somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আসুন হাদীসের কিছু নীতিমালা জানি

১৪ ই জুন, ২০১২ বিকাল ৪:৫১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুল মালেক

আংশিক ও অস্বচ্ছ ধারণার উপর পূর্ণ প্রত্যয়

অনেক সময় এমন হয় যে, কোনো কোনো বন্ধুর উসূলে হাদীস ও উসূলে ফিকহের কিছু নীতি ও ধারা সম্পর্কে খুব অগভীর ধরনের জানাশোনা থাকে। নীতিটির স্বরূপ ও তাৎপর্য এবং ভাষ্য ও বিস্তারিত অনুষঙ্গের জ্ঞান থাকে না। উসূলের উপর মুতাকাদ্দিমীনের কিতাবসমূহ গভীর মনোযোগের সাথে পাঠ করার বিষয়ে সচেতনতা থাকে না। শুধু অস্পষ্ট ও অসম্পূর্ণ ধারণার উপর ভিত্তি করে বিপরীত পথ ও পন্থা সম্পর্কে কটুক্তি ও সমালোচনার বিরাট সৌধ নির্মাণ করে ফেলা হয়। এরপর ইলমী আলোচনাতেও তাদের মুখে আম লোকের ভাষা ও যুক্তি প্রকাশিত হতে থাকে। যেমন তাদের এ সকল কথা :

ক. সহীহ বুখারী বা সহীহ মুসলিমে নেই

অনেকের মনে দৃঢ় প্রত্যয় আছে যে, ‘যেসকল হাদীস সহীহ বুখারী এবং সহীহ মুসলিমে নেই তা হয়তো সহীহ নয় কিংবা সহীহ হলেও এই দুই কিতাবের সহীহ হাদীসের সমপর্যায়ের নয়।’ এ কারণে কোনো বিষয়ে হাদীস পেশ করা হলে বলে, বুখারীতে দেখান, মুসলিমে দেখান। কিংবা বলে, বুখারী-মুসলিমে এর বিপরীত যে হাদীস আছে তা অধিক সহীহ। সুতরাং ঐ হাদীসের উপর আমল করা উচিত এবং এটা বাদ দেওয়া উচিত!

যাদের উসুলুল ফিকহ ও উসুলুল হাদীসের পোখতা ইলম আছে তারা বোঝেন এটা কেমন স্থূল কথা। কারণ :

১।

ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম দু’জনই পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন যে, তাঁরা তাঁদের ‘কিতাবুস সহীহ’তে যে হাদীসগুলো বর্ণনা করেছেন তা সব সহীহ। তবে সকল সহীহ হাদীস তাঁরা তাঁদের কিতাবে বর্ণনা করেননি এবং বর্ণনার ইচ্ছাও করেননি। এ কথাটি উভয় ইমাম থেকে সহীহ সনদে প্রমাণিত।

ক)

ইমাম বুখারী রহ. বলেছেন-

ما أدخلت في كتابي "الجامع" إلا ماصح، وتركت من الصحاح لحال الطول.

অর্থাৎ আমি আমার কিতাবুল জামি’তে শুধু সহীহ হাদীস এনেছি। তবে গ্রন্থের কলেবর বড় হয়ে যাবে এই আশঙ্কায় (অনেক) সহীহ হাদীস ত্যাগ করেছি।

( -আলকামিল, ইবনে আদী ১/ ২২৬; তারীখে বাগদাদ ২/৮-৯ )

খ)

‘‘শুরূতুল আইম্মাতিল খামছা’’য় (পৃ. ১৬০- ১৬৩) ইমাম ইসমাঈলীর সূত্রে ইমাম বুখারীর বক্তব্যের আরবী পাঠ এই-

لم أخرج في هذا الكتاب إلا صحيحا، وما تركت من الصحيح أكثر.

আমি এই কিতাবে শুধু সহীহ হাদীস এনেছি। আর যে সহীহ হাদীস আনিনি তার সংখ্যা বেশি।

গ)

খতীব বাগদাদী রাহ. ‘‘তারীখে বাগদাদে’’ (১২/২৭৩ তরজমা : আহমদ ইবনে ঈসা আততুসতরী) এবং হাযেমী ‘‘শুরূতুল আইম্মাতিল খামসা’’য় (পৃ. ১৮৫) বর্ণনা করেছেন যে,

ইমাম আবু যুরআ রাযী রহ. (যিনি ইমাম মুসলিম রহ. এর উস্তাদ) একবার সহীহ মুসলিম সম্পর্কে বললেন, এর দ্বারা তো আহলে বিদআর জন্য পথ খুলে দেওয়া হল। তাদের সামনে যখন কোনো হাদীস দ্বারা দলীল দেওয়া হবে তখন তারা বলবে, এ তো কিতাবুস সহীহতে নেই!

তেমনি ইমাম ইবনে ওয়ারা রাহ.ও সরাসরি ইমাম মুসলিম রাহ.কে সম্বোধন করে এই আশঙ্কা প্রকাশ করেন। তখন ইমাম মুসলিম রাহ. বলেছেন, আমি এই কিতাব সংকলন করেছি এবং বলেছি, এই হাদীসগুলো সহীহ। আমি তো বলিনি যে, এ কিতাবে যে হাদীস নেই তা জয়ীফ! ....

তখন ইবনে ওয়ারা তার ওজর গ্রহণ করেন এবং তাঁকে হাদীস শুনান।

এই ঘটনা থেকে যেমন বোঝা যায়, ইমাম মুসলিম রাহ. সকল সহীহ হাদীস সংকলনের ইচ্ছাও করেননি তেমনি এ কথাও বোঝা যায় যে, কোনো সহীহ ও নির্ভরযোগ্য হাদীস পেশ করা হলে ‘এ তো সহীহ মুসলিমে নেই’ বলে তা ত্যাগ করা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর তরিকা হতে পারে না। একই কথা সহীহ বুখারীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

২.

ইমাম আবু বকর ইসমায়িলী রহ. (৩৭১ হি.) ‘আল মাদখাল ইলাল মুসতাখরাজ আলা সহীহিল বুখারী’তে হাম্মাদ ইবনে সালামা থেকে ইমাম বুখারীর রেওয়ায়েত না করার প্রসঙ্গে বলেছেন,

‘বুখারী তো তাঁর মানদন্ডে উত্তীর্ণ অনেক সহীহ হাদীসও বর্ণনা করেননি। তবে তা এ জন্য নয় যে, তাঁর দৃষ্টিতে হাদীসগুলো জয়ীফ কিংবা সেগুলোকে তিনি বাতিল করতে চান। তো হাম্মাদ থেকে রেওয়ায়েত না করার বিষয়টিও এরকমই।’

( -আননুকাত আলা মুকাদ্দিমাতি ইবনিস সালাহ, বদরুদ্দীন যারকাশী ৩/৩৫৩ )

৩.

