আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এবারের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে ‘এ হোক অঙ্গীকার নারী নির্যাতন নয় আর’। এ দিবস টি এমন একসময় হচ্ছে যখন নারী নির্যাতন বিশেষ করে নারীর প্রতি সহিংসতা ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে। প্রতিদিন গড়ে ১০টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। গড়ে ১৫ নারী পাচার হচ্ছে। মানবাধিকার সংগঠন, বাংলাদেশ পুলিশের বিভিন্ন সূত্র এবং বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে নারী নির্যাতনের উদ্বেগজনক চিত্র পাওয়া গেছে। পরিসংখ্যানে অনুযায়ী অর্ধেকই ছাত্রী ও শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। অধিকাংশ শিশু, ছাত্রী ও কর্মজীবী নারী ধর্ষণের ঘটনায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেছে। শিশু নির্যাতনের ভয়াবহতার ঘটনায় মানবাধিকার ও নারী নির্যাতনবিরোধী কয়েকটি বড় সংগঠন বছরের বিশেষ বিশেষ দিবস ছাড়া নারী নির্যাতনের বিষয়ে নির্বিকার থাকা নিয়ে এসব সংগঠনের স্বচ্ছতার প্রশ্ন উঠেছে। দু-একটি প্রতিষ্ঠান কাজ করলেও তাদের সংগঠনগুলোর নিবন্ধন বাতিলের ভয়েও কেউ কথা বলছে না বলে জানায় অধিকাংশ সংগঠন।
মহাজোট সরকারের চার বছরে নারী ও শিশুদের পাশবিক নির্যাতনের ঘটনা অতীতের চেয়ে কয়েকগুণ বেড়েছে। ডিজিটাল সরকারের হাজার কোটি টাকা বাজেট, বরাদ্দ, বড় বড় প্রকল্প থাকার পরও নারী নির্যাতন কমছে না, বরং বেড়েই চলছে উদ্বেগজনকভাবে। নির্যাতনের পর নির্মমভাবে হত্যা করার মতো ঘটনাও ঘটছে অহরহ। পাশবিকতার শিকার হচ্ছে স্কুল-কলেজের ছাত্রী ও কোমলমতি শিশুরাও। দিনে গড়ে ঘটছে ১০টি ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ। ধর্ষণের পর হত্যাকাণ্ড ও লাশ গুম করা হচ্ছে হরহামেশা। এতেই ক্ষান্ত হচ্ছে না নরপুশার। পরিচয় নিশ্চিহ্ন করতে নারীকে পুড়েও মেরেছে। জোর করে আপত্তিকর ছবি তোলা, মোবাইলে আপত্তিকর ভিডিও আপলোড করে প্রচার, ঘটনা প্রকাশ না করতে সাদা কাগজে স্বাক্ষর আদায় করার মতো ঘটনা ঘটছে।
৬০ দিনে প্রায় তিন হাজার নারী নির্যাতনের শিকার : মানবাধিকার নিয়ে কাজ করে বেসরকারি সংগঠন অধিকার। দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় শহর, জেলা পুলিশ থেকে প্রাপ্ত তথ্য, মহিলা পরিষদের দেয়া তথ্য এবং বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকা অনুযায়ী চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসের মাত্র ৬০ দিনেই প্রায় তিন হাজার নারী বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণ, গণধর্ষণ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা রাজনৈতিক দলন, নির্যাতন, পাচার, এসিড সন্ত্রাস, শ্লীলতহানি, আত্মহত্যার প্ররোচনাসহ বিভিন্নভাবে নারী নির্যাতনের ঘটনা বেড়েছে উদ্বেগজনকভাবে। এসব সংগঠন জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত নারী নির্যাতনের ঘটনার উপাত্ত তুলে ধরে। ক্ষমতাসীন সরকারের শেষ চলতি বছরে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী মাত্র ৬০ দিনেই তিন হাজার ২১৯টি নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। পুলিশের সূত্রে জানুয়ারিতে ১ হাজার ২৭৮ এবং ফেব্রুয়ারিতে ১ হাজার ৭৮৬ নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ধর্ষণ ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে। ধর্ষণ এবং গণধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা ও ধর্ষণের চেষ্টার শিকার হয়েছেন ৫৮২ নারী ও শিশু। এ সময়ে নারী খুন হয়েছেন প্রায় ৯৫ জন। তার মধ্যে শিশু ১৩২ জন। গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে দুই মাসে ৭৬ শিশু ধর্ষণের ঘটনা। একই সময়ে নারী পাচার হয়েছে ১ হাজার ১৭২ জন। এছাড়াও যৌতুকের জন্য, পারিবারিক সহিংসতাসহ বিভিন্নভাবে নারী নির্যাতনের হার বেড়েছে উদ্বেগজনকভাবে। পুলিশের একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে, ক্ষমতাসীনদের হস্তক্ষেপে এ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ হাজার নারী নির্যাতনের মামলার তদন্ত বন্ধ রয়েছে। গত জানুয়ারিতে ছিল তদন্ত স্থগিত মামলার সংখ্যা তিন হাজার ৯৮৫টি। ফেব্রুয়ারিতে তদন্ত স্থগিত মামলার সংখ্যা বেড়েছে আরো প্রায় দুই হাজার। একই সঙ্গে জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি দৈনিক আমার দেশকে জানায়, গত কয়েক বছরে ধর্ষণ এবং পারিবারিক সহিংসতা বেড়েছে কয়েক গুণ। গত কয়েক বছরে নারী নির্যাতনের ঘটনায় ১০০ ভাগের মধ্যে ১০ ভাগ মামলারও রায় হয়নি।
