somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমাদের উচ্চ শিক্ষার সংকট : একটি পর্যালোচনা

০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০০৯ বিকাল ৩:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



এই মোর অভিশাপ - যে বিদ্যার তরে
মোরে করো অবহেলা, সে বিদ্যা তোমার
সম্পূর্ণ হবে না বশ, তুমি শুধু তার
ভারবাহী হয়ে রবে, করিবে না ভোগ,
শিখাইবে, পারিবে না করিতে প্রয়োগ।
(বিদায় অভিশাপ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

দেবযানীর শাপে গুরুগৃহে সহস্র বৎসরের সাধনায় অর্জিত তত্ত্বগতবিদ্যা প্রায়োগিক ক্ষেত্রে কাজে লাগাতে পারবে না কচ। কচের এই সুদীর্ঘ্যদিনের বিদ্যাসাধনা হয়ে যাবে নিস্ফল- সে হবে অর্জিত বিদ্যার ভারবাহীমাত্র। বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষার সার্বিক বিশ্লেষণে রবীন্দ্র কাব্যের বিদায় অভিশাপের উপরোক্ত পংক্তিমালা খুব বেশী প্রাসঙ্গিক।

সংখ্যাগত হিসেবে বাংলাদেশে গত এক দশকে উচ্চ শিক্ষা ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটেছে বললে অত্যুক্তি হবে না। সাধারন্যের সনদমুখী শিক্ষার আকাঙ্খায় দেশে সরকারী/ বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় সহ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শতাধিক উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। দেশে স্নাতক/স্নাতকোত্তর জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়ছে জ্যামিতিক হারে। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, আমাদের দেশের মতো যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য সহ উন্নত বিশ্বে ঘরে ঘরে স্নাতক/ স্নাতকোত্তর ডিগ্রীধারী পাওয়া যাবে কিনা যথেষ্ঠ সন্দেহ রয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই ভাবেই প্রশ্ন ওঠে, দেশের ‘উচ্চশিক্ষিত’ জনগোষ্ঠীর সংখ্যাগত বিপ্লব ঘটলেও দেশের সার্বিক উন্নয়নে এর প্রভাব পড়ছে না কেন? বিশ্বায়নের এই যুগে শিল্প কারখানার উৎপাদনে, ব্যবসা বানিজ্যে প্রযুক্তিগত উন্নয়নে আমরা কেন পিছিয়ে পড়ছি? জ্ঞান - বিজ্ঞানের মৌলিক গবেষনায় আমরা কেন পারছি না মেধার সাক্ষর রাখতে? কেন আমাদের দেশ বারবার বিশ্বের নিকৃষ্টতম দূর্নীতিবাজ দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করছে? এসব প্রশ্নের উত্তর জানা যাবে আমাদের উচ্চ শিক্ষার সংখ্যাগত নয় বরং গুনগত মান অনুসন্ধানে।

বাংলাদেশে মূলতঃ তিনটি ধারায় উচ্চ শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। প্রথমটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, যার অর্ন্তভুক্ত দেশের বিভিন্ন সরকারী/ বেসরকারী ডিগ্রী কলেজ সমূহ। দ্বিতীয় ধারা হচ্ছে সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়। তৃতীয় ধারায় রয়েছে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়, যেগুলোর ইতিহাস অতি সাম্প্রতিক।