ইমাম আবু নুয়াইম আসপাহানী রাহ. (৪৩০ হি.) ‘আলমুসতাখরাজ আলা সহীহি মুসলিম’’-এ একটি হাদীসের মান সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন-

"فإنهما رحمهما الله قد تركا كثيرا مما هو بشرطهما أولى و إلى طريقتهما أقرب"

অর্থাৎ বুখারী মুসলিম এমন অনেক হাদীস ত্যাগ করেছেন, যেগুলো তাদের সংকলিত হাদীস থেকেও তাঁদের নীতি ও মানদন্ডের অধিক নিকটবর্তী।

( -আলমুসতাখরাজ ১/৩৬ )

৪.

এটি একটি সহজ ও বাস্তব কথা যে, বুখারী-মুসলিমে বর্ণিত হাদীসসমূহের সমপর্যায়ের হাদীস এবং ঐ দুই কিতাবের মানদন্ডে উত্তীর্ণ সহীহ হাদীসের সংখ্যা অনেক।

ক)

শুধু মুসতাদরাকে হাকিমেই এ পর্যায়ের হাদীস, হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রাহ.-এর বক্তব্য অনুযায়ী হাজারের কাছাকাছি।

( -আননুকাত আলা কিতাবি ইবনিস সালাহ )

খ)

মুসনাদে আহমদ এখন ৫২ খন্ডে বিস্তারিত তাখরীজসহ প্রকাশিত হয়েছে। টীকায় শায়েখ শুআইব আরনাউত ও তার সহযোগীরা সনদের মান সম্পর্কেও আলোচনা করেছেন। আমাদের প্রতিষ্ঠানের উচ্চতর হাদীস বিভাগের একজন তালিবে ইলম শুধু প্রথম চৌদ্দ খন্ডের রেওয়ায়েতের হিসাব করেছেন।

দেখা গেছে, সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ-এই ছয় কিতাবে নেই এমন হাদীসগুলোর মধ্যে :

বুখারী ও মুসলিম উভয়ের শর্ত অনুযায়ী ৪০১টি,

শুধু বুখারীর শর্ত অনুযায়ী ৬৪টি,

শুধু মুসলিমের শর্ত অনুযায়ী ২১৫টি হাদীস রয়েছে।

এছাড়া সহীহ লিযাতিহী বা সহীহ লিগায়রিহী হাদীসের সংখ্যা ১০০৮টি ও হাসান লিযাতিহী বা হাসান লিগায়রিহী হাদীস ৬১৫টি।

এসব সংখ্যা স্বতন্ত্র-অতিরিক্ত হাদীসসমূহের, অর্থাৎ যেগুলোর কোনো মুতাবি বা শাহেদ তাখরীজের বিবরণ অনুযায়ী ছয় কিতাবে নেই।

গ )

ইমাম তহাবী রহ. এর ‘শরহু মুশকিলিল আছার’ও তাখরীজসহ ১৬ খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে।

এর মধ্যে নমুনা হিসাবে শুধু দুই খন্ডের হাদীস ও আছার দেখা হয়েছে তো

বুখারী-মুসলিম উভয়ের মানদন্ডে উত্তীর্ণ হাদীস পাওয়া গেছে ২২২টি,

বুখারী-মুসলিম কোনো একজনের মানদন্ডে উত্তীর্ণ হাদীসসংখ্যা ১৪৬টি।

এর মধ্যে ৪৬ টি এমন যে, তাখরীজের বিবরণ অনুযায়ী বুখারী-মুসলিমে তার কোনো মুতাবি-শাহিদ (সমর্থক বর্ণনাও) নেই।

এ ছাড়া এই দুই খন্ডে সহীহ লিযাতিহী হাদীস ২৬৪ টি,

সহীহ লিগায়রিহী ১২১টি,

হাসান লিযাতিহী ৯৪টি ও

হাসান লিগায়রিহী রয়েছে ১৩টি।

ঘ)

শায়েখ নাসিরুদ্দীন আলবানী রহ. ‘সিফাতুস সালাহ’র (নবীজীর নামাযের পদ্ধতি) উপর যে কিতাব লিখেছেন তাতে

ছয় কিতাবের বাইরে ৮৬ টি হাদীস রয়েছে এবং

সহীহ বুখারী-সহীহ মুসলিমের বাইরে সুনানের কিতাবের হাদীস রয়েছে ১৫৬ টি।

৫.

স্বয়ং ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম রহ. তাদের অন্যান্য কিতাবে এমন অনেক হাদীসকে সহীহ বলেছেন বা দলিল হিসেবে উল্লেখ করেছেন, যেগুলো তাঁদের এই দুই কিতাবে নেই।

কারো সন্দেহ হলে ‘জুযউল কিরাআতি খালফাল ইমাম’ এবং ‘জুযউ রাফইল ইয়াদাইন’ ইত্যাদি খুলে দেখতে পারেন।

জামে তিরমিযী খুললেও দেখতে পাবেন, ইমাম তিরমিযী রাহ. ইমাম বুখারীর উদ্ধৃতিতে এমন অনেক হাদীসকে সহীহ বলেছেন, যা সহীহ বুখারীতে নেই।

তো এই সকল নিশ্চিত ও চাক্ষুষ প্রমাণ থাকার পরও কোনো নির্ভরযোগ্য হাদীস গ্রহণ করতে শুধু এ কারণে দ্বিধাগ্রস্ত হওয়া যে, তা বুখারী, মুসলিমে নেই, অতি সত্হী ও অগভীর চিন্তা নয় কি?

৬.

সপ্তম শতাব্দীতে তৈরিকৃত ‘তাকসীমে সাবয়ী’*-এর কারণে যদি কারো সন্দেহ হয় তাহলে তাদের জেনে রাখা উচিত, ঐ ‘তাকসীম’কারীগণই লিখেছেন-

أما لو رجح قسم على ما فوقه بأمور أخرى تقتضي الترجيح، فإنه يقدم على ما فوقه، إذ قد يعرض للمفوق ما يجعله فائقا

অর্থাৎ অগ্রগণ্যতার অন্যান্য কারণে কোনো প্রকার যদি তার উপরস্থ প্রকারের চেয়ে অগ্রগামী হয় তাহলে তাকে তার উপরের প্রকারের চেয়ে অগ্রগণ্য করা হবে। কারণ এই বিন্যাসে উল্লেখিত নীচের প্রকারের বর্ণনার সাথে কখনো কখনো এমন বৈশিষ্ট্য যুক্ত হয়, যা তাকে উপরের পর্যায়ের বর্ণনার সমকক্ষ বা অগ্রগণ্য করে।

এ কথাটি

হাফেয ইবনে হাজার রাহ. (৭৫২ হি.) শরহু নুখবাতুল ফিকারে (পৃ. ৩২ ) পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন।

তাঁর শাগরিদ মুহাদ্দিস শামসুদ্দীন সাখাভী রাহ.ও (৯০২ হি.) ‘‘ফাতহুল মুগীছে’’ তা আরো খুলে খুলে বয়ান করেছেন।

মুহাদ্দিস বদরুদ্দীন যারকাশী রাহ. (৭৯৪ হি.) ‘‘আন নুকাত আলা মুকাদ্দিমাতি ইবনিস সালাহ’’ তে (খন্ড ১, পৃষ্ঠা : ২৫৬-২৫৭) এবং