স্কুলছাত্রী, শিশু ও বিধবা ধর্ষণের মচ্ছব : নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন বেশিরভাগ স্কুল-কলেজর ছাত্রী, শিশু ও বিধবারা। গত দুই মাসের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক থেকে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে এ তথ্য জানা গেছে। আর এসব ক্ষেত্রে বেশিরভাগই স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের দ্বারা নির্যাতনের সংবাদও পাওয়া গেছে। যেমন গত ফেব্রুয়ারিতে মোরেলগঞ্জে যুবলীগ নেতার হাতে স্কুলছাত্রী নির্যাতনের শিকার হয়ে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক চন্দন পোদ্দার গৃহপরিচারিকাকে ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন। আশুগঞ্জে আওয়ামী লীগ নেতা দ্বারা বিধবা ধর্ষিত হয়েছে। স্থানীয় এমপির পিএসের বিরুদ্ধে ধর্ষণের চেষ্টার অভিযোগ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। নাটোরে আওয়ামী লীগ নেতার নেতৃত্বে স্কুলছাত্রী অপহরণের পর নির্যাতনের বিরুদ্ধে এলাকাবাসী থানা ঘেরাও করে রাখে। কচুয়ায় আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মাহফুজুর রহমানের নেতৃত্বে সংখ্যালঘুকে যৌন নির্যাতনের সংবাদও একাধিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে জানুয়ারি মাসে।
আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবস : তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে এবার আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করবে সরকার। ৮ মার্চ শুক্রবার আন্তর্জাতিক নারী দিবসে জেলা ও উপজেলা সদরে নারী সমাবেশ করা হবে। আজ সকালে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু সম্মেলন কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক এ নারী দিবসের কর্মসূচির উদ্বোধন করবেন। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় জানায়, এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য হলো, ‘নারীর তথ্য পাওয়ার অধিকার, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার। আন্তর্জাতিক নারী দিবস প্রতিবছর ৮ মার্চ বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে পালন করা হয়। এই দিবসটি উদযাপনের পেছনে রয়েছে নারী শ্রমিকের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের ইতিহাস। ১৮৫৭ সালে মজুরি বৈষম্য, কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা, কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের রাস্তায় নেমেছিলেন সুতা কারখানার নারী শ্রমিকরা। সেই মিছিলে সরকারের লাঠিয়াল বাহিনীর দমন-পীড়ন চালানো হয়।
১৯০৮ সালে নিউইয়র্কের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট নারী সংগঠনের পক্ষ থেকে আয়োজিত নারী সমাবেশে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন হয়। এরপর ১৯১০ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। ১৭টি দেশ থেকে ১০০ নারী প্রতিনিধি সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। এ সম্মেলনে ক্লারা প্রতিবছর ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব দেন। সিদ্ধান্ত হয় ১৯১১ সাল থেকে নারীদের সম-অধিকার দিবস হিসেবে দিনটি পালিত হবে। ১৯১৪ সাল থেকে বেশ কয়েকটি দেশে ৮ মার্চ নারী দিবস হিসেবে পালিত হতে থাকে। ১৯৭৫ সালে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেয়া হয়। দিবসটি পালনের জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্রকে আহ্বান জানায় জাতিসংঘ। এর পর থেকে পৃথিবীজুড়েই নারীর সম-অধিকার আদায় প্রত্যয় পুনর্ব্যক্ত করার অঙ্গীকার নিয়ে দিনটি পালিত হচ্ছে।
আমার পক্ষ থেকে সকল নারীকে এই দিনে গভীর শ্রদ্ধা......

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