প্রথমেই আসা যাক জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রসঙ্গে। এরশাদ শাসনামলে, নব্বইয়ের দশকের শেষার্ধে সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপর চাপ কমানো এবং সেই সাথে সেশন জট দূরীকরনের লক্ষ্যে স্নাতক/ স্নাতকোত্তর ডিগ্রীপ্রদানকারী সরকারী/ বেসরকারী কলেজ সমূহকে আওতাভুক্ত করে প্রতিষ্ঠিত হয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। এতে সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপর চাপ কমলেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অন্যতম লক্ষ্য সেশন জট কমানোর ক্ষেত্রে কোন সাফল্য অর্জিত হয়নি বরং প্রাশাসনিক এই পরিবর্তনে সেশন জট আরো জটিলতর আকার ধারণ করেছে। এর প্রধানতম কারণ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাশাসনিক দূর্বলতা, অদক্ষতা, এবং সেশন জট দূরীকরণের কার্য্যকরী উদ্যোগের অভাব। দেশের সর্বোচ্চ সংখ্যক উচ্চ শিক্ষারত ছাত্র-ছাত্রী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্ন্তভূক্ত হলেও এই ধারার শিক্ষা ব্যবস্থার সার্বিক উন্নয়নে সরকারের কোন বাস্তবসম্মত এবং ফলপ্রসু প্রচেষ্টা নেই বললেই চলে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় সরকারী এবং বেসরকারী এই দুই ধারার কলেজগুলোতে শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতিতে রয়েছে বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা। সরকারী কলেজ সমূহে সরকারী কর্মকমিশনের মাধ্যমে নিয়োগ পদ্ধতি বহাল থাকলেও কমিশনের সীমাহীন দূর্নীতির কারণে যোগ্যতর প্রার্থীরা প্রায়শঃই নিয়োগলাভে বঞ্চিত হয় । প্রসঙ্গত একথা উল্লেখ্য যে, প্রথম সারির মেধাবীরা কলেজ শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নিতে কমই আগ্রহী হোন। এর কারণ প্রথমতঃ কলেজ শিক্ষকদের পদোন্নতিতে দীর্ঘ্যসূত্রিতা এবং দ্বিতীয়তঃ সরকারী কলেজে বদলীযোগ্য এই চাকুরীকে পেশা হিসেবে নিতে অনেকেরই অনীহা। এছাড়া সরকারী কর্মকমিশনের নিয়োগ প্রক্রিয়ার শ্লথগতি, বাজেট স্বল্পতা প্রভৃতি কারণে সরকারী কলেজগুলোতে ছাত্র অনুপাতে শিক্ষক সংখ্যা অপ্রতুল।

বেসরকারী কলেজগুলোর শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া আরো শোচনীয়। এসব কলেজগুলোর পরিচালনা পরিষদের সভাপতি পদাধিকারবলে মেধাশুন্য দূর্নীতিবাজ স্থানীয় সংসদ সদস্যরা হওয়ার ফলশ্রুতিতে তাদের কলুষ দূষণ রীতিনীতি এখানেও পরিলক্ষিত। শিক্ষক নিয়োগে স্বজনপ্রিয়তা, আর্থিক দূর্নীতি সহ বিভিন্ন অভিযোগে বেসরকারী কলেজগুলো নিমজ্জিত। তাই সামগ্রিক বিচারে বলা যায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাভূক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ প্রক্রিয়া দূর্নীতিগ্রস্থ এবং দূর্বল হওয়ার কারণে যোগ্য প্রার্থীরা শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত হতে পারছেন না। অথচ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর প্রায় তিন দশক পার হলেও এই সমস্যা সমাধানের কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিষয়ের পাঠ্যক্রমেও রয়েছে দূর্বলতা। বর্তমান বিশ্বে জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির ক্ষেত্রে উন্নয়নের ধারা অনেক বেশী দ্রুতগামী। তাই উন্নতবিশ্বে উচ্চতর শিক্ষার পাঠ্যক্রম প্রতি বছরই পরিবর্তন, পরিবর্ধন হচ্ছে। কিন্ত আমাদের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিষয়ের পাঠ্যক্রম কোন পরিবর্তন, পরিবর্ধন ছাড়াই বছরের পর বছর চালানো হচ্ছে। এ ছাড়া অনেক কলেজে ব্যবহারিক বিষয়ে উপযুক্ত গবেষনাগারের অভাব থাকলেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষ এ বিষয়ে থাকে অনেকটা নির্লিপ্ত। মোদ্দা কথা, দুচারটি ব্যতিক্রমী প্রতিষ্ঠান বাদ দিলে সার্বিকভাবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাভূক্ত কলেজগুলোতে চলছে শিক্ষার নামে প্রসহন।

