নবীন সন্ধ্যায় দরজায় নক পড়লো। টুকটুক–টুকটুক। অপরিচিত আওয়াজ। দরজা খুলে দেখি সফেদ শ্মশ্রুমণ্ডিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দাঁড়িয়ে আছেন। বিস্মিত আমি তড়িঘড়ি গুরুজীকে রুমের ভেতর এনে বসালাম। গুরুজী গুরুগম্ভীর। আমিই কথা শুরু করলাম। বললাম, গুরুজী আপনি কোথা হইতে আবির্ভূত হলেন?
গুরুজী সাধু পুরুষ এজন্য তাঁর উপস্থিতিতে আমার কথার মাঝেও কেমন গুরুচণ্ডালী দোষ দেখা দিলো অটোম্যাটিক–
‘চান্দের দেশ থেকে।’ গুরুদেব গুরুগম্ভীরভাবে উত্তর দিয়েই শ্লোক আওড়ালেন, চান্দের দেশে বাসা বেঁধেছি/ডাঙ্গায় বড় কিচিমিচি/সবাই গলা জাহির করে/চেঁচায় কেবল মিছিমিছি—
— চান্দের দেশে কোন সমস্যা হয় না আপনার? আমি গুরুজীর শ্লোকের উচ্চপ্রশংসা শেষে প্রশ্ন করলাম।
গুরুজী বললেন, নাহ! তবে প্রখর পূর্ণিমায় মাঝে মাঝে জ্যোৎস্নাফোবিয়ায় আক্রান্ত হই। জ্যোৎস্নার বাড়াবাড়ি সৌন্দর্যে তখন ভয়ানক অস্বস্তি লাগে।
গুরুজী যে গত হয়েছেন এই ব্যাপারটা আমার মাথায় ঠিকই আছে। গুরুজীর উপস্থিতি আমাকে বিভ্রান্ত করতে পারলো না। আমি তাই বললাম, গুরুজী চাঁদ নিয়ে আপনার কি কোন স্মৃতি মনে পড়ে যখন আপনি কবি ছিলেন?
গুরুজী আমার পিঠে আলতো চাপড় মেরে বললেন, কবি তো আমি এখনো আছি বালক। চান্দের দেশেও আমি কবিতা লিখি। হ্যাঁ, যখন জোড়াসাঁকোয় ছিলাম একদিন গরমকালের বিছানায় শুয়ে আছি। চান্দের আলো এসে মুখে পড়ছিলো। মহাদেবকে ডেকে বললাম, ‘ওরে মহাদেব চাঁদটা ঢেকে দে না! ঘুম হচ্ছে না।’ চাঁদ তো সেই দূর আকাশে। মহাদেব ব্যাপক দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলো। সে বুঝতে পারলো না কিভাবে চাঁদকে ঢেকে দেবে। ওর নিরুপায় অবস্থা দেখে বললাম, ‘ওরে পারছিস নে চাঁদরে ঢাকতে। আচ্ছা এককাজ কর ওই জানালাটা বন্ধ করে দে।
গুরুজীর রসবোধ দেখে আমি মুগ্ধ হলাম। বললাম, গুরুজী আপনি তো কালিদাসের কালে কবি হতে চেয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘আমি যদি হতাম কবি কালিদাসের কালে।’ আপনার সেই অভিপ্রায় কি এখনো আছে?
গুরুজী মুচকি হেসে বললেন, নাহ! অভিপ্রায়ে পরিবর্তন এসেছে। আমার এখন ডিজিটাল যুগের কবি হতে মন চায়। কবিতার লাইনেও তাই পরিবর্তন আসবে এখন –
আমি যদি হতাম কবি ফেসবুকেরই কালে—
সারাদিন কবিতা পোস্টাইতাম সকালে বিকালে
— হা হা হা । গুরুজী আপনি তো অনেক মজার মানুষ। সুখি মানুষ। আপনার কি কোন কষ্ট নেই?
গুরুজী আবার গম্ভীর হলেন। বললেন, কষ্ট তো পেয়েছিলাম বঙ্গভঙ্গের সময়। সে সময় অনেক ছুটাছুটিও করতে হয়েছে। একদিন নাটোরের মহারাজা তার মেয়ের বিয়েতে আমায় নিমন্ত্রণ করলেন। মহারাজার বাড়িতে সেদিন পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। মহারাজা আমাকে দেখে বললেন, কবি, আমার কন্যা-দায়, কোথায় আপনি সকাল সকাল আসবেন, তা না, আপনি দেরীতে এলেন।’ আমি অপ্রতিভ হয়ে বললাম, ‘রাজন, আমারও মাতৃ-দায়, দু’ জায়গায় সভা করে আসতে হলো।’
গুরুজী কথা বলতে বলতে হাঁপিয়ে উঠলেন। আমি তাঁকে খাওয়া দাওয়ার অফার করলাম। বললাম, গুরুজী আপনি কি আমার এখানে কিছু খেতে সংকোচ বোধ করবেন?
গুরুজী তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলেন, খাওয়া দাওয়ায় আমার কোন সংকোচ নেই। তুমিও এই ব্যাপারে কোন সংকোচ রাখবে না। অসংকোচে করিবে ভোজন কষে/ সাবধানতা সেটা যে মহারোগ/ যকৃত যদি বিকৃত হয় স্বীকৃত রবে/ কিসের ভয় না হয় তবে পেটের গোলযোগই হবে।
আমি লাফ দিয়ে উঠলাম। চেঁচিয়ে বললাম, মারহাবা! মারহাবা!
গুরুজী আমার প্রশংসাধ্বনি থামিয়ে দিয়ে বললেন, খাওয়ানোর আগে বালক একখান স্ট্যাটাস পোস্টাও আগে। আমার জন্মদিনে আজ অথচ একখান স্ট্যাটাস পর্যন্ত পোস্টাইলে না। এ কেমন বিচার তোমার!
আমি দুঃখিত হয়ে বললাম, ওহ! স্যরি গুরুজী—শুভজন্মদিন–
ঠিক আছে– ঠিক আছে– দুঃখ প্রকাশের জন্য ইংরাজদের ভাষা ধার করার স্বভাবটা তোমাদের এখনো যায়নি। এইবার একখান ধাঁধার উত্তর দাও, তিন অক্ষরের এমন একটা শব্দের নাম বলো যার প্রথম অক্ষর ছেড়ে দিলে ‘কান’ থাকে না, দ্বিতীয়টা ছেড়ে দিলে ‘মান’ থাকে না, আর পুরোটা ছেড়ে দিলে প্রাণ থাকে না।
গুরুজীর ধাঁধার মধ্যে পড়ে আমি পুরাই কনফিউজড হয়ে গেলাম। ভোজন শেষে চলে যাওয়ার সময় গুরুজী নিজেই ধাঁধার উত্তর দিলেন। বললেন, শব্দটা হলো—‘কামান’।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই নভেম্বর, ২০১৫ দুপুর ২:১৫