সব হিসেব উলট পালট করে দিয়ে উপজেলা নির্বাচনে জামায়াত সমর্থিত প্রার্থীরা চেয়ারম্যান এবং ভাইস চেয়ারম্যান পদে রেকর্ড সংখ্যক আসন জিতে নিলো। যা হতবিহবল করে তুলল রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক বোদ্ধা-বিশ্লেষকদেরও। জামাতের এই সাফল্যে তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এখন পুরোপুরিই বেসামাল। তারা এখন স্বাভাবিক পন্থা রেখে অস্বাভাবিক পন্থা অবলম্বন করে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার চেষ্টা করছে। জামায়াতকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা না করে বরং নিজ দলের সাথে একীভূত করে নেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে!
কথাটি পূর্বে বহুবার বলেছি; আওয়ামী লীগ এমন কোন কষ্টি পাথর নয় যে তার সংস্পর্শে তামা সোনা হয়ে যাবে। এটা পরীক্ষিত সত্য জামায়াত যখন যেখানেই অবস্থান করুক না কেন তারা জামায়াত হয়েই থাকে। জামাতের সদস্যরা অন্যান্য দলের সদস্যদের মত নিজেদের বিক্রি করে না। তাহলে কেন আওয়ামী লীগ এই সর্বনাশা খেলায় মেতে উঠেছে? এর ফলাফল কি এবং তা কতটা ভয়াবহ হতে পারে তা কি তারা ভেবে দেখেছেন? যখনই ছাত্রলীগের নাম জড়িয়ে কোন দুর্বিত্তায়নের অভিযোগ উত্থাপিত হয় তখনই আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়, ছাত্রলীগে শিবিরের অনুপ্রবেশ ঘটেছে এবং তারাই এ জন্য দায়ী। তাহলে এরপরে কি আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রেও আমাদের একই কথা শুনতে হবে?
এ দেশে জামাত-শিবিরই একমাত্র দল যাদের রয়েছে সুসংগঠিত কর্মী বাহিনী। যারা দলের প্রয়োজনে সব ত্যাগ স্বীকারে সর্বদা প্রস্তুত থাকে। যেখানে নেতৃত্ব কেনা বেচা হয় না, ফলে নেতৃত্বের কোন কোন্দল নেই। সর্বোপরি এই দলটির প্রতিটি সদস্য একটি ধর্মীয় বিশ্বাসকে ভিত্তি করে পরিচালিত হয়। এহেন একটি দলের নিবেদিতপ্রাণ নেতা কর্মীরা হঠাত করেই ১৮০ ডিগ্রী ঘুরে যাবে শুধুমাত্র মামলার ভয়ে! এ কথা কোন কাণ্ড জ্ঞান সম্পন্ন মানুষ বিশ্বাস করবে না।
দলের পক্ষ হয়ে আন্দোলনে নেমে জেলের ঘানী টানছে এমন অনেক কর্মীর গৃহে পূর্বের তুলনায় আরও অনেক বেশি সচ্ছলতা চলে এসেছে দলীয় ফান্ডের টাকায়। এ একমাত্র জামাতের পক্ষেই সম্ভব আওয়ামী লীগ বা বিএনপির পক্ষে নয়। কারণ শেষোক্ত দল দুটিতে নেতার থেকে যেমন চাটুকারের সংখ্যা বেশি তেমনি দাতার থেকে বেশি চাঁটার সংখ্যা। যারা পারে তো দলের সাইনবোর্ডটা পর্যন্ত চেটে শেষ করে ফেলে। অথচ দলের দুর্দিনে এদের টিকিটিও খুঁজে পাওয়া যায় না। পক্ষান্তরে জামাতের কর্মীরা একদিকে যেমন নিবেদিতপ্রাণ অন্যদিকে দলের প্রয়োজনে পকেট থেকে অর্থ ঢেলে দিতেও এরা কুণ্ঠিত হয় না। তারা জানে দল তাদের ইহ লৌকিক এমনকি পারলৌকিক(!) জীবনেরও জিম্মাদার। অথচ এই দলের নেতা কর্মীরা সেই দুটি দলের একটিতে হৈহৈ করে যোগদান করতে শুরু করে দিল? যে দলের প্রধান সহ দু এক জন নেতা ব্যতীত অন্য কেউই দুর্দশাগ্রস্ত কর্মীর পাশে দাঁড়ানো তো দূরে থাক। কাছে গিয়ে সান্ত্বনা টুকু পর্যন্ত দেন না। জামাতের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের কি মস্তিষ্ক রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েছে?