এবার আসা যাক সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় প্রসঙ্গে। দেশের অগ্রগামী বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এক সময় শুধুমাত্র এই উপমহাদেশে নয় বরং সারা বিশ্বে এর অস্তিত্ব ছিল আপন বিভায় সমুজ্জল। এক সময়ে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হিসেবে পরিচিতি প্রাপ্ত এই বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকেই স্বনামধন্য পদার্থবিদ সত্যেন বসু হতে পেরেছিলেন আইনস্টাইনের যুগান্তকারী গবেষনা সহযোগী। পরিসংখ্যানে ডঃ কাজী মোতাহের হোসেন, ভাষা গবেষনায় ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ , দর্শনে ডঃ জি.সি দেব সহ প্রতিভাদীপ্ত অনেক মনীষির পদভারে মুখরিত ছিল এই বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর, যারা ছিলেন স্ব স্ব ক্ষেত্রে একেকটি মাইল ফলক। এহেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান দৈন্য দশা ভাবতে সত্যিই কষ্ট হয়। বিশ্বময় বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিং তালিকায় প্রথম চার হাজারের মধ্যেও বাংলাদেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্তিত্ব নেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গত কয়েক দশকে যতটা না অপরাজনীতি চর্চিত হয়েছে তার সিকি ভাগও জ্ঞান- বিজ্ঞান চর্চিত হয়েছে কীনা এ বিষয়ে যথেষ্ঠ সন্দেহ রয়েছে। লেজুড়বৃত্তি ছাত্র/ শিক্ষক রাজনীতি, লাল- গোলাপী- সাদা বলয়ে জাতীয় রাজনীতি নির্ভর শিক্ষক সমিতি শুধুমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয় বরং প্রতিটি সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা পরিবেশকে করেছে কলুষিত। এই কলুষ শিক্ষা পরিবেশে সত্যিকার মেধাবী ছাত্ররা আজ দিশেহারা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রায় প্রতিটি সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে অনিয়মের কারণে অনেক সত্যিকার মেধাবী প্রার্থী নিয়োগ প্রাপ্তিতে হচ্ছেন ব্যর্থ। এ প্রসঙ্গে গত জোট সরকারের আমলে রাজশাহী ও চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বহুল সমলোচিত, দলীয় বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া উল্লেখ যোগ্য। পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন একটি বিশেষ দলের প্রতি আনুগত্যের মুচলেকা দিয়ে শিক্ষকপদে নিয়োগ লাভের তথ্য আজ সর্বজন বিদিত। এর চেয়ে লজ্জাস্কর জিনিস আর কি হতে পারে!

সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রাশাসনিক পদ উপাচার্য থেকে শুরু করে উপ-উপাচার্য, ডীন, প্রভোষ্ঠ, হাউজ টিউটর পর্য্যন্ত নিয়োগদান করা হয় রাজনৈতিক বিবেচনায়। এই অপসংস্কৃতির ফলশ্রুতিতে অনিবার্য্যভাবেই উচ্চাভিলাষী শিক্ষকরা হয়ে পড়ছেন রাজনৈতিক ক্রীড়নক এবং নিরীহ শিক্ষকরা হচ্ছেন পেশাগত জীবনে হতাশাগ্রস্ত । স্বাভাবিকভাবেই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে শিক্ষা কার্যক্রমে। তাই দেখা যায়, তহবিলের অভাব না থাকলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে গবেষনাভিত্তিক নিয়মিত সেমিনার/ কনফারেন্স আয়োজনের উদ্যোগের অভাব।

প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিষয়ক উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোর অবস্থাও তথৈবৈচ। এক সময় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ডাক ছিল। কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়টিও হয়ে পড়েছে অবক্ষয়ের শিকার। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যায় আমাদের প্রতিবেশী ভারতের প্রকৌশল ও প্রযুক্তি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ভারতের শিল্প বিকাশ প্রক্রিয়ায় বিশেষ অবদান রাখছে। কিন্তু আমাদের দেশে জাতীয় শিল্প প্রযুক্তি বিকাশে এ বিশ্ববিদ্যালয়টির সরাসরি কোন উদ্যোগ তেমনটি পরিলক্ষিত হয় না। অবশ্য বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব একটি ভাবমূর্তি রয়েছে। এর মূল কারণ দেশের প্রথম সারির মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীরা এ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করার কারনে-- অন্য কোন কারনে নয়।

শাহ্‌জালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রাপথ শুরু করেছিল আশার আলোর ঝলকানীতে । নষ্ট রাজনীতির প্রভাবে এই বিশ্ববিদ্যালয়েরও শিক্ষার পরিবেশ আজ বিঘ্নিত। শাহ্‌জালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অবক্ষয়ের স্বরূপ অধ্যাপক জাফর ইকবালের লেখায় প্রতিফলিত। দেশের অন্যান্য নব প্রতিষ্ঠিত প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (যেমন মৌলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়) সহ পূর্বতন প্রকৌশল মহাবিদ্যালয় থেকে উন্নীত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবকাঠামোতে রয়েছে অনেক দূর্বলতা। শিক্ষক স্বল্পতা, গবেষনাগারের অভাব এসব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে খুবই প্রকট। এছাড়া অন্যান্য সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতই এগুলোতেও রয়েছে দূর্নীতি এবং কলুষ রাজনীতির প্রভাব।

সম্ভবত: তুলনামূলক বিবেচনায় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান অনেকটা ভালো। আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে কৃষি গবেষনায় এর অবদান অনস্বীকার্য । তবুও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছে জাতীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি করার প্রবণতা, যা শিক্ষার সুস্থ পরিবেশকে প্রায়শঃই করে তুলে অস্থির। অন্যান্য কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ ( যেমন শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়) অপেক্ষাকৃত নতুন হওয়ায় শিক্ষক স্বল্পতা সহ বিভিন্ন ধরণের অবকাঠামোগত সমস্যা এখনো বিদ্যমান।

