২০০৬ সালের ৩১ মার্চ, প্রথম আলোর প্রজন্ম ডট কম বিভাগে আমেরিকা প্রবাসী এক ভদ্রলোকের উপর একটি প্রতিবেদন পড়ছিলাম। ভদ্রলোকের নাম রাগিব হাসান, ছবির পেছনে প্রবাসের একটা আবহ। যা হোক, তিনি ইলিনয় অঙ্গরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অফ ইলিনয় এ্যাট আরবানা-স্যাম্পেইন বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচ ডি ডিগ্রি নেবার পাশাপাশি বিশ্বকোষ উইকিপিডিয়ার কাজ করছেন। সেখানে তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসের সত্যকথন তুলে ধরছেন বিশ্ববাসীর কাছে। আরো জানলাম, তিনি উইকিপিডিয়ার একজন প্রশাসকও। খবরটা পড়ে খুব ভালো লাগল, লেখার সূত্র ধরে ইয়াহুর bangla_wiki নামে একটি গ্রুপে ঢুকে পড়লাম। তবে এ পর্যন্তই, উইকিপিডিয়ার হয়ে কাজ করার কথা ভাবিনি। সেদিনের সেই গভীর রাতে পুরনো পত্রিকা নিয়ে না বসলে হয়ত এখনো ভাবা হত না।
গভীর রাতের কথায় ফিরে আসি। মনে মনে ভাবলাম, সরকার তথ্য পাঠাতে পারেনি বলে কি বিশ্ববাসী আমাদের গর্বের কথা জানবে না? মায়ের ভাষাকে ভালবেসে তাকে ঐশ্বর্যময় করার চেষ্টা চালিয়ে যাবে না? বিশ্বের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হাজারো সম্প্রদায়ের সংস্কৃতির মূল ধারক তাদের ভাষা। তাই তাদের ভাষা হারিয়ে যাওয়া তাদের অপূর্ব সংস্কৃতি হারিয়ে যাবারই নামান্তর। প্রযুক্তির এই যুগে যখন আমরা বোতাম টিপে অনাগত কালের জন্য সবকিছু রেখে দিতে পারি, তখনি তো বিশ্বসংস্কৃতির বিপুলভাণ্ডার বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার হুমকি সবচেয়ে বেশি। কোথায় যেন একবার পড়েছিলাম, প্রতিদিন নির্দিষ্ট সংখ্যক কিছু ভাষা পৃথিবীর বুক থেকে হাজার বছরের সংস্কৃতি নিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে। এমনকি বাংলাদেশেরও অনেক আদিবাসী সম্প্রদায় তাদের ভাষা হারিয়ে ফেলছে বাংলা ও ইংরেজির প্রভাবে। এমন সময় নিজেদের ঘুম ভাঙানোর প্রয়াস কি ভাষা আন্দোলন নিতে পারে না? এ চিন্তা থেকেই ভাবলাম, হ্যাঁ উইকিপিডিয়ায় ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস লিখতে হবে।
ইয়াহু গ্রুপে প্রস্তাবনা দিয়ে শুরু। সবার সমর্থন পেয়ে লেখা শুরু করে দিই ২০০৬ সালের ১ আগস্ট। তখনি উইকিপিডিয়ায় ভাষা আন্দোলনের উপর একটি নিবন্ধ ছিলতবে তাতে উপযুক্ত তথ্য ছিল না। তাই পুরো ইতিহাসটাকেই তুলে ধরার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ি। বিশ্বস্ত কিছু তথ্যসূত্র যথা: বশীর আল-হেলালের লেখা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস এবং প্রথম আলোর ভাষা আন্দোলন সংক্রান্ত প্রতিবেদন নিয়ে কাজ এগিয়ে চলে। রাগিব ভাইয়া আমাকে প্রতিমুহুর্তে প্রয়োজনীয় তথ্য, সূত্র ও ছবি দিয়ে সাহায্য করতে থাকেন। এভাবে ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে নিবন্ধটি মোটামুটি একটা পর্যায়ে এসে পড়ে। সুখবর হিসেবে সে মাসেই আমাদের সাথে যোগ দেন, অভিগ্ঞ উইকিপিডিয়ান নীরব মৌর্য। তিনি নিবন্ধটিকে “ফিচার নিবন্ধ’ করার কাজে হাত লাগান। মাঝে আমার পরীক্ষা থাকায় বাধ্য হয়ে আমাকে কাজ থেকে সরে থাকতে হয়।
