বেগম রোকেয়া আমার বিস্ময়
যখন হাই স্কুলে পড়তাম তখন আমাদের পাঠ্য বইয়ে মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়ার দু’একটি প্রবন্ধ ছিল। তাঁর জন্ম ১৮৮০ সালের ৯ই ডিসেম্বর, মৃত্যু ১৯৩২সালের ৯ই ডিসেম্বর। এবার ছিল তাঁর ১৩৪ তম জন্ম ও ৮২তম মৃত্যু দিবস। রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ গ্রামে জন্মেছিলেন তিনি। আমি হাইস্কুলে থাকাকালীন সময়ে জেনেছি শিক্ষার আলোয় নিজেকে আলোকিত করার জন্য তাঁর অসাধারণ প্রচেষ্টার কথা এবং পরে অন্যদেরকে তাঁর জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করার অতুলনীয় সংগ্রামের কথা। উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ পর্যন্ত তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়েই ছিল। সেসময় কেউ নারীদের হেয় করে কথা বললে আমি মনে মনে বেগম রোকেয়াকে স্মরণ করতাম আর ভাবতাম- আমরা কেউ তুচ্ছ নই। বেগম রাকেয়াকে জানলেই সবাই জানবে যে, শত সহস্র পুরুষকে জ্ঞানে, প্রজ্ঞায় হারিয়ে দিতে পারে নারীরা। পুরুষদের চেয়ে নারীরা কোনদিক থেকে কম নয়- তার প্রমাণ স্বরূপ এই দেশ, এই পৃথিবীতে বেগম রোকেয়া এসেছিলেন। শুধু আমরা যারা তাঁকে পড়িনি, তাঁকে বুঝিনি তারাই দুর্বল হয়ে আছি। আমরা চেষ্টা করলেই বেগম রোকেয়ার মত হয়ে উঠতে পারিনা সবাই। অসাধারণদের মত হওয়া কঠিন। তবে তাঁকে অনুসরণ করে নিজেদেরকে উন্নত করতে পারি।
বেগম রোকেয়া নারীদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন যে, “আমরা অকর্ম্মণ্য পুতুল জীবন বহন করিবার জন্য সৃষ্ট হই নাই, একথা নিশ্চিত। ভরসা করি আমাদের সুযোগ্যা ভগনীগণ এ বিষয়ে আলোচনা করিবেন। আন্দোলন না করিলেও একটু গভীরভাবে চিন্তা করিয়া দেখিবেন। ,,(স্ত্রী জাতির অবনতি)।
পারিবারিক ভাবে আমি বাবার নিকট থেকে একজন পুরুষের মত সব রকম সুযোগ-সুবিধা, স্বাধীনতা নিয়ে বড় হয়েছি। একজন শিক্ষক হিসেবে র্কমব্যস্ত থাকি এখন। সমাজ, রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সমস্যা, রাজনৈতিক সমস্যা, মানবিক-অমানবিক লক্ষ কোটি ঘটনা ও তার কার্যকারণ সম্পর্কে কিছু ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে এখন আমি সমর্থ। অনেক কষ্ট হয় যখন দেখি সারা বিশ্বে এখনও নারীরা কোথাও কোথাও সামাজিক, ধর্মীয় নিয়ম কানুন অথবা কুসংস্কারেরর মধ্যে বন্দী, আাবার কোথাও কোথাও পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ভোগ্য