দেশের সরকারী চিকিৎসা মহা বিদ্যালয়গুলো, যেগুলোতে এম.বি.বি.এস ডিগ্রী দেওয়া হয় ( যেমন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ) সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অর্ন্তভূক্ত। সরকারী মেডিক্যাল কলেজগুলোও দেশের নেতিবাচক রাজনীতির প্রভাবমুক্ত নয়। মেডিক্যাল কলেজগুলোর দৈন্য দশার পরিচয় মেলে কলেজগুলোর সহযোগী হাসপাতালগুলোর অবস্থা বিবেচনায় । এছাড়া মেডিক্যাল কলেজগুলো আর্ন্তজাতিক স্বীকৃতি এখনো অর্জন করতে পারেনি। দেশের একমাত্র স্নাতকোত্তর চিকিৎসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজীব বিশ্ববিদ্যালয় গত কয়েক বছরে রূপান্তরিত হয়েছে রাজনৈতিক আখড়ায় । এর ফলে চিকিৎসা শাস্ত্রে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী প্রদানকারী এই প্রতিষ্ঠানটি আজ ধ্বংসের মুখোমুখী।

এবার আসা যাক বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রসঙ্গে। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ইতিহাস অতি সামপ্রতিক। তাই বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের প্রায় প্রতিটিতে রয়েছে অবকাঠামোজনিত সংকট। বেশীর ভাগ বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্নকালীন শিক্ষকের অভাব, ক্যাম্পাস দৈন্যতা, লাইব্রেরীতে প্রয়োজনীয় বইয়ের অভাব দৃশ্যমান। বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রথম সারির চার/ পাঁচটিকে বাদ দিলে বেশীর ভাগই শিক্ষার গুনগত মানের দিকে লক্ষ্য দেয় না বললে অত্যুক্তি হবে না। বেশীরভাগ বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাজারমুখী বিষয়াবলীর (যেমন বি.বি.এ, কম্পিউটার সায়েন্স ইত্যাদি) বিভাগগুলোই এখন পর্যন্ত চালু করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পূর্ণ মর্য্যাদা পেতে হলে প্রয়োজন মৌলিক বিষয়াবলীর (যেমন বাংলা, ইংরেজী, গনিত, পদার্থ বিদ্যা ইত্যাদি) বিভাগ স্থাপন। বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে অনেকগুলোরই মূল লক্ষ্য হচ্ছে অসৎ বানিজ্য-- শিক্ষাকে পন্য করে এগুলো কার্য্যতঃ সনদ বিক্রীর প্রতিষ্ঠান হিসেবেই কাজ করে যাচ্ছে। মৌলিক গবেষনার ক্ষেত্রেও সার্বিকভাবে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখনো শৈশব অতিক্রম করেনি। তবে ইতিবাচক দিক হলো, বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জাতীয় কলুষ রাজনীতির প্রভাব মুক্ত।

উচ্চ শিক্ষার পর্যালোচনায় পাঠ্যক্রম হচ্ছে খুবই প্রাসঙ্গিক একটি বিষয়। আমাদের দেশে উচ্চ শিক্ষার পাঠ্যক্রম নিয়ে খুব কমই গবেষনা হয়েছে। প্রায়োগিক বিষয় সমূহের পাঠ্যক্রম হওয়া উচিৎ দেশের চহিদার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। ছাত্র- ছাত্রীরা এই পাঠ্যক্রমের সাথে যেন নিজস্ব আবহ সম্পর্কিত করতে পারে সে বিষয়ে নিশ্চিত করা আবশ্যক। উদাহরণস্বরূপ, আমাদের ব্যবসায় প্রশাসন শিক্ষাক্রমে ফোর্ড, মটোরলা ইত্যাদি বিদেশী কর্পোরেটগুলোর কেস ষ্টাডী হিসেবে প্রায়ই পড়ানো হয়। অথচ আমাদের চট্রগ্রামের ব্যবসায়ী সওদাগর সমপ্রদায় বিংবা পুরানো ঢাকার ঢাকাইয়া ব্যবসায়ী গোষ্ঠী, যারা বংশ পরস্পরায় সার্থক ব্যবসায়ী শ্রেনী হিসেবে চিহিৃত তাদেরকে কেস ষ্টাডী হিসেবে আনলে ছাত্র- ছাত্রীরা তাদের তত্ত্বগত জ্ঞান দেশের নিজস্ব ব্যবসায়িক আবহে অনেক বেশী কাজে লাগাতে পারতো। মৌলিক বিজ্ঞান বিষয়গুলো বাদ দিলে অন্যান্য বিষয়গুলোর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।

