আপনি যদি "ফেসবুকে ইসলাম ধর্ম নিয়ে কটূক্তি" লিখে সার্চ দেন আট থেকে দশটি নিউজ পাবেন যেখানে দেখা যাচ্ছে- স্কুল শিক্ষক গ্রেফতার, আনসার সদস্য গ্রেফতার, শিক্ষক বরখাস্ত ইত্যাদি অর্থাৎ ধর্ম নিয়ে কটূক্তির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ অভিযোগ জানালে তাৎক্ষনিক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। তারপরেও কেন এ সব ঘটনাকে কেন্দ্র করে হিন্দুদের বাড়িঘর জালিয়ে দেয়ার ঘটনা ঘটছে?
ফেসবুক ব্যবহার কারী প্রত্যেকের নিউজ ফিডে প্রতিদিন অসংখ্য হিন্দু ধর্মকে লক্ষ করে কটুক্তিমুলক স্ট্যাটাস ছবি দেখা যায়। তাঁর বিরুদ্ধে হিন্দুরা মুসলমানদের ঘরবাড়িতে আগুন দিতে যায় না। এই যে তাঁরা চুপচাপ থাকে তাঁর মানে কিন্তু এই নয় যে তাঁরা সংযমী। বিষয়টা হচ্ছে তাঁরা জানে যে, আমরা সংখ্যালঘু আমরা একটি হামলা চালালে মুসলমানরা দশটি হামলা চালাব অতএব চুপচাপ থাকাটাই মঙ্গল। ঠিক এর বিপরীত কারণে এদেশের মুসলমানরা কারণে অকারণে ইস্যু তৈরি করে হিন্দুদের উপর চড়াও হয়।
এখানে ধর্ম মুখ্য নয়।
ইসলাম কখনোই এই সহিংসতা সমর্থন করে না। মহানবী(সঃ) তাঁর জীবনে বহু অত্যাচার সয়েছেন। ক্ষমতা থাকা স্বত্বেও প্রতিশোধ নেন নি। আমরা তায়েফের ঘটনা জানি। আমরা মক্কা বিজয়ের পর তাঁর গণহারে ক্ষমা করে দেয়ার ঘটনা জানি। আমরা মহানবীর পথে কাটা বিছিয়ে রাখা বুড়ীর ঘটনা জানি। এমনকি এও জানি; একদা এক বেদুঈন মসজিদে পেশাব করলো। লোকেরা উঠে (তাকে মারার জন্য) তার দিকে গেল। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তার পেশাব করা বন্ধ করো না। তারপর তিনি এক বালতি পানি আনালেন এবং পানি পেশাবের উপর ঢেলে দেয়া হলো। (আবদুল্লাহ ইবনু আবদস ওহহাব (রহঃ) আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, সহিহ বুখারি ৫৬০০)
অতএব যারা ইসলামের মান বাঁচানোর নামে মহানবী(সঃ) এর আদর্শকে বুড়ো আঙুল দেখায় তাঁরা আর যাই হোক ইসলামকে ভালবেসে যে এ সব করছে না তা বলাই বাহুল্য।
প্রশ্ন হল তাহলে তাঁরা কেন করছে। এর পেছনে দুটি কারণ বিদ্যমান। এক, যারা পেছন থেকে উস্কানি দেয় তাঁদের দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকে হিন্দু সম্পত্তির দিকে আর দুই, যারা সামনে থেকে এই জঘন্য কাজগুলো করে, তাদের মধ্যে আমিত্বের অহংকার প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। তাঁরা মনে করে এ দেশটা মুসলমানদের। এখানে মুসলমানের বিরুদ্ধে কথা বলা মানুষের বেঁচে থাকারই অধিকার নেই। এক কথায় এর পেছনে ধর্ম নয় কাজ করে ক্ষমতার দম্ভ আর সম্পত্তি লাভের আশা।
ভালভাবে লক্ষ করলে দেখা যায় এই সব সহিংস ঘটনার সাথে যারা প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িত তাদের মধ্যে ধর্মপ্রাণ মুসলিম খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর। এরা মাঝে মাঝে দু' এক রাকআত সালাত আদায় করলেও কোন দিনই ভোঁর রাতে ঘুম ভেঙ্গে ফজরের নামাজ করতে যায় না। বরং মুসলমানের দাবীটা বজায় রাখতে তাঁরা প্রতি শুক্রবার জুম্মার নামাজে হাজির হতেই বেশি আগ্রহী থাকে।