বস্তু হিসেবে স্বাচ্ছন্দ্যে নিজেদেরকে বাজারের পণ্য বানিয়ে দাঁত বের করে হেসে দেখাচ্ছে যে, তাদের প্রতি কোন শোষণ নির্যাতন নেই। যদিও পত্রিকার পাতা ও বাস্তব জীবনের সর্বত্র নারীদের প্রতি নির্যাতনের ঘটনার কোন অভাব নেই। স্বাধীন নারী কথাটি বলা আর বাস্তবে স্বাধীন নারীর মত চলা এই দুটি কাজের মধ্যে পার্থক্য অনেক। বেগম রোকেয়া যখন নারী শিক্ষা প্রসারের জন্য কাজ করেছিলেন তখন অন্য অনেক নারীরা পরাধীন থাকলেও ব্যক্তিগত ভাবে তিনি স্বাধীন ছিলেন। ব্যক্তিগত স্বার্থ নিয়ে যদি তিনি ব্যস্ত থাকতেন তবে মানুষরূপী মূর্খ কুকুরদের গালাগালি শুনতে হতনা তাঁকে। অপরিসীম সুখ শান্তিতে বাস করতে পারতেন। কিন্তু নারীসমাজের মুক্তির জন্য অকুল ব্যথার সাগরে একা একা সাঁতার কেটেছেন তিনি।
বেগম রোকেয়া স্বাধীনতার মর্ম বুঝেছিলেন এবং অন্যদেরকে এই মর্ম বোঝানোর জন্য প্রাণপনে লড়াই করেছেন। যদিও তৎকালীন সমাজের অনেকেই তাঁর সমালোচনা করেছেন। যখন তিনি ঘরে ঘরে গিয়ে মুসলিম মেয়েদেরকে তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ে পড়াশুনার জন্য ডাকছিলেন তখন অভিভাবকরা পেপারে তার বিরুদ্ধে এই বলে প্রচার চালিয়েছিলেন যে, “মুসলিম মেয়েদেরকে আপনি ফিরিঙ্গি মেম বানাতে চাচ্ছেন। এসব বরদাস্ত করা হবেনা।”
আজ যখন বাইরের দিক থেকে আমরা নারীরা স্বাধীনতা ভোগ করছি (যেমন: পড়ালেখা করছি, চাকরি ব্যবসা, রাজনীতি করছি) তখন নারী স্বাধীনতার ক্ষেত্রে বেগম রেকেয়ার অবদানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে বাধ্য হচ্ছি। ফলে জাতীয়ভাবে বেগম রোকেয়া দিবস পালন করছি এবং তাকে মহীয়ষী নারী হিসেবে আখ্যায়িত করে সন্তুষ্ট হয়ে বসে আছি। কিন্তু আমরা নারীরা আসলে মানুষের মত স্বাধীনতা নিয়ে এখনও বেশীদূর এগোতে পারিনি।
বেগম রোকেয়া তাঁর “নারী জাতির অবনতি” প্রবন্ধে বলেছিলেন যে, “পুরুষের সমকক্ষতা লাভের জন্য আমাদিগকে যাহা করিতে হয় তাহাই করিব। যদি এখন স্বাধীনভাবে জীবিকা অর্জন করিলে স্বাধীনতা লাভ হয়, তবে তাহাই করিব। আবশ্যক হইলে আমরা লেডী কেরানী হইতে আরম্ভ করিয়া লেডীম্যাজিষ্ট্রেট, লেডিব্যারিষ্টার, লেডীজজ সবই হইব! পঞ্চাশ বৎসর পরে লেডী ভিক্টোরী হইয়া দেশের সমস্ত নারীকে “রানী’করিয়া ফেলিব। উপার্জন করিবনা কেন? আমাদের কি হাত নাই, না পা নাই, না বুদ্ধি নাই? যে পরিশ্রম আমরা স্বামীর গৃহকার্যে ব্যয় করি , সেই পরিশ্রম দ্বারা কি স্বাধীন ব্যবসা করিতে পারিবনা?’’