সত্যিকার উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ শুধুমাত্র পেশাগত জীবনে নয় বরং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তার অর্জিত শিক্ষাকে কাজে লাগাতে উদ্যোগী হয়। উচ্চ শিক্ষার একটি অন্যতম লক্ষ্য বিষয়ভিত্তিক শিক্ষার পাশাপাশি মানবিক গুনাবলী অর্জন করা। একজন প্রকৃত শিক্ষকই পারেন বিষয় ভিত্তিক জ্ঞান প্রদানের পাশাপাশি ছাত্র- ছাত্রীদেরকে মানবিক গুনাবলীতে উজ্জীবিত করতে। এজন্য শিক্ষকদের হতে হবে অনুসরনীয় আদর্শ বা রোল মডেল। দূর্ভাগ্যবশতঃ নানা কারনে আমাদের শিক্ষক সমপ্রদায় আজ হতে পারছেন না এই অনুসরনীয় আদর্শ। সম্ভবতঃ আমাদের জাতীয় নৈতিক অবক্ষয়ের এটিও একটি বড় কারণ।

পরিশেষে একথা বলা আবশ্যক যে, অভিশপ্ত কচের মতো আমাদের উচ্চ শিক্ষিত জনগোষ্ঠী শুধুমাত্র বিদ্যার ভারবাহী হয়ে পড়লে জাতির উন্নয়ন কখনো সম্ভব হবে না। এই অবস্থা থেকে পরিত্রান পেতে হলে আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে আনতে হবে আমূল সংস্কার।

(প্রবন্ধটি লেখকের স্বনামে সাপ্তাহিক রোববারে প্রকাশিত হয়েছিল)





সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০০৯ বিকাল ৪:৪০
২৯টি মন্তব্য ২৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ইন্দিরা গান্ধীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক: ওরিয়ানা ফলাচির সাক্ষাৎকার

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৫


১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইতালীয় সাংবাদিক ওরিয়ানা ফলাচি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার নেন। এই সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধ, শরনার্থী সমস্যা, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক, আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্ট্রনীতি এবং পাকিস্তানে তাদের সামরিক... ...বাকিটুকু পড়ুন

=যাচ্ছি হেঁটে, সঙ্গে যাবি?=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:০৬


যাচ্ছি হেঁটে দূরের বনে
তুই কি আমার সঙ্গি হবি?
পাশাপাশি হেঁটে কি তুই
দুঃখ সুখের কথা ক'বি?

যাচ্ছি একা অন্য কোথাও,
যেখানটাতে সবুজ আলো
এই শহরে পেরেশানি
আর লাগে না আমার ভালো!

যাবি কি তুই সঙ্গে আমার
যেথায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

আগামী নির্বাচন কি জাতিকে সাহায্য করবে, নাকি আরো বিপদের দিকে ঠেলে দিবে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:১২



আগামী নির্বচন জাতিকে আরো কমপ্লেক্স সমস্যার মাঝে ঠেলে দিবে; জাতির সমস্যাগুলো কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। এই নির্বাচনটা মুলত করা হচ্ছে আমেরিকান দুতাবাসের প্রয়োজনে, আমাদের দেশের কি হবে, সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গু এনালিস্ট কাম ইন্টারন্যাশনাল সাংবাদিক জুলকার নায়েরের মাস্টারক্লাস অবজারবেশন !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:২৬

বাংলাদেশের দক্ষিণপন্থীদের দম আছে বলতে হয়! নির্বাচন ঠেকানোর প্রকল্পের গতি কিছুটা পিছিয়ে পড়তেই নতুন টার্গেট শনাক্ত করতে দেরি করেনি তারা। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ ঘিরে নতুন কর্মসূচি সাজাতে শুরু করেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক্ষমতাচ্যুত ফ্যাসিবাদ: দিল্লির ছায়া থেকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র

লিখেছেন কৃষ্ণচূড়া লাল রঙ, ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ ভোর ৫:৫৭

একটা সত্য আজ স্পষ্ট করে বলা দরকার—
শেখ হাসিনার আর কোনো ক্ষমতা নেই।
বাংলাদেশের মাটিতে সে রাজনৈতিকভাবে পরাজিত।

কিন্তু বিপদ এখানেই শেষ হয়নি।

ক্ষমতা হারিয়ে শেখ হাসিনা এখন ভারতে আশ্রয় নিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

×