somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমাদের ভাষা আন্দোলন

০১ লা অক্টোবর, ২০০৭ দুপুর ১:১৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সেদিন রাত দু’টা কি আড়াইটা বাজে। পুরনো কিছু খবরের কাগজ নিয়ে বসলাম। ক’দিন ধরেই মা চরমপত্র দিয়ে রেখেছে, যে কোন দিন পেপার বিক্রি করে দেবে। পত্রিকাগুলো বিক্রি হবার আগে তাই একপলক বুলিয়ে নিচ্ছিলাম, যদি কোন গুরুত্বপূর্ণ লেখা পেয়ে যাই। এভাবে দেখতে দেখতেই একটা খবরে চোখ আটকে গেল। খবরটা ছিল এ রকম, “সরকার জাতিসংঘভূক্ত সকল দেশে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের তথ্য সরবরাহের প্রক্রিয়া বন্ধ করে দিয়েছে”। খবরটি পড়ে স্বভাবতই হতাশ হলাম, মনে মনে সরকারকে হাজারটা গাল দিতে থাকলাম, কল্পনায় একাই গ্ল্যাডিয়েটর হয়ে সরকারের সবার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলাম। ঠিক তখনি মাথায় খেলে গেল এক চমৎকার আইডিয়া।

২০০৬ সালের ৩১ মার্চ, প্রথম আলোর প্রজন্ম ডট কম বিভাগে আমেরিকা প্রবাসী এক ভদ্রলোকের উপর একটি প্রতিবেদন পড়ছিলাম। ভদ্রলোকের নাম রাগিব হাসান, ছবির পেছনে প্রবাসের একটা আবহ। যা হোক, তিনি ইলিনয় অঙ্গরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অফ ইলিনয় এ্যাট আরবানা-স্যাম্পেইন বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচ ডি ডিগ্রি নেবার পাশাপাশি বিশ্বকোষ উইকিপিডিয়ার কাজ করছেন। সেখানে তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসের সত্যকথন তুলে ধরছেন বিশ্ববাসীর কাছে। আরো জানলাম, তিনি উইকিপিডিয়ার একজন প্রশাসকও। খবরটা পড়ে খুব ভালো লাগল, লেখার সূত্র ধরে ইয়াহুর bangla_wiki নামে একটি গ্রুপে ঢুকে পড়লাম। তবে এ পর্যন্তই, উইকিপিডিয়ার হয়ে কাজ করার কথা ভাবিনি। সেদিনের সেই গভীর রাতে পুরনো পত্রিকা নিয়ে না বসলে হয়ত এখনো ভাবা হত না।

গভীর রাতের কথায় ফিরে আসি। মনে মনে ভাবলাম, সরকার তথ্য পাঠাতে পারেনি বলে কি বিশ্ববাসী আমাদের গর্বের কথা জানবে না? মায়ের ভাষাকে ভালবেসে তাকে ঐশ্বর্যময় করার চেষ্টা চালিয়ে যাবে না? বিশ্বের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হাজারো সম্প্রদায়ের সংস্কৃতির মূল ধারক তাদের ভাষা। তাই তাদের ভাষা হারিয়ে যাওয়া তাদের অপূর্ব সংস্কৃতি হারিয়ে যাবারই নামান্তর। প্রযুক্তির এই যুগে যখন আমরা বোতাম টিপে অনাগত কালের জন্য সবকিছু রেখে দিতে পারি, তখনি তো বিশ্বসংস্কৃতির বিপুলভাণ্ডার বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার হুমকি সবচেয়ে বেশি। কোথায় যেন একবার পড়েছিলাম, প্রতিদিন নির্দিষ্ট সংখ্যক কিছু ভাষা পৃথিবীর বুক থেকে হাজার বছরের সংস্কৃতি নিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে। এমনকি বাংলাদেশেরও অনেক আদিবাসী সম্প্রদায় তাদের ভাষা হারিয়ে ফেলছে বাংলা ও ইংরেজির প্রভাবে। এমন সময় নিজেদের ঘুম ভাঙানোর প্রয়াস কি ভাষা আন্দোলন নিতে পারে না? এ চিন্তা থেকেই ভাবলাম, হ্যাঁ উইকিপিডিয়ায় ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস লিখতে হবে।