জালালুদ্দীন সুয়ূতী রাহ. ‘‘তাদরীবুর রাবী’’তে (খন্ড : ১, পৃষ্ঠা : ৮৮) পরিষ্কার লিখেছেন যে,

সহীহ মুসলিমের তুলনায় সহীহ বুখারী অধিক সহীহ হওয়ার অর্থ সমষ্টিগত বিচারে অধিক সহীহ হওয়া; এই নয় যে, সহীহ বুখারীর প্রতিটি হাদীস সহীহ মুসলিমের প্রতিটি হাদীসের চেয়ে অধিক সহীহ। যারকাশী রাহ. আরো লিখেছেন, অগ্রগণ্যতার কারণ-বিচারে মুহাদ্দিসগণ কখনো কখনো মুসলিমের হাদীসকে বুখারীর হাদীসের উপর প্রাধান্য দিয়ে থাকেন।

সুতরাং তাঁদের কাছেও ‘তাকসীমে সাবয়ী’ সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য অটল নীতি নয়।

( * তাকসীমে সাবয়ী অর্থ সাত প্রকারে বিভক্তকরণ। সম্ভবত মুহাদ্দিস ইবনুল সালাহ রাহ. (৬৪৬ হি.) সর্বপ্রথম এই ধারণা প্রকাশ করেন যে, সহীহ হাদীস সাত প্রকার এবং প্রত্যেক উপরের প্রকার নীচের প্রকারের চেয়ে তুলনামূলক বেশি সহীহ। প্রকারগুলো এই-

১. যে হাদীস সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম দুই কিতাবেই আছে।

২. যা শুধু সহীহ বুখারীতে আছে।

৩. যা শুধু সহীহ মুসলিমে আছে।

৪. যা এই দুই কিতাবে নেই তবে এই দুই কিতাবের মানদন্ডে সহীহ।

৫. শুধু বুখারীর মানদন্ডে সহীহ।

৬. শুধু মুসলিমের মানদন্ডে সহীহ।

৭. যা না এই দুই কিতাবে আছে, না এই দুই কিতাবের মানদন্ডে সহীহ। তবে অন্য কোনো ইমাম একে সহীহ বলেছেন।-মুকাদ্দিমাতু ইবনিস সালাহ পৃ. ১৭০

হিজরী সপ্তম শতকে সহীহ হাদীসের এই প্রকারভেদ অজুদে আসার পর অনেক লেখক নিজ নিজ কিতাবে তা উদ্ধৃত করেছেন। তবে অনেক মুহাক্কিক মুহাদ্দিস বাস্তবতা বিচার করে বলেছেন, এই প্রকারভেদ উসূলে হাদীসের আলোকে সহীহ নয়। সহীহ হাদীসের শ্রেণী ও পর্যায় নির্ধারিত হবে ছিহহতের শর্ত ও বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে, বিশেষ কোনো কিতাবে থাকা বা না থাকার ভিত্তিতে নয়। যেমন অনেক হাদীস শুধু সহীহ বুখারীতে আছে, সহীহ মুসলিমে নেই, কিন্তু তার সনদ এমন যে, তা মুসলিমের মানদন্ডেও সহীহ। এ ধরনের হাদীসকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে নেওয়ার কী অর্থ? তেমনি কোনো হাদীস বুখারীতে নেই, শুধু মুসলিমে আছে, কিন্তু তার সনদ এমন যে, তা ইমাম বুখারীর নিকটেও সহীহ। এ হাদীসকে তৃতীয় শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত করা কি অর্থহীন নয়? তদ্রূপ যেসব হাদীস উভয় ইমামের মানদন্ডে সহীহ সেগুলো কি শুধু এই দুই কিতাবে সংকলিত না হওয়ার কারণে চতুর্থ শ্রেণীতে চলে যাবে?

মোটকথা, এই প্রকারভেদকে শাস্ত্রীয় নীতি হিসেবে গ্রহণ করা যায় না। অনেক আহলে ইলমের মতো নিকট অতীতের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আহমদ শাকির রাহ.ও (মৃত্যু : ১৩৭৭ হি.) এই তাকসীমের কঠোর সমালোচনা করেছেন। দেখুন : মুসনাদে আহমদে সহীফায়ে হাম্মাম ইবনে মুনাবিবহের উপর তার ভূমিকা, খন্ড ৮ পৃষ্ঠা : ১৮২। )

খ. অধিকতর সহীহ বর্ণনাই কি অগ্রগণ্য?

অনেকে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, ‘যে হাদীস সনদের বিচারে বেশি সহীহ তা-ই শ্রেষ্ঠ ও অগ্রগণ্য, বিপরীত হাদীসটি সহীহ হলেও।’

অথচ এটা নিয়ম নয় যে, হাদীসের মাঝে বাহ্যত বিরোধ দেখা দিলে অন্য কোনো বিবেচনা ছাড়াই অধিক সহীহ হাদীসটি গ্রহণ করা হবে এবং বিপরীতটি বর্জন করা হবে। বরং স্বীকৃত নিয়ম এই যে, এই বিরোধের ক্ষেত্রে জমা, তারজীহ ও নাসখ তথা সমন্বয় সাধন, অগ্রগণ্য বিচার ও নাসিখ-মানসূখ নির্ণয়ের নিয়ম কার্যকর করতে হবে। তারজীহ বা অগ্রগণ্য বিচারের প্রসঙ্গ যদি আসে তাহলে ‘উজূহুত তারজীহ’ বা অগ্রগণ্যতার কারণসমূহের ভিত্তিতে যে হাদীস রাজিহ বা অগ্রগণ্য হবে সে হাদীসের উপরই আমল হবে। অগ্রগণ্যতার অনেক কারণ আছে।**

( ** ইমাম আবু বকর মুহাম্মাদ ইবনে মূসা আলহাযেমী রাহ. (৫৪৮ হি.-৫৮৪ হি.) ‘আলইতিবার ফিন নাসিখি ওয়াল মানসূখি মিনাল আছার’ কিতাবে (খন্ড : ১, পৃষ্ঠা ১৩২-১৬০) পঞ্চাশটি উজুহূত তারজীহ (অগ্রগণ্যতার কারণ) উল্লেখ করেছেন, যেগুলোর দ্বারা দুই মুখতালিফ (বাহ্যত পরস্পর বিরোধী) হাদীসের মধ্যে অগ্রগণ্য নির্ধারণে সহযোগিতা নেওয়া হয়।

এই পঞ্চাশ কারণের মধ্যে একটি কারণও এই বলেননি যে, দুই মুখতালিফ হাদীসের মধ্যে একটি বুখারী বা মুসলিমে আর অন্যটি অন্য কোনো হাদীসের কিতাবে থাকলে বুখারী-মুসলিমেরটি অগ্রগণ্য হবে!!