আজ সারা বিশ্বে শুধু লেডি কেরানি, লেডি বিচারকই নয়, লেডি প্রেসিডেন্ট ও লেডি প্রধানমন্ত্রীও আছেন। কিন্তু' নারীরা এখনও পুরুষের তৈরি একশ একটা অযৌক্তিক, কষ্টদায়ক নিয়মকানুনের মধ্যে বন্দী।
কোন কোন সমাজে নাক চোখ মুখ ঢেকে আবার কোন কোন সমাজে নগ্ন বা প্রায় নগ্ন হয়ে পুরুষতান্ত্রিক সমাজকে খুশি করে বাঁচার চেষ্টা করছে নারীরা। কিন্তু তাঁরা ভাল কিংবা মন্দ যেরকম হয়েই বাঁচার চেষ্টা করুকনা কেন- কোথাও তারা শান্তিতে নেই। সর্বত্র নারীরা আতঙ্কের মধ্যে বাস করছে। সর্বত্র তারা পুরুষদের দ্বারা যৌন নির্যাতনসহ আরও হাজারটা নির্যাতনের শিকার। নারীরা এখনও মানুষের মত স্বাধীনতা নিয়ে বাস করতে পারছে না।
বেগম রোকেয়া দেখিয়েছিলেন যে, জ্ঞান, বিদ্যা বুদ্ধিতে তিনি কোন অংশেই কম নন বরং কোন কোন ক্ষেত্রে পুরুষদের চেয়েও বেশী এগিয়ে গেছেন। যখন মুসলিম নারীরা নারীদের নিকটও পর্দা করত তখন তিনি ধর্ম নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন এই বলে যে, “আমাদেরকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগণ ঐ ধর্মগ্রন্থগুলিকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রকাশ করিয়াছেন। যেখানে ধর্মের বন্ধন অতিশয় দৃঢ় সেইখানে নারীর প্রতি অত্যাচার অধিক।’’ (গ্রন': মতিচুর)।
অথচ আজকে যখন বিজ্ঞানের আলো- ধর্মীয় কুসংস্কার এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দ্বারা নারীদের হেয় কারার অনেক নিয়মকে মিথ্যা প্রমাণ করে দিচ্ছে তখনও নারীরা যুক্তিসঙ্গত কিছু বলতে গেলে কুসংস্কার ও কুশিক্ষায় নিমজ্জিত পুরুষদের গালাগালির শেষ থাকে না। আবার অনেকক্ষেত্রে নারীরাই পুরুষদেরকে নারী নির্যাতন করতে সহযোগিতা করছে। মূলত: বেগম রোকেয়া যেরকম ব্যক্তিত্ববান, মর্যাদাশীল, শিক্ষিত নারীদেরকে সমাজে এবং পরিবারে দেখতে চেয়েছেন সেরকম নারী পৃথিবীতে এখনও অনেক কম আছে। কারণ নারীরা যেন কঠিন, সুন্দর ব্যক্তিত্বের অধিকারী হতে না পারে সেজন্য প্রত্যেক সমাজে, রাষ্ট্রে অনেক ষড়যন্ত্র আছে আজও। আর তাই নারী স্বাধীনতা বাইরের কথা, ভিতরে আমরা নারীরা এখনও পুরুষতান্ত্রিক সমাজের শত সহস্র অপমানজনক নিয়মকানুন ও কুসংস্কারের মধ্যে ছটফট করছি। এখনও আমাদের বিকাশ ঘটছে শুধু পুরুষ তান্ত্রিক সমাজকে খুশি করার জন্য, তাদের পায়ে তেল মালিশ করার জন্য।
বেগম রোকেয়া অশিক্ষা, কুশিক্ষার আঁধারে নিমজ্জিত সমাজে জন্মেছিলেন। সুশিক্ষা আর গভীর জ্ঞানের আলোয় নিজেকে উদ্ভাসিত করেছিলেন এবং অন্যদেরকে উদ্ভাসিত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমরা নারীরা তাঁর দ্বারা কতটুকু আলোকিত হওয়ার চেষ্টা করেছি বা করছি?
