কিশোর ব্র“স ওয়েন বাবা-মা’র সঙ্গে একটি সিনেমা দেখে বাড়ি ফিরছিল। রাতের অন্ধকারে পথ হারিয়ে ফেলেছিল তারা। আর সেই অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে খুনে-গুণ্ডারা অতর্কিত আক্রমণ করে তাদের। বাধা দিতে গিয়ে গুণ্ডাদের হাতে ব্র“সের বাবা নিহত হন। ঘটনাটা কিশোর ব্র“সের মনে গভীর দাগ কাটে। পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে সে। নিয়মিত শরীর চর্চার পাশাপাশি, আক্রমণের হাত থেকে বাঁচবার জন্য বহু কৌশল রপ্ত করে ব্র“স। একই সাথে বিজ্ঞান বিষয়ক নানান বইপত্র পড়ে নিজের জ্ঞানও বাড়িয়ে তোলে। অবশেষে হঠাৎ একদিন বেশ কিছু নতুন অস্ত্র আবিষ্কার করে ফেলে ব্র“স। নিজেকে বিভিন্ন বিষয়ে পারদর্শী করবার সাথে সাথে আরও একটি ফন্দি এটেছিল সে। নিজেকে অতিমানবের ভাবধারায় গড়তে চেয়েছিল। চেহারায় আনতে চেয়েছিল পোশাকি পরিবর্তন। এরপর একদিন সন্ধেবেলায় ঘরের আলো জ্বালতে গিয়ে ব্র“স জানলার বাইরে কিছু বাদুড় উড়তে দেখল। তখনই সে নিজের দ্বিতীয় পরিচয়ের কথা ঠিক করে ফেলল। গথাম শহরের বাসিন্দারা এবার এক নতুন সুপার হিরোর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠল। কালো চাদর আংশিক মুখোশ এবং কালো পোশাক পরা এই মহাশক্তিধর ব্র“স ওয়েনই হয়ে উঠল সবার অতি প্রিয় ‘ব্যাটম্যান!’
সারা বিশ্বে কমিকস আজ অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি শিল্পমাধ্যম। আগের দিনের ‘ফেয়ারি টেলস’ বা রুপকথার দিন বদলেছে। এখন বিশ্বের শিশু থেকে কিশোর, এমনকি বংষ্কদের হাতে হাতে ঘুরে ফিরছে ‘ফ্যান্টম’, ‘সুপারম্যান’, ‘টিনটিন’ অথবা ‘অ্যাসটেরিক্স’-এর কমিকস বুক। এখন হাই-টেক কমিউনিকেশনের যুগ, রাজপুত্র আর পঙ্খিরাজ ঘোড়ার দিন শেষ। তার জায়গায় উঠে এসেছে অত্যাধুনিক ‘ব্যাট মোবাইল’ গাড়ি।
যাতে চড়ে গথাম নগরীকে ভিলেনের কবল থেকে প্রতিনিয়ত বাঁচাচ্ছে কমিকস-এর সুপার-ডুপার স্টার ব্যাটম্যান। ছোটদের সর্বক্ষণের সঙ্গী এখন হি-ম্যান অথবা সুপারম্যান।
অ্যাকশন কমিকসের প্রথম সংখ্যার নায়ক হলো বিধ্বস্ত ক্রিপটন গ্রহ থেকে ছিটকে আসা এক বিস্ময় বালক। তার বিজ্ঞানী বাবা মহাকাশযানে তাকে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেন। স্মলভিল শহরের জোনাথন ও মার্থা কেন্ট তাকে উদ্ধার করে। নাম দেয় ‘ক্লার্ক কেন্ট’। বড় হওয়ার সাথে সাথে কেন্ট পরিবার আবিষ্কার করে ক্লার্কের অতিমানবিক ক্ষমতা। ক্লার্ক ঠিক করে, সে তার এই অতিমানবিক ক্ষমতাকে মানুষের মঙ্গলের জন্য কাজে লাগাবে। বড় হয়ে ক্লার্ক কেন্ট অন্যান্য সাধারণ মানুষের মতই সাংবাদিকের চাকরি জোগাড় করে সংবাদপত্রের অফিসে। কিন্তু অন্যায়ের বিরুদ্ধে এই ক্লার্কই হয়ে ওঠে ‘সুপারম্যান’! পৃথিবীর যাবতীয় সমস্যা সমাধানের জন্য সে হয়ে ওঠে বুলেটের চেয়েও গতিমান। ইস্পাতের চেয়েও শক্তিমান। দুষ্টের দমনে সে হয়ে ওঠে অবিশ্বাস্য ক্ষমতার অধিকারী।