সাধারণত অগ্রগণ্যতা নির্ধারিত হয় অগ্রগণ্যতার কারণ ও বৈশিষ্ট্যের নিরিখে; কোনো বিশেষ কিতাবে থাকা বা না থাকার ভিত্তিতে নয়। মুজতাহিদ ইমামগণ কখনো কিতাবের ভিত্তিতে অগ্রগণ্যতার ফয়সালা করতেন না। হাদীস-সুন্নাহ এবং ফিকহে ইসলামী সংকলিত হওয়ার অনেক পরে এই নীতি সৃষ্টি হয়েছে যে, অমুক অমুক কিতাবকে হাদীস অনুসরণের ভিত্তি বানাও। অথচ এর দ্বারা অনেক সহীহ ও হাসান হাদীস বর্জিত হয়ে যায়। )

সনদের বিচারে অধিক সহীহ হওয়া একটিমাত্র কারণ। তো অগ্রগণ্যতার অন্য সকল কারণ ত্যাগ করে শুধু এক কারণের ভিত্তিতে সব জায়গায় সমাধান দিয়ে যাওয়া নিয়ম পরিপন্থী।

স্বয়ং ইমাম বুখারী রাহ. কিতাবুস সালাহ-এর দ্বাদশ অধ্যায়ে

باب ما يذكر في الفخذ

উরূ সতরের অন্তর্ভুক্ত কি না-এ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।

সেখানে তিনি বলেছেন-

وحديث أنس أسند وحديث جرهد أحوط، حتى يخرج من اختلافهم

অর্থাৎ আনাস রা.-এর হাদীস, (যার দ্বারা উরূ সতর না হওয়া প্রমাণ হয়) সনদের বিচারে অধিক সহীহ হলেও জারহাদের হাদীস (যাতে উরূ সতর হওয়ার কথা আছে) সতর্কতার বিচারে অগ্রগণ্য। যাতে ইখতিলাফের মধ্যে থাকতে না হয়।

ফাতহুল বারীতে (খন্ড : ১, পৃষ্ঠা : ৫৭১) আছে, ইমাম বুখারী রাহ. ‘আততারীখুল কাবীরে’ জারহাদের হাদীসকে ইযতিরাবের কারণে জয়ীফ বলেছেন। তাহলে দেখুন, সহীহর বিপরীতে যয়ীফের উপর আমল করাকে প্রাধান্য দিচ্ছেন। কারণ এটাই সতর্কতার দাবি। যে মাযহাবে উরূ সতর সেই মাযহাব অনুসারেও যেন গুনাহগার হওয়ার আশঙ্কা না থাকে।

এ কারণে অগ্রগণ্যতার একটিমাত্র কারণকে সর্বক্ষেত্রে প্রাধান্যের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করা এবং সনদের বিচারে যেটি শ্রেষ্ঠ সেটিকেই চূড়ান্তভাবে শ্রেষ্ঠ মনে করা আর তা-ও বিনা তাহকীকে, শুধু এ কারণে যে, বিপরীত হাদীসটি বুখারী-মুসলিমে নেই-এই চিন্তা মোটেও সঠিক নয়। সুতরাং অগ্রগণ্যতার অন্যান্য দিক ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং বিবেচনায় রাখা জরুরি। যেমনটা আমরা স্বয়ং ইমাম বুখারীর কাছে দেখলাম।

আরো মনে রাখা উচিত, যে সহীহ হাদীস মোতাবেক সাহাবা-তাবেয়ীনের যুগ থেকে আমল হচ্ছে, যার উপর ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিমের উস্তাদের উস্তাদরা আমল করেছেন, ফিকহ ও হাদীসের ইমামগণ যার উপর মাসআলার ভিত্তি রেখেছেন তাকে শুধু এই ছুতায় দ্বিতীয় পর্যায়ে নিয়ে আমলের গন্ডি থেকে বের করে দেওয়া যে, হাদীসটি বুখারী-মুসলিমে কেন আসেনি-এ কি ন্যায় ও যুক্তির কথা হতে পারে? হাদীস-সুন্নাহর কোনো দলিল এমন করতে বলে কি না তা চিন্তা করা কি প্রয়োজন নয়?

গ. সহীহর মোকাবেলায় হাসান কি গ্রহণযোগ্য নয়?

উপরের উদাহরণ থেকে পরিষ্কার হয়েছে যে, এক বিষয়ে যদি দুইটি মুখতালিফ হাদীস বিদ্যমান থাকে, যার একটি সহীহ, অন্যটি হাসান, তাহলে সহীহ সর্বাবস্থায় হাসানের চেয়ে অগ্রগণ্য হবে তা অপরিহার্য নয়। কেউ কেউ মনে করে, সহীহ-হাসানে তাআরুয (বিরোধ) মনে হলে সর্বাবস্থায় সহীহকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে। ইনসাফের কথা এই যে, এখানেও ইখতিলাফুল হাদীসের মূলনীতি প্রয়োগ করতে হবে। অর্থাৎ দুই হাদীসের মধ্যে ইখতিলাফ (বাহ্যত বিরোধ) মনে হলে বিরোধ নিষ্পত্তির যে মূলনীতি আছে, অর্থাৎ জমা (সমন্বয়) তারজীহ (অগ্রগণ্যতা বিচার) নাসখ (নাসিখ-মানসূখ নির্ণয়) সে অনুযায়ী নিষ্পত্তি করতে হবে। যদি তারজীহ বা অগ্রগণ্যতার প্রসঙ্গ আসে তাহলে যে হাদীস অগ্রগণ্য সাব্যস্ত হবে তার উপর আমল করা হবে।

অগ্রগণ্য হাদীস ঐ হাদীসকে বলে, যাতে এক বা একাধিক অগ্রগণ্যতার কারণ বিদ্যমান রয়েছে। সুতরাং সহীহর বিপরীতে হাসান হাদীসে যদি এক বা একাধিক শক্তিশালী কারণ অগ্রগণ্যতার থাকে তাহলে তাকেই অগ্রগণ্য করতে হবে।

যারা বলেছেন, ‘আসাহ’ (অধিক সহীহ) সহীহর চেয়ে অগ্রগণ্য, সুতরাং এখানে সমন্বয় চেষ্টার প্রয়োজন নেই, তাদের মতকে হাফেয ইবনে হাজার রাহ. ‘‘ইনতিকাযুল ইতিরায’’ গ্রন্থে (খন্ড ১, পৃষ্ঠা : ৫৮) খন্ডন করেছেন।

তিনি লেখেন-

وأما دعوى أن الجمع لا يكون إلا في المتعارضين، وأن شرط المتعارضين أن يتساويا في القوة، فهو شرط لا مستند له، بل إذا صح الحديثان وكان ظاهرهما التعارض وأمكن الجمع فهو أولى من الترجيح.