সপ্তাহের একদিন এক ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে যারা মুসলমানের দাবী করে তাদের দ্বারা এ সব কর্মকাণ্ড ঘটাই স্বাভাবিক।
অনেকে হয়ত বলবেন আমি কেবল নামাজ আদায়কেই মুসলামানের একমাত্র মাপকাঠি বানিয়ে ফেলছি। হ্যাঁ, সেটা আমি সচেতনভাবেই করছি কেননা, সূরা মরিয়মে মহান আল্লাহ্ নিজেই বলেছেন।
"তাদের পর এল অপদার্থ উত্তরসূরীরা, তারা নামাজ নষ্ট করল এবং কুপ্রবৃত্তির অনুগামী হল, তাই তারা অচিরেই মন্দ পরিণাম প্রত্যক্ষ করবে। কিন্তু, তারা ব্যতীত, যারা তওবা করেছে এবং ঈমান এনেছে ও সৎকাজ করেছে, তারাই তো জান্নাতে প্রবেশ করবে – তাদের প্রতি সামান্য জুলুমও করা হবে না। (সূরা মারইয়াম ১৯:৫৯-৬০)
লক্ষ করুন ৫৯ নং আয়াতে নামাজ ত্যাগকারীদের অপদার্থ বলা হয়েছে। আর তারা কিভাবে আবার সুপথগামী হতে পারবে তার বর্ণনা করতে যেয়ে ৬০ নং আয়াতে তাদেরকে তওবা করে আবার ঈমান আনতে বলা হয়েছে। অর্থাৎ নামাজ ত্যাগকারী অবস্থায় তাদের ঈমান চলে গিয়েছিল, অর্থাৎ তারা অমুসলিম হয়ে গিয়েছিল। আর এ কারনেই যারা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে না তাদের নিজেদের মুসলমা দাবী করাটাকেই আমি প্রতারনা বলে মনে করি।
তবে সব থেকে লজ্জাজনক বিষয়টি হল এর বিরুদ্ধে সবথেকে বড় প্রতিবাদটা যেখান থেকে আশা উচিৎ সেটা আসছে না। আমাদের দেশের আলেম সমাজ সব জেনে বুঝেও এ ক্ষেত্রে নীরব থাকেন। সেটা কি মসজিদে দানের পরিমাণ কমে যাওয়ার ভয়ে নাকি মিলাদের ডাক না আসার ভয়ে তা তারাই ভাল জানেন। তবে শেষ বিচারে তারাই যে সবার আগে ধৃত হবেন সেটা নিশ্চিত করেই বলতে পারি।
মহানবী(সঃ) ইসলাম প্রচার করেছেন তাঁর সুমহান আদর্শ দিয়ে। তরবারি দিয়ে নয়। তরবারি তিনি কেবল মাত্র অস্তিত্ব রক্ষার্থেই ব্যবহার করেছেন। ইসলাম তাঁর প্রতিবেশীর প্রতি দায়িত্ববান হতে বলেছে হিন্দু মুসলিম ভেদাভেদ করতে বলেনি অথচ এই সব মানুষ মুসলিম পরিচয়ে যা করে বেড়াচ্ছে তাতে ইসলাম সম্পর্কে এবং মহানবী(সঃ) সম্পর্কে বিধর্মীদের মনে ভুল ধারনা তৈরি হচ্ছে যা ইসলাম বিদ্বেষীদের রসদ জোগাতে সাহায্য করছে। এর বিরুদ্ধে আলেম সমাজ কখনোই প্রকাশ্য অবস্থান গ্রহণ করেনি বরং কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা গেছে স্থানীয় মসজিদের ইমামদের উস্কানি দিতে। যা কোন ভাবেই কাম্য নয়।
এ সব ঘটনা রোধে সরকারের উচিৎ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সাথে স্থানীয় মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিনদেরও জবাবদিহিতার আওতায় আনা। এটা আমরা সবাই জানি ধর্মীয় বিষয়ে মসজিদের ইমাম গনের মতামত স্থানীয়দের কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাঁরা যেন নিজেদের সেই গুরুত্বটা কাজে লাগান। শেষ বিচারের দিনে মহান আল্লাহর দরবারে তাদের যেন লজ্জিত হতে না হয়। তাতে ইসলামেরই সেবা করা হবে। বেঁচে যাবে সমাজ ও দেশ। আমরা একটি সু শৃংখল সমাজ দেখতে পাব।
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই নভেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৩:৩৪