দয়া করে বিষয়টিকে এতটা সরলীকরণ করবেন না। জামাতের আসল প্ল্যানটা বোঝার চেষ্টা করুন। জানার চেষ্টা করুন এটি তাদের সুদূর প্রসারী গেম প্লানেরই একটি অংশ কি না? যার প্রথম স্বীকার হয়েছিল বিএনপি।
খর্ব শক্তির জামায়াত বিএনপির সাথে থেকে কখনোই বিএনপিময় হয়ে উঠেনি বরং বৃহৎ শক্তির অধিকারী হয়েও বিএনপিই হয়ে পড়েছিল জামায়াতময়। আন্দোলনের কর্মসূচি গ্রহণ থেকে শুরু করে, পরিচালনা পর্যন্ত সব কিছুরই দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়ে বিএনপির নেতাদের স্বস্তি দেয়ার নামে কর্তৃত্বই কেড়ে নিয়েছিল। বিএনপিকে নিজেদের মুখপাত্র করে ছেড়েছিল। এক সময় আন্দোলনের মুল চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছিল জামায়াত, ফলাফল যা হবার তাই হল। আজ বিএনপিও ন্যাপ’র(ভাষানী) মত একটি নামমাত্র দলের দিকে যাত্রা করেছে। আর এ যাত্রাকে ত্বরান্বিত করতে উঠে পড়ে লেগেছেন তারেক জিয়া নিজেই। আজ জামায়াতের সাথে দূরত্বে তারা যে চোখে অন্ধকার দেখছে সে দায়টাও তাদেরই। অন্য কারও নয়।
বিএনপিকে নিয়ে খেলতে গিয়ে আওয়ামীলীগ জামায়াতকে প্রশ্রয় দেয়ার যে নীতি অবলম্বন করেছে তা যে তাদের জন্যেই বুমেরাং হয়ে দেখা দেবে না তার নিশ্চয়তা কি? সাময়িক সুবিধা লাভের আশায় আওয়ামী লীগ যদি তার মুল দর্শন থেকেই বিচ্যুত হয়ে যায় তাহলে তাদের ভবিষ্যতও বিএনপির মতই হতে বাধ্য। এটা তারা কেন ভুলে যাচ্ছেন? আজও এ দেশে যারা আওয়ামী লীগকে নীরব সমর্থন যুগিয়ে চলেছেন তারা যতটা না আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেন তার থেকে অনেক বেশি আওয়ামী লীগকে আশ্রয় করে মুক্তিযুদ্ধের মুল যে চেতনা অসাম্প্রদায়িক এবং বৈষম্যহীন একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা। সে লক্ষ অর্জনেরই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সেটা কি আওয়ামী নেতৃবৃন্দ বুঝতে সক্ষম নন? নাকি সব জেনে বুঝেও নিজেদের বিকল্প নেই ভেবে ইচ্ছে তরী বেয়ে চলেছেন?
শুধু তো জামায়াত নয় আওয়ামীলীগ আঁতাত করতে শুরু করেছে হেফাজতের সাথেও। এটা কি বিএনপিকে বন্ধুহীন করতে; নাকি আওয়ামী লীগের দল ভারী করতে? আওয়ামী লীগ ইসলাম বিরোধী নয় সেই সনদ কেন হেফাজতের কাছ থেকে নিতে হবে? এটা তো আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ডই বলে দিবে। আর এই সনদ দাতা আল্লামা শফি-ই তো কদিন আগে আওয়ামী লীগকে নাস্তিকের দল উপাধি দিয়েছিল। এর মধ্যে দলটি এমন কি কাজ করল যা তাদের আস্তিক বানিয়ে দিল? শোনা যায় লেনদেনের অংকটাও নেহায়েত কম নয়! (৩২ কোটি টাকা দামের রেলওয়ের জমি। দ্রষ্টব্য: মানব জমিন ১৯ এপ্রিল,২০১৪)। এহেন আল্লামা শফি’র দেয়া এই সনদের আদৌ কোন মূল্য আছে কিনা আওয়ামীলীগের নেতৃবৃন্দ সময় করে একটু ভেবে দেখবেন।
যে তের দফার বাস্তবায়ন ছাড়া আল্লামার ঘরে ফিরেই যাওয়ার কথা নয় সেই তের দফা আজ আল্লামা শফির বুলি-সর্বস্ব হয়ে গেল নাকি আওয়ামীলীগ তা পূরণের পথেই হাঁটবে? গাঁটছড়াটা বাধা হল কিসের ভিত্তিতে?
দেশের স্বার্থে দলের স্বার্থে আওয়ামী লীগকে অনেক ভেবে চিন্তেই এগুতে হবে। নয়ত নীরব ঘাতক জামাতের স্বীকার হতে হবে জায়ান্ট এই দলটিকেও! কাজেই হঠকারিতা পরিহার করে সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত গ্রহণই একমাত্র সমাধান। আওয়ামী লীগ অন্তত বিএনপির মত ভুলের ফাঁদে পা না দিক এটাই এখন একমাত্র কাম্য।
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে এপ্রিল, ২০১৪ সকাল ১১:২৩