অর্থাৎ এই দাবি করা যে, সমন্বয় শুধু দুই মুতাআরিযের (বাহ্যত বিরোধপূর্ণ) মাঝে হয়ে থাকে আর মুতাআরিয তখনই হয়, যখন দুটোই শক্তির দিক থেকে সমান হয়-এটি দলিলহীন শর্ত। বরং দুই হাদীস সহীহ হলে এদের মাঝে যদি বাহ্যত বিরোধ পরিলক্ষিত হয় এবং সমন্বয় সাধন সম্ভব হয় তাহলে সেটিই তারজীহের চেয়ে উত্তম।

হাফেয ইবনে হাজার রাহ. এ কথা বলেছেন মুসতাদরাকে হাকিম ও সহীহ বুখারীর দুটো হাদীসের উপর আলোচনা করতে গিয়ে, যে দুই হাদীসের মাঝে বাহ্যত বিরোধ দেখা যাচ্ছিল। কেউ এখানে সহীহ বুখারীর হাদীস ‘আসাহ’ (অধিক সহীহ) হওয়ার যুক্তিতে মুসতাদরাকের হাদীস প্রত্যাখ্যানের প্রস্তাব করেছিলেন। এই প্রস্তাব ভুল সাব্যস্ত করে ইবনে হাজার উপরের কথা বলেন।

তদ্রূপ তিনি তার কিতাব ‘শরহু নুখবাতিল ফিকারে’র দরসে বলেছেন, সহীহ ও হাসানের মাঝেও তাআরুয (বিরোধ) দাঁড়াতে পারে। সুতরাং মানসূখ (রহিত) রেওয়ায়েত সহীহ পর্যায়ের আর নাসিখ (রহিতকারী) রেওয়ায়েত হাসান পর্যায়ের হওয়া খুবই সম্ভব।

( -আলইয়াওয়াকীতু ওয়াদ দুরার আলা শরহি নুখবাতিল ফিকার, আবদুর রউফ আলমুনাভী খন্ড ১, পৃষ্ঠা : ৩০৬; হাশিয়া কাসিম ইবনে কুতলুবুগা পৃষ্ঠা : ১০৯; হাশিয়াতুল কামাল ইবনে আবী শারীফ আলা শরহি নুখবাতিল ফিকার পৃষ্ঠা : ৭৩ )

যদি সহীহর বিপরীতে হাসানের কোনো গুরুত্বই না থাকে তাহলে তা সহীহর জন্য নাসিখ কীভাবে হয়?

ঘ. সুন্নাহকে সনদভিত্তিক মৌখিক বর্ণনার মধ্যে সীমাবদ্ধ মনে করা

শরীয়তের সর্বপ্রথম এবং সবচেয়ে বড় দলীল হল কুরআন কারীম। এরপর সুন্নাহর স্থান। কিন্তু সুন্নাহের ব্যাপারে কতিপয় মানুষের এই ধারণা আছে যে, যেসব হাদীস সুস্পষ্টভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা বা কাজ হিসেবে সহীহ বর্ণনা-পরম্পরায় এসেছে শুধু তাই সুন্নাহ। এই ধারণা ঠিক নয়। সুন্নাহ রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শিক্ষা ও নির্দেশনাবলির নাম। এই শিক্ষা ও নির্দেশনা আমাদের কাছে সাধারণত মৌখিক বর্ণনা সূত্রে পৌঁছে থাকে এবং সাধারণ পরিভাষায় এইসব মৌখিক বর্ণনাসূত্রে প্রাপ্ত রেওয়ায়েতগুলোকেই ‘হাদীস’ বলে। কিন্তু অনেক সময় এমন হয় যে, রাসূলে কারীম সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিশেষ কোনো শিক্ষা বা নির্দেশনা আমাদের কাছে মৌখিক বর্ণনার স্থলে কর্মের ধারাবাহিকতায় পৌঁছায়। অর্থাৎ সাহাবায়ে কেরাম নবীজী থেকে কর্মের মাধ্যমে তা গ্রহণ করেছেন; তাদের নিকট থেকে তাবেয়ীগণ গ্রহণ করেছেন। এভাবে প্রত্যেক উত্তরসূরি তার পূর্বসূরি থেকে কর্মের মধ্য দিয়ে নবীজীর সেই শিক্ষাকে গ্রহণ করেন। নবী-শিক্ষার এই প্রকারটিকে পরিভাষায় ‘আমলে মুতাওয়ারাস’ বা ‘সুন্নতে মুতাওয়ারাসা’ বলে।

নবী-শিক্ষা ও নবী-নির্দেশনার অনেক বিষয় এই পথেই পরবর্তীদের হাতে পৌঁছেছে। এইসব শিক্ষা-নির্দেশনা যদি মৌখিক বর্ণনাসমূহের মধ্যেও তালাশ করা হয় তাহলে অনেক সময় এমন হয় যে, হয়ত এ ব্যাপারে কোনো মৌখিক বর্ণনা পাওয়া যায় না অথবা পাওয়া গেলেও সনদের দিক থেকে তা হয় যয়ীফ। এখানে এসে স্বল্প-জ্ঞান কিংবা স্বল্প-বুঝের লোকেরা বিভ্রান্ত হয়। তারা যখন বিশুদ্ধ মৌখিক বর্ণনাসূত্রে বিষয়টি খুঁজে পায় না তো নবীজীর এই শিক্ষাটিকেই অস্বীকার করে বসে। অথচ মৌখিক সাধারণ বর্ণনা-সূত্রের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী সূত্র তাওয়ারুস তথা ব্যাপক ও সম্মিলিত কর্মধারার মাধ্যমে বিষয়টি সংরক্ষিত।

তদ্রূপ নবী-শিক্ষার একটি অংশ হল যা আমাদের কাছে সাহাবায়ে কেরামের শিক্ষা-নির্দেশনার মধ্য দিয়ে সংরক্ষিত আছে। সাহাবায়ে কেরামের অনেক নির্দেশনা এমন আছে যার ভিত্তি শরীয়তসম্মত কিয়াস ও ইজতিহাদ। এগুলো শরীয়তের দলীল হিসেবে স্বীকৃত। আবার তাদের কিছু নির্দেশনা ও কিছু ফাতওয়া এমন আছে যা তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কোনো কথা বা কাজ থেকে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু অন্যকে শিখানোর সময় এর উদ্ধৃতি দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি। কেননা প্রেক্ষাপট থেকে এ কথা স্পষ্ট ছিল যে, তাঁরা নবীজীর শিক্ষা ও নির্দেশনার ভিত্তিতেই তা শিক্ষা দিচ্ছেন। এজন্য দ্বীনের ইমামগণের সর্বসম্মত নীতি হল, সাহাবায়ে কেরামের যে ফাতাওয়া বা নির্দেশনার ব্যাপারে এটা সুনির্দিষ্ট যে, এটি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শিক্ষা-নির্দেশনা থেকেই গৃহীত, এতে সাহাবীর ইজতিহাদ বা কিয়াসের কোনো প্রভাব নেই তা মারফূ হাদীসেরই অন্তর্ভুক্ত। কোনো মাসআলায় এর মাধ্যমে প্রমাণ দেওয়া মারফূ হাদীসের দ্বারা প্রমাণ দেওয়ার শামিল। পরিভাষায় একে মারফূ হুক্মী বলে। নিঃসন্দেহে এর ভিত্তি কোনো মারফূ হাকীকী বা স্পষ্ট মারফূ। তবে এটা জরুরি নয় যে, হাদীসের কিতাবসমূহে সেই স্পষ্ট মারফূ হাদীসটি সহীহ সনদে বিদ্যমান থাকবে। এখানেও স্বল্প-বুঝের লোকেরা পদস্খলনের শিকার হয় এবং নবীজীর শিক্ষাটিকেই অস্বীকার করে বলতে থাকে যে, এর কোনো ভিত্তি পাওয়া গেল না, অথচ মারফূ হুকমীর সূত্রে প্রমাণিত হওয়াও দলীল হিসাবে যথেষ্ট।

