইনি। একদিন ফেসবুকে আমার বড় ভাইএর বন্ধু, নিপাদের আত্মিয় একজনকে
খুজে পেয়ে জানতে চেয়েছিলাম, নিপার ঠিকানা, ফোন নম্বর। ফোন নম্বর পেয়েছিলাম। ফোন করেছি কানাডায়। আন্সারিং
মেশিনে পরিচয় দেইনি, শুধু বলেছিলেম, ৩৩ বছর পর তোমার খোজ পেলাম, পরে আবার ফোন করবো।
দুদিন পর রোববারে ফোন করেছি। ফোন ধরলেন একজন পুরুষ। নিপাকে চাইতেই বললেন, “হোল্ড করুন”। নিপা কে
ডাকছেন শুনতে পেলাম, “নিপা তাড়াতাড়ি এসো, তোমার ঐ বান্ধবী মনে হচ্ছে”। ৩৩ বছর পর সেই ময়না পাখীর মত মিষ্টি গলা শুনতে পেলাম। আমার সে অনুভুতি বোঝানোর ভাষা নেই। যারা বন্ধুকে সত্যিকারের ভালোবাসেন, তারা ঠিকই বুঝতে পারবেন। এর পর ফেসবুকে সেই প্রিয় মুখ দেখতে পেলাম। ফেসবুকের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আমার জীবনের একমাত্র বন্ধু কে চোখের দেখা দেখতে দেয়ার জন্য। আর ব্লগের কাছে আমি কৃতজ্ঞ, এতো বছর চেপে রাখা অপমান, দুঃখ খুলে বলার সুযোগ করে দেয়ার জন্য। আমার বুকের পাষান ভার বয়ে নিয়ে চলেছি এতোদিন। কাউকে বলতে পারিনি এ লজ্জার কথা, কাউকেই না। আজ আপনাদের কাছে বলে ভারমুক্ত হলাম। নিপার আম্মার প্রতি এখন আমার কোন ক্ষোভ নেই। বরং উনার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। কারন উনার এই নিষ্ঠুর আচরনের ফলেই পরবর্তী জীবনে আমি আমার সন্তানদের সাথে বন্ধু-সুলভ আচরন করে তাদের বন্ধু হয়েছি। আর আমি কখনো স্বজ্ঞ্যানে কাউকে আঘাত করে কথা বলিনি, নিজে অপমানিত হলেও পালটা অপমান করিনি। আমি জেনেছি, ভুল এমন এক মারাত্তক আগাছা, যা মনের মাটিতে খুব দ্রুত বিস্তার লাভ করে। ঘর টুকু পুড়ে গেলেও ছাই
টুকু লাভ। এ আমি নিজের জীবনে বুঝেছি।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জুন, ২০১১ সন্ধ্যা ৬:২৬
৪৬টি মন্তব্য ৩৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাদির আসল হত্যাকারি জামাত শিবির কেন আলোচনার বাহিরে?

লিখেছেন এ আর ১৫, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:৫৪


গত মাসের শেষের দিকে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পারওয়ারের ছেলে সালমান, উসমান হাদির সঙ্গে খু*নি ফয়সালের পরিচয় করিয়ে দেন। সেই সময় হাদিকে আশ্বস্ত করা হয়—নির্বাচন পরিচালনা ও ক্যাম্পেইনে তারা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশ একদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াবেই

লিখেছেন নতুন নকিব, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১:৫৩

বাংলাদেশ একদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াবেই

ছবি এআই জেনারেটেড।

ভিনদেশী আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে সত্যের বজ্রনিনাদে সোচ্চার হওয়ার কারণেই খুন হতে হয়েছে দেশপ্রেমিক আবরার ফাহাদকে। সেদিন আবরারের রক্তে লাল হয়েছিল বুয়েটের পবিত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজাকারের বিয়াইন

লিখেছেন প্রামানিক, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:০৪


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

রাজাকারের বিয়াইন তিনি
মুক্তিযোদ্ধার সন্তান
ওদের সাথে দুস্তি করায়
যায় না রে সম্মান?

কিন্তু যদি মুক্তিযোদ্ধাও
বিপক্ষতে যায়
রাজাকারের ধুয়া তুলে
আচ্ছা পেটন খায়।

রাজাকাররা বিয়াই হলে
নয়তো তখন দুষি
মেয়ের শ্বশুর হওয়ার ফলে
মুক্তিযোদ্ধাও খুশি।

রচনা কালঃ ১৮-০৪-২০১৪ইং... ...বাকিটুকু পড়ুন

দিপুকে হত্যা ও পোড়ানো বনাম তৌহিদী জনতা!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:০৫


পাইওনিয়ার নিটওয়্যারস বিডি লিমিটেড (Pioneer Knitwears (BD) Ltd.) হলো বাদশা গ্রুপের (Badsha Group) একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। বাদশা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান কর্ণধার হলেন জনাব বাদশা মিয়া, যিনি একইসাথে এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

সাজানো ভোটে বিএনপিকে সেনাবাহিনী আর আমলারা ক্ষমতায় আনতেছে। ভোট তো কেবল লোক দেখানো আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।

লিখেছেন তানভির জুমার, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:২২



১০০% নিশ্চিত বিএনপি ক্ষমতায় আসছে, এবং আওয়ামী স্টাইলে ক্ষমতা চালাবে। সন্ত্রাসী লীগকে এই বিএনপিই আবার ফিরিয়ে আনবে।সেনাবাহিনী আর আমলাদের সাথে ডিল কমপ্লিট। সহসাই এই দেশে ন্যায়-ইনসাফ ফিরবে না। লুটপাট... ...বাকিটুকু পড়ুন

×