ইয়াহু গ্রুপে প্রস্তাবনা দিয়ে শুরু। সবার সমর্থন পেয়ে লেখা শুরু করে দিই ২০০৬ সালের ১ আগস্ট। তখনি উইকিপিডিয়ায় ভাষা আন্দোলনের উপর একটি নিবন্ধ ছিলতবে তাতে উপযুক্ত তথ্য ছিল না। তাই পুরো ইতিহাসটাকেই তুলে ধরার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ি। বিশ্বস্ত কিছু তথ্যসূত্র যথা: বশীর আল-হেলালের লেখা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস এবং প্রথম আলোর ভাষা আন্দোলন সংক্রান্ত প্রতিবেদন নিয়ে কাজ এগিয়ে চলে। রাগিব ভাইয়া আমাকে প্রতিমুহুর্তে প্রয়োজনীয় তথ্য, সূত্র ও ছবি দিয়ে সাহায্য করতে থাকেন। এভাবে ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে নিবন্ধটি মোটামুটি একটা পর্যায়ে এসে পড়ে। সুখবর হিসেবে সে মাসেই আমাদের সাথে যোগ দেন, অভিগ্ঞ উইকিপিডিয়ান নীরব মৌর্য। তিনি নিবন্ধটিকে “ফিচার নিবন্ধ’ করার কাজে হাত লাগান। মাঝে আমার পরীক্ষা থাকায় বাধ্য হয়ে আমাকে কাজ থেকে সরে থাকতে হয়।
পরীক্ষা শেষে ১৬ জুন যখন আমি উইকিতে ঢুকি তখনি আমি দেখি, নিবন্ধটিকে নির্বাচিত নিবন্ধ বা ফিচার্ড আর্টিকেলে রুপ দেবার জন্য ভোটাভুটির পাতা (এফএসি) খোলা হয়েছে। ভাবলাম, এখন তো পরীক্ষা শেষ, পুরোটা সময় কাজ করতে পারব। সাথে নীরব আছে, হয়েই গেল। কিন্তু তখনি ঘটে গেল এক দুর্ঘটনা, কোন এক অগ্ঞাত কারণে অভিমান করে উইকি ছেড়ে চলে গেলেন নীরব। তাকে ছাড়া এফএসির পুলসিরাত কি করে পার হব তা ভেবে হয়রান হলাম। রাগিব ভাইয়াও গুগলে ইণ্টার্নশিপের জন্য প্রচণ্ড ব্যস্ত, এক অজানা আশঙ্কায় মন ছেঁয়ে গেল। একা পারব তো? কিভাবে? রাগিব ভাইয়ার কথা মতো তাই পরিচিত, অপরিচিত উইকিপিডিয়ানদের সাথে যোগাযোগ করলাম, অসহায়ের মত।

গল্পের আরো মোড় তখনো বাকি, একদিন কলকাতার দ্বীপায়ন চক্রবর্তী এসে আমার পিঠ চাপড়ে বলল, “ভেবো না, আমরা আছি”। সাহস পেলাম, তারপরের একমাস অনেক খেটে খুটে শেষ মুহুর্তের কাজগুলো করতে থাকলাম। আমাদের বিশেষভাবে সাহায্য করলেন অ্যাডিলেড প্রবাসী কলকাতার রিয়ানা, আমেরিকার কিয়োকো ও ট্রুসিলভার, ভারতের দাগিজা আর সেই দ্বীপায়নদা। সাহায্য করলেন বাংলাদেশের আদিত্য কবীর, প্রচণ্ড ব্যস্ততা মাথায় নিয়েও তথ্যসূত্র যোগাড় করে দিতে লাগলেন রাগিব ভাইয়া। আমার আর কাজ কি- আমি তখন একহাতে তুড়ি আর আরেক হাতে বগল বাজাচ্ছি। এর মাঝে একদিন আবার অসুস্থ হয়ে পড়লাম। সেদিন সারাদিন অসুস্থ ছিলাম, সন্ধ্যায় ভাইয়া বাড়ি ফেরার পর ইণ্টারনেটে দেখতে পেলাম আমাদের সবার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। বাংলা ভাষা আন্দোলন নিবন্ধটির উপরের ডান কোনায় ফুটে আছে একটি তারকা,আমরা পেলাম একটি ফিচার নিবন্ধ। সারা বিশ্বের লাখো মানুষ এখন আমাদের অনন্য আত্মত্যাগের কথা জানতে পারলেন। রাগিব ভাইয়া খুশি হয়ে একটি ব্লগও লিখে ফেলেছেন সামহোয়্যারইন-এ।

যখন কাজটি করি, নিজের তাগিদেই করেছি। কখনো ভাবিনি সবার এত ভালবাসা পাব, উইকিপিডিয়ায় সতীর্থদের কাছ থেকে, ইয়াহু! গ্রুপের সহসদস্যদের কাছ থেকে, ব্লগের লেখকদের কাছ থেকে এমনকি গ্রামীণফোন কোম্পানির চাকুরেদের কাছ থেকেও প্রচুর ভালবাসা পেয়েছি। রাগিব হাসানের মত অসাধারণ ব্যক্তিত্ব্যের সান্নিধ্য পেয়েছি এখানে কাজ করেই। সিক্ত হয়েছি, বন্ধু-বান্ধবসহ অনেক নাম না জানা মানুষের ভালবাসায়। আমি কৃতগ্ঞ। সেদিন ইউএনডিপির একটি কর্মশালায় গিয়েছি, সেখানে ওপেন সোর্সের ম্যাক ভাই (মাহে আলম খান) আমাকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। ঘরভর্তি লোক করতালিতে আমাকে ভাসিয়ে দিলেন। উৎসাহ আর প্রেরণা দিলেন এগিয়ে যেতে।

মনে মনে ভাবলাম, ভাষা আন্দোলন তুমি মহান। তোমার জন্য ক্ষুদ্র, তুচ্ছ এক কিশোর ক্ষণিকের জন্য যেন হয়ে গেল বিশ্বের রাজা।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ফেব্রুয়ারি, ২০০৮ দুপুর ২:১৯
২৯টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×