উদাহরণস্বরূপ ইমাম ইবনে রজব হাম্বলী রাহ.-এর হাওয়ালা উল্লেখ করা যায়। তিনি তাকবীরে তাশরীকের উপর আলোচনা করে লেখেন, তাকবীরে তাশরীক মশরূ হওয়ার বিষয়ে আলিমগণ একমত। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো সহীহ মরফূ হাদীস নেই। শুধু সাহাবায়ে কেরাম ও তাঁদের পরবর্তী ব্যক্তিদের থেকে কিছু আছর বর্ণিত হয়েছে এবং এর উপর মুসলমানদের আমল রয়েছে। এরপর লেখেন-

وهذا مما يدل على أن بعض ما أجمعت الأمة عليه لم ينقل إلينا فيه نص صريح عن النبي صلى الله عليه وسلم، بل يكتفي بالعمل به.

অন্য কিছু হুকুমের সাথে এই হুকুমটিও প্রমাণ করে যে, যেসব বিষয়ে উম্মতের ইজমা হয়েছে তন্মধ্যে কিছু বিষয় এমনও আছে, যে সম্পর্কে আমাদের কাছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে স্পষ্ট কোনো নস বর্ণিত হয়ে আসেনি; বরং এ বিষয়ে শুধু আমলে (মুতাওয়ারাছ-এর) উপরই নির্ভর করতে হয়।

( -ফাতহুল বারী ফী শরহি সহীহিল বুখারী, ইবনে রজব হাম্বলী (৭৩৬হি.-৭৯৫হি.) খ. ৬, পৃ. ১২৪ )

সহীহ হাদীসে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপন সুন্নাতের পাশাপাশি খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নতকে অনুসরণ করার এবং তাকে মজবুতভাবে অবলম্বন করার আদেশ করেছেন। ইরশাদ করেছেন-

انه من يعش منكم بعدي فسيرى اختلافا كثيرا، فعليكم بسنتي وسنة الخلفاء الراشدين المهديين، تمسكوا بها وعضوا عليها بالنواجذ ... وإياكم ومحدثات الأمور، فإن كل محدثة بدعة وكل بدعة ضلالة.

‘‘মনে রেখো! আমার পরে তোমাদের যারা জীবিত থাকবে তারা বহু মতানৈক্য দেখতে পাবে। তখন আমার সুন্নত ও আমার হেদায়াতপ্রাপ্ত খলীফাগণের সুন্নতকে আকড়ে রাখবে। একে অবলম্বন করবে এবং মাড়ির দাঁত দিয়ে কামড়ে রাখবে ... এবং তোমরা (ধর্মীয় বিষয়ের) নবআবিস্কৃত বিষয়াদি থেকে খুব সতর্কতার সাথে বেঁচে থাকবে। কেননা প্রতিটি নবআবিস্কৃত বিষয় বেদআত। আর প্রতিটি বিদআত গোমরাহী।’’

( -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৪৬০৭; জামে তিরমিযী ৫/৪৩, হাদীস : ২৬৭৬; মুসনাদে আহমদ ৪/১২৬, হাদীস : ১৬৬৯২; সুনানে ইবনে মাজা, হাদীস : ৪২; সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস : ৫ )

জামে তিরমিযীর ২২২৬ হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের পরে খেলাফতের মেয়াদ ত্রিশ বছর হওয়ার ভবিষ্যৎবাণী খোদ নবীজীই করে গেছেন। সে হিসেবে নবী-পরিভাষায় খুলাফায়ে রাশেদীন চারজন- ১. আবু বকর রা. ২. উমর রা. ৩. উসমান রা. ৪. আলী রা.। তাঁর শাহাদত ৪০ হিজরীর রমযানে হয়েছে।

যেহেতু খুলাফায়ে রাশেদীনের ব্যাপারে ওহীর মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জেনেছিলেন যে, তাঁদের জারিকৃত সুন্নতসমূহ নবী-শিক্ষার উপরই ভিত্তিশীল হবে, তাঁদের সুন্নতসমূহ নবী-সুন্নতেরই অনুগামী হবে এবং আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি মোতাবেক হবে এজন্য রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতকে ব্যাপক ঘোষণা দিয়ে বলে যান যে, তোমরা খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নতকে মজবুতভাবে আঁকড়ে রাখবে।

সুতরাং যখন উম্মতের সামনে কোনো বিষয়ে প্রমাণ হবে যে, এটি চার খলীফার কোনো একজনের সুন্নত তখন তার অনুসরণের জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপরোক্ত আদেশই যথেষ্ট। আমাদের জন্য আরো অগ্রসর হয়ে এটা ভাবার প্রয়োজন নেই যে, তাঁদের এই সুন্নতের ভিত্তি কী ছিল এবং তাঁরা এই সুন্নত কোন নবী-শিক্ষা থেকে গ্রহণ করেছেন। এখানেও স্বল্প জ্ঞান ও স্বল্প বুঝের লোকদের অভ্যাস হল, খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নতের ভিত্তি হাদীসের কিতাবসমূহে খুঁজতে থাকা। এরপর সহীহ সনদে নবীজীর স্পষ্ট কোনো বাণী যদি বিশেষ এই ব্যাপারে তারা না পায় তখন তাকে অস্বীকার করে বসে এবং অত্যন্ত মর্মান্তিকভাবে একে বিদআত আখ্যা দিয়ে দেয়। অথচ রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিন্দিত ইখতিলাফ থেকে বাঁচার এই পথই দেখিয়েছেন যে, আমার সুন্নত ও আমার খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নতকে মজবুতভাবে অবলম্বন কর। এরপর বলেছেন, বিদআত থেকে বেঁচে থাক। একটু চিন্তা করুন, যদি খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নত বিদআতই হত তাহলে নবীজীর এই ইরশাদের কোনো অর্থ থাকে কী?