পরীক্ষা শেষে ১৬ জুন যখন আমি উইকিতে ঢুকি তখনি আমি দেখি, নিবন্ধটিকে নির্বাচিত নিবন্ধ বা ফিচার্ড আর্টিকেলে রুপ দেবার জন্য ভোটাভুটির পাতা (এফএসি) খোলা হয়েছে। ভাবলাম, এখন তো পরীক্ষা শেষ, পুরোটা সময় কাজ করতে পারব। সাথে নীরব আছে, হয়েই গেল। কিন্তু তখনি ঘটে গেল এক দুর্ঘটনা, কোন এক অগ্ঞাত কারণে অভিমান করে উইকি ছেড়ে চলে গেলেন নীরব। তাকে ছাড়া এফএসির পুলসিরাত কি করে পার হব তা ভেবে হয়রান হলাম। রাগিব ভাইয়াও গুগলে ইণ্টার্নশিপের জন্য প্রচণ্ড ব্যস্ত, এক অজানা আশঙ্কায় মন ছেঁয়ে গেল। একা পারব তো? কিভাবে? রাগিব ভাইয়ার কথা মতো তাই পরিচিত, অপরিচিত উইকিপিডিয়ানদের সাথে যোগাযোগ করলাম, অসহায়ের মত।
গল্পের আরো মোড় তখনো বাকি, একদিন কলকাতার দ্বীপায়ন চক্রবর্তী এসে আমার পিঠ চাপড়ে বলল, “ভেবো না, আমরা আছি”। সাহস পেলাম, তারপরের একমাস অনেক খেটে খুটে শেষ মুহুর্তের কাজগুলো করতে থাকলাম। আমাদের বিশেষভাবে সাহায্য করলেন অ্যাডিলেড প্রবাসী কলকাতার রিয়ানা, আমেরিকার কিয়োকো ও ট্রুসিলভার, ভারতের দাগিজা আর সেই দ্বীপায়নদা। সাহায্য করলেন বাংলাদেশের আদিত্য কবীর, প্রচণ্ড ব্যস্ততা মাথায় নিয়েও তথ্যসূত্র যোগাড় করে দিতে লাগলেন রাগিব ভাইয়া। আমার আর কাজ কি- আমি তখন একহাতে তুড়ি আর আরেক হাতে বগল বাজাচ্ছি। এর মাঝে একদিন আবার অসুস্থ হয়ে পড়লাম। সেদিন সারাদিন অসুস্থ ছিলাম, সন্ধ্যায় ভাইয়া বাড়ি ফেরার পর ইণ্টারনেটে দেখতে পেলাম আমাদের সবার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। বাংলা ভাষা আন্দোলন নিবন্ধটির উপরের ডান কোনায় ফুটে আছে একটি তারকা,আমরা পেলাম একটি ফিচার নিবন্ধ। সারা বিশ্বের লাখো মানুষ এখন আমাদের অনন্য আত্মত্যাগের কথা জানতে পারলেন। রাগিব ভাইয়া খুশি হয়ে একটি ব্লগও লিখে ফেলেছেন সামহোয়্যারইন-এ।
যখন কাজটি করি, নিজের তাগিদেই করেছি। কখনো ভাবিনি সবার এত ভালবাসা পাব, উইকিপিডিয়ায় সতীর্থদের কাছ থেকে, ইয়াহু! গ্রুপের সহসদস্যদের কাছ থেকে, ব্লগের লেখকদের কাছ থেকে এমনকি গ্রামীণফোন কোম্পানির চাকুরেদের কাছ থেকেও প্রচুর ভালবাসা পেয়েছি। রাগিব হাসানের মত অসাধারণ ব্যক্তিত্ব্যের সান্নিধ্য পেয়েছি এখানে কাজ করেই। সিক্ত হয়েছি, বন্ধু-বান্ধবসহ অনেক নাম না জানা মানুষের ভালবাসায়। আমি কৃতগ্ঞ। সেদিন ইউএনডিপির একটি কর্মশালায় গিয়েছি, সেখানে ওপেন সোর্সের ম্যাক ভাই (মাহে আলম খান) আমাকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। ঘরভর্তি লোক করতালিতে আমাকে ভাসিয়ে দিলেন। উৎসাহ আর প্রেরণা দিলেন এগিয়ে যেতে।
মনে মনে ভাবলাম, ভাষা আন্দোলন তুমি মহান। তোমার জন্য ক্ষুদ্র, তুচ্ছ এক কিশোর ক্ষণিকের জন্য যেন হয়ে গেল বিশ্বের রাজা।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ফেব্রুয়ারি, ২০০৮ দুপুর ২:১৯