বেগম রোকেয়া তাঁর “স্ত্রী জাতির অবনতি” প্রবন্ধে বলেছেন যে, “আমাদের শয়নকক্ষে যেমন সূর্যালোক প্রবেশ করেনা, তদ্রুপ মনোকক্ষেও জ্ঞানের আলোক প্রবেশ করিতে পায়না। যেহেতু আমাদের উপযুক্ত স্কুল কলেজ একপ্রকার নাই। পুরুষ যত ইচ্ছা অধ্যয়ন করিতে পারেন-কিন্তু আমাদের নিমিত্ত জ্ঞানরূপ সুধাভান্ডারের দ্বার কখনও উন্মুক্ত হইবে কি? যদি কোন উদারতো মহাত্মা দয়া করিয়া আমাদের হাত ধরিয়া তুলিতে অগ্রসর হন, তাহা হইলে সহস্র জনে বাঁধা বিঘ্ন উপস্থিত করেন।” (স্ত্রী জাতির অবনতি)
এই যে তিনি সহস্রজনের বাঁধার কথা বলেছেন তা আজকের সমাজেও দূর হয়নি। আজও নারীদের উপর যত পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় শোষণ বিদ্যমান আছে তা নিয়ে কেউ সত্যিকার অর্থে লিখতে গেলে, বলতে গেলে অনেক লোকই চিৎকার, চেচামেচি, গালাগালি শুরু করে দেয়। তবু আমাদের বলতে হবেই। এ ব্যাপারে বেগম রোকেয়া বলেছিলেন, বহুকাল হইতে নারীহৃদয়ের উচ্চবৃত্তিগুলি অঙ্কুরে বিনষ্ট হওয়ায় নারীর অন্তর, বাহির, মস্তিষ্ক, হৃদয় সবই “দাসী হইয়া পড়িয়াছে। এখন আর আমাদের হৃদয়ে স্বাধীনতা, ওজস্বিতা বলিয়া কোন বস্তু নাই-এবং তাহা লাভ করিবার প্রবৃত্তি পর্যন্ত লক্ষিত হয়না।
অতএব জাগ, জাগ গো ভগিনি।
প্রথমে জাগিয়া ওঠা সহজ নহে, জানি; সমাজ মহা গোলযোগ বাধাইবে জানি; ভারতবাসী মুসলমান আমাদের জন্য “কৎল’এর (অর্থাৎ প্রাণদন্ডের) বিধান দিবেন এবং হিন্দু চিতানল বা তুষানলের ব্যবস্থা দিবেন, জানি। কিন্তু সমাজের কল্যানের নিমিত্ত জাগিতে হইবেই। কারামুক্ত হইয়াও গ্যালিলিও বলিয়াছিলেন, কিন্তু যাহাই হউক পৃথিবী ঘুরিতেছে।
বেগম রোকেয়ার সংগ্রামের দ্বারা আমাদের নারী সমাজ অনেক উপকৃত হয়েছে এবং আজও হচ্ছে। তাঁর সমগ্র জীবন এবং তার রচনাবলীর মর্মার্থ যদি আমরা অনুভব করতে পারি- তবে নারীদের স্বাধীনতার মর্মার্থ এমনকি পুরুষের স্বাধীনতা, সর্বোপরি মানুষের স্বাধীনতার মর্মার্থ বোঝার জন্য আর কোন কথা, লেখা, আলোচনা বা গবেষনার প্রয়োজন হয় না। তাই আমাদের দেশে শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকে শিক্ষার সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত বেগম রোকেয়া সম্পর্কে বিশেষ পাঠের এবং পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকা উচিৎ।,,,,বেগম রোকেয়ার মত একজন অসাধারন জ্ঞানী, সংগ্রামী নারী এই পৃথিবীতে খুব কম জন্মেছেন। সমগ্র বিশ্বের নারীদের উচিত তাকে অধ্যয়ন করা। তিনি আমার কাছে এক বিস্ময় |
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই এপ্রিল, ২০১৭ দুপুর ১২:২০