সুন্নাহর পরে শরীয়তের তৃতীয় বুনিয়াদী দলিল হল ইজমা। এর বিভিন্ন ধরন এবং অনেক পর্যায় আছে। এর মধ্যে সর্বপ্রধান ও সর্বশ্রেষ্ঠ হল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মুহাজির-আনসার এবং অন্যান্য সাহাবীগণের ইজমা। এই ইজমা যদি ব্যাপকভাবে এবং অবিচ্ছিন্ন ও সম্মিলিতরূপে আমাদের পর্যন্ত পৌঁছায় তবে তা শরীয়তের অনেক বড় অকাট্য দলিল। এ দলিল থাকা অবস্থায় অন্য কোনো দলিলের প্রয়োজন নেই।

আর ইজমাকে দলিল হিসেবে গ্রহণ করার জন্য এরও প্রয়োজন নেই যে, এই ইজমা কীসের ভিত্তিতে সম্পন্ন হয়েছে তার অনুসন্ধানে অবতীর্ণ হওয়া। কেননা শরীয়ত নিজেই ইজমাকে দলিল সাব্যস্ত করেছে এবং যাঁদের মাধ্যমে ইজমা সম্পন্ন হয় তাঁদের ব্যাপারে আমাদেরকে আশ্বস্ত করেছে যে, এঁরা কখনো গোমরাহীর বিষয়ে একমত হতে পারে না। কুরআন মজীদে তো সুস্পষ্টভাবে মুহাজির ও আনসারী সাহাবীগণের অনুসরণের আদেশ করা হয়েছে এবং সাবীলুল মুমিনীন (মুমিনদের অনুসৃত পথ) থেকে বিমুখ হওয়াকে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হওয়ার কারণ বলা হয়েছে।

আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর মত, পথ ও রুচির সাথে একাত্মতা পোষণ করে না এমন ব্যক্তিদের অভ্যাস হল তারা কোনো মাসআলায় শুধু উম্মতের ফকীহবৃন্দ নয়, উম্মাহর শীর্ষ ব্যক্তিবর্গ-সাহাবায়ে কেরাম, বিশেষত মুহাজির ও আনসারের ঐকমত্য থাকা অবস্থায় ভিন্ন দলিল তালাশ করতে থাকে। অথচ শরীয়ত এই ইজমাকে দলিল সাব্যস্ত করেছে। কিন্তু ওইসব বন্ধু যদি শরীয়তের এই দলিলের সমর্থনে অন্য কোনো সহীহ সনদওয়ালা স্পষ্ট হাদীস না পায় তাহলে এই মাসআলাটিকে অস্বীকার করে দেয়। কেউ তো আরো এক ধাপ বেড়ে অত্যন্ত দুঃসাহসিকতার সাথে শরীয়তের দলিল ইজমাকেই অস্বীকার করে বসে।

মনে রাখবেন, এসব হচ্ছে মূর্খতা ও শরীয়তের প্রতি অনাস্থা প্রকাশের সমার্থক। যদিও তা অসচেতনভাবেই হোক না কেন। অর্থাৎ শরীয়ত যে বিষয়টিকে দলিল সাব্যস্ত করেছে তারা তাকে মেনে নিতে পারছেন না।

এ বাস্তবতা সম্পর্কে যাঁদের চিন্তা ভাবনার সুযোগ হয় না তারা বিনা দ্বিধায় ঐ সকল সুন্নতকে ইনকার করে, যা তারা সনদ ভিত্তিক বা মৌখিক বর্ণনা সূত্রে সরাসরি قال رسول الله صلى الله عليه وسلم বা فعل رسول الله صلى الله عليه وسلم শব্দে কোনো সহীহ হাদীসে পান না। একারণে খুব সহজেই তারা খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাহ এবং আমলে মুতাওয়ারাছকে ইনকার করেন।

বিশ রাকাআত তারাবী, জুমার নামাযের প্রথম আযান, তারাবীতে কুরআন খতম, জুমার খোৎবা আরবীতে হওয়া, কালেমায়ে তাওহীদের উভয় অংশ একসাথে বলার বৈধতা لا إله إلا الله محمد رسول الله. ইত্যাদি অনেক বিষয়, যেগুলোর বড় দলীল বা প্রসিদ্ধ দলিল হচ্ছে খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নত, মুসলিম উম্মাহর আমলে মুতাওয়ারাছ কিংবা আছারে সাহাবা ও তাবেয়ীন, এসব কিছুকে তারা এই বলে অস্বীকার করেন যে, এগুলো সহীহ হাদীসে নেই! তো উপরে উল্লেখিত বাস্তবতা সম্পর্কে চিন্তা করলে অনুমান করতে পারবেন, তাদের নীতি কতটা ভুল ও মারাত্মক নীতি! অথচ খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাহ এবং আছারে সাহাবা ও তাবেয়ীন যে শুধু সুন্নতে নববীর সাথে যুক্ত তাই নয়, সনদ ভিত্তিক বর্ণনা সূত্রে বর্ণিত অনেক সহীহ হাদীসের (কওলী সুন্নতের) প্রকৃত অর্থ বোঝা ও তার প্রায়োগিক রূপ উপলব্ধি করাও এর উপর নির্ভরশীল। আলোচনা দীর্ঘ হওয়ার আশংকা না হলে এখানে কিছু উদাহরণও উল্লেখ করা যেত।

আহলে ইলম যদি মুহাদ্দিস হায়দার হাসান খান টুংকী রাহ.-এর রিসালা ‘‘আততাআমুল’’ও অধ্যয়ন করেন তাহলেও ইনশাআল্লাহুল আযীয চিন্তার পথ খুলে যাবে। এই রিসালা ‘আলইমাম ইবনু মাযাহ ওয়া কিতাবুহুস সুনানে’র হাশিয়ায় রয়েছে।

ঙ. ‘সহীহ’ ও ‘সুন্নত’কে সমার্থক মনে করা

সহীহ বা হাসান পর্যায়ের প্রতিটি রেওয়ায়েত অবশ্যই আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস। কারণ তা তাঁর থেকে প্রমাণিত। কেউ কেউ মনে করেন, হাদীসে যা কিছু প্রমাণিত তা অবশ্যই সুন্নত বা মুস্তাহাব। অথচ সঠিক কথা হল, হাদীস দ্বারা যা প্রমাণিত তা শরীয়তের বিধান বটে, কিন্তু তা কোন প্রকারের এবং কোন পর্যায়ের বিধান; তা কি সুন্নত-মুস্তাহাব, না মোবাহ; সাধারণ বিধান না বিশেষ অবস্থার বিধান; সু্ন্নত হিসেবে করা হয়েছিল, না ওযরের কারণে বা শুধু বৈধতা বর্ণনার জন্য করা হয়েছিল অথবা শুধু অভ্যাসগতভাবে*** করা হয়েছিল-ইত্যাদি অনেক সুক্ষ্ম সুক্ষ্ম দিক আছে যেগুলোর গভীরে পৌঁছা ও সমাধান দেওয়া মুজতাহিদ ও ফকীহগণের কাজ।

( *** নিঃসন্দেহে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিটি অভ্যাস জামাল ও কামালে পরিপূর্ণ। এসব বিষয়ে সাধ্যানুযায়ী তাঁর সাথে সামঞ্জস্য সৃষ্টি করা মহবতের দলীল এবং ছওয়াব ও বরকতের কারণ। কিন্তু মূল অনুসরণের ক্ষেত্র তো সুন্নতে হুদা। সুন্নতে হুদার বিষয়ে (যাতে আদাব অংশটিও শামিল) শিথিলতা করে নিছক অভ্যাসগত বিষয়াদিতে মুশাবাহাত-সামঞ্জস্য ইখতিয়ার করা এক ধরনের ধোকাও হতে পারে। উল্লেখ্য, দাড়ি লম্বা রাখা সুন্নতে হুদার গুরুত্বপূর্ণ বিধান এবং ওয়াজিব পর্যায়ের আমল। )

এজন্য আমাদের কর্তব্য, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই হাদীস সব সময় মনে রাখা-

نضر الله امرء سمع منا حديثا فحفظه، حتى يبلغه غيره، فرب حامل فقه إلى من هو أفقه منه، ورب حامل فقه ليس بفقيه

অর্থাৎ আল্লাহ ঐ ব্যক্তিকে সজীব করুন, যে আমার নিকট থেকে কোনো হাদীস শুনেছে, অতপর তা মুখস্থ করেছে এবং অন্যের নিকট পৌঁছে দিয়েছে। কারণ ফিকহের অনেক বাহক তার চেয়ে অধিক ফকীহর নিকট তা পৌঁছে দিবে এবং ফিকহের অনেক বাহক নিজে ফকীহ নয়।

-জামে তিরমিযী, হাদীস : ২৮৪৭; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৩৬৫২; সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস : ৬৭ ও ৬৮০

হাদীস বোঝার ক্ষেত্রে যারা শুধু অনুবাদের উপর নির্ভর করে, না হাদীস বোঝা ও হাদীস-ব্যাখ্যার প্রাথমিক ও স্বীকৃত নিয়মনীতি জানা আছে, না জানার ইচ্ছা আছে আর না এ বিষয়ে আইম্মায়ে মুজতাহিদীন ও ফুকাহায়ে উম্মতের জ্ঞান-গবেষণার সহায়তা নেওয়াকে বৈধ মনে করে, এরা তো বুঝতেই পারবে না যে, হাদীস অনুসরণের নামে অজান্তেই তারা সুন্নাহ বিরোধিতায় লিপ্ত হবে।

এদের কেউ মনে করবে, সব লোক আহাম্মক, এরা মসজিদের বাইরে বা জুতার বাক্সে জুতা রাখে অথচ সুন্নত হল, জুতা পায়ে দিয়ে নামায পড়া! তবে মাথায় না টুপি থাকবে, না পাগড়ি। খালি মাথায় জুতা পায়ে নামায পড়া সুন্নত!

কেউ মনে করবে, (নাউযুবিল্লাহ) পশ্চিমাদের রীতিই তো সঠিক। পেশাব তো দাঁড়িয়ে করাই সুন্নত!

কেউ বলবে, নামাযে নাতনিকে কাঁধে তুলে নেওয়া সুন্নত!

কেউ ফরয নামাযের আগে পরের সুন্নতে রাতিবা (সুন্নতে মুয়াক্কাদা) এবং বিতরকে আম নফলের মতো মনে করে অবহেলা করবে, কিন্তু অতি উদ্যম প্রদর্শন করবে মাগরিবের আগের দুই রাকাত নফলের বিষয়ে!

কেউ জুমআর আগের চার রাকাআত সুন্নতকে অস্বীকার করবে, জুমার পরের সুন্নত ত্যাগ করার বিষয়েও কোনো আফসোস হবে না, অথচ খোৎবা চলা অবস্থায় তাহিয়্যাতুল মসজিদ পড়তে ভুল করবে না।

কেউ মিসওয়াকের সুন্নত সম্পর্কে উদাসীন থাকবে, কিন্তু পাগড়ি বাঁধার বিষয়ে ভুল করবে না!

কেউ শোয়ার সময় চোখে সুরমা দিতে ভুলবে না, কিন্তু শোয়ার সময় দুআ ও যিকিরের কথা চিন্তাও করবে না!

কেউ তো দস্তরখান বিছানোর ক্ষেত্রে সামান্য শিথিলতাও করবে না, কিন্তু খাবারের কোনো দানা, তরকারির টুকরা পড়ে গেলে তা উঠিয়ে খাওয়ার ধারে কাছেও যাবে না!

কেউ মৌলিক বিষয়াদিতে সালাফ ও আকাবিরের তরীকা থেকে সরে যাবে, কিন্তু ব্যবস্থাপনাগত ও পরিবর্তনশীল বিষয়াদি অবস্থা ও চাহিদার পরিবর্তনের পরও আকাবিরের তরীকা আখ্যা দিয়ে তাতে জমে থাকবে আর এই ভেবে আত্মপ্রসাদ লাভ করবে যে, আকাবিরের তরীকায় আছি!

কেউ নিজের সংশোধনের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করবে সমাজের সংশোধনকে!

কেউ নিজের সন্তানের চিন্তার চেয়ে বেশি জরুরি বলবে উম্মতের চিন্তাকে!

কেউ দ্বীনের উপর আমল করার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করবে দ্বীনের খেদমত ও দাওয়াতকে!

কেউ দ্বীনের বিধানের উপর আমল করার চেয়ে বেশি তৎপর থাকবে হুকুমতে ইসলামিয়া কায়েম করার ক্ষেত্রে।

মোটকথা, এই ধরনের এবং এর চেয়েও মারাত্মক ধরনের চিন্তাগত ও কর্মগত প্রান্তিকতার, যা আমাদের প্রায় সকল ঘরানায় কমবেশি বিস্তার লাভ করছে, এর কারণ এছাড়া আর কী যে, আমরা আইম্মায়ে মুজতাহিদীন ও ফুকাহায়ে উম্মতের জ্ঞান-গবেষণা থেকে কুরআন বোঝা, হাদীস বোঝা এবং হাদীস মোতাবেক আমল করার বিষয়ে হয়তো সহায়তা নেই না কিংবা সঠিক পন্থায় নেই না।

আমার এই অনুযোগ শুধু ঐ বন্ধুদের সম্পর্কেই নয়, যারা-আল্লাহ মাফ করুন-ফিকহের মাযহাব ও মুজতাহিদ ইমামদের সম্পর্কে বিদ্বেষ বা অপ্রসন্নতা পোষণ করেন কিংবা তাদের প্রাপ্য মর্যাদা ও ভালোবাসা দিতে প্রস্ত্তত নন; আমার অনুযোগ ঐ ভাইদেরও প্রতি, যারা ফিকহের মাযহাব এবং আকাবির ও আসলাফের নাম নিয়েও الفقه العام للدين (দ্বীনের সাধারণ প্রজ্ঞা) এবং فقه الوسطية والاعتدال (মধ্যপন্থা ও ভারসাম্য সম্পর্কে প্রজ্ঞা) অর্জনের বিষয়ে উদাসীন। এই ফিকহ ও প্রজ্ঞা তো আহলে ফিক্হ ও আহলে দিলের সোহবত ছাড়া এবং এ দুই বিষয়ে লিখিত প্রতি যুগের আহলে ফিক্হ ও আহলে দিল ব্যক্তিদের নির্বাচিত কিতাবাদি পাঠ করা ছাড়া অর্জন করা সহজ নয়।

লিখাটি এখান থেকে নেওয়া
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দুই টাকার জ্ঞানী বনাম তিনশো মিলিয়নের জ্ঞানী!

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ২:৫৯

বিশ্বের নামীদামী অমুসলিমদের মুসলিম হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে তেমন কোন বিষয় মনে হত না বা বলা চলে এদের নিয়ে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আজ অষ্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ডিজাইনার মিঃ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×