শুধুমাত্র বিনোদনই নয়, শিক্ষামূলক দিকও কমিকসে থাকে। পরমাণু কী, পরমাণু কীভাবে ভাঙে, ভাঙবার সময় পদার্থ ও শক্তির কী জাতীয় হেরফের হয়, কীভাবে বিক্রিয়া ঘটে, এই জটিল বৈজ্ঞানিক বিষয়গুলোও কমিকসের মাধ্যমে জনসাধানণ জানতে পারে। সোয়াশো বছর আগে কেউ কমিকসের কথা চিন্তাও করতে পারত না। কিন্তু কমিকসের আদিরুপ কার্টুন তখন বেরিয়ে গেছে। ক্যারিকেচার-কার্টুন-কমিক স্ট্রিপ-কমিকস এই পর্ব পার হতে প্রায় ১০০ বছর কেটে গেছে। ‘কার্টুন’ কথাটি এসেছে ইতালির ‘কার্তোন’ কথাটি থেকে। যার অর্থ হলো পেস্ট বোর্ড। খ্রিস্টপূর্ব এক হাজার সালে প্যাপিরাসে আঁকা একটি ক্যারিকেচার ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রাখা আছে। এটিকেই প্রথম কার্টুন হিসাবে আজ ধরা হয়।
ছবিটির বিষয়বস্তু সিংহ এবং হরিণ দাবা খেলায় ব্যস্ত। বোধহয় বাজি রেখেই। অবশ্য এখন কার্টুন যে অর্থে ব্যবহৃত হয়, তার ব্যবহারও খুব বেশিদিনের নয়। ১৮৪৩ সালে লন্ডনের ‘পাঞ্চ’ পত্রিকায় ১০৫ নম্বর সংখ্যায় জন লিচ- এর আঁকা হাস্যরসাত্মক একটি ছবিকে সর্বপ্রথম কার্টুন আখ্যা দেওয়া হয়। এর আগে কার্টুন ছিল ক্যারিকেচার পর্যায়ে। ১৮৬০ সালে এক জার্মান ভদ্রলোক, নাম উইলহেম বুশ, প্রথম প্রকাশ করেন ছবিতে সংলাপহীন একটি গল্প। এটাকেই প্রথম কমিকস হিসাবে গণ্য করা হয়। এর ঠিক পাঁচ বছর পর ১৮৬৫ সালে প্রকাশিত বুশের দ্বিতীয় কমিকস ‘ম্যাক্স অ্যান্ড মরিস’ সে দেশে দারুণ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। আর এভাবেই উইলহেলস বুশ আধুনিক কমিক স্ট্রিপের জনক হয়ে বেঁচে রইলেন।
‘নিউ ইয়র্ক ওয়ার্ল্ড’ পত্রিকার সম্পাদক যোশেফ পুলিৎজার সংবাদপত্রের সম্পাদক হিসাবে কমিকসের তাৎপর্য ও ক্ষমতা প্রথম উপলব্ধি করেছিলেন। কমিকসের ইতিহাসে পুলিৎজারের পাশাপাশি এক মার্কিন সাংবাদিকের নামও চলে আসে। তিনি ‘নিউ ইয়র্ক ওয়ার্ল্ড’ পত্রিকার একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী ‘মর্নিং জার্নাল’-এর সম্পাদক উইলিয়াম র্যানডলফ হার্স্ট।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর প্রথম উল্লেখযোগ্য কমিকসের নায়ক ‘রুপার্ট’। পরনে ডোরাকাটা ট্রাউজার, জাম্পার এবং গলায় স্কার্ফ নিয়ে ছোট্ট একটি টেডি বিয়ার। নাটউডের জঙ্গলে সে তার বাবা-মার সঙ্গে থাকে, দুষ্টুমি করে, অন্যদের সাথে খেলা করে, আবার বড় কোন জন্তু দেখলেই ছুটে বাবা-মার কোলে আশ্রয় নেয়। ব্রিটেনের ‘ডেলি মিরর’ পত্রিকায় ৮ নভেম্বর ১৯২০ সালে শুরু হয় ‘দ্য লিটল লস্ট বিয়ার’ নামে রুপার্টের কাণ্ডকারখানা। ‘ডেলি মিরর’- এ রুপার্টের জনপ্রিয়তা এতই বেড়েছিল যে একই সাথে অন্য দুটো কাগজ ‘ডেলি নিউজ’ ও ‘ডেলি এক্সপ্রেস’-এও রুপার্টের কমিকস বের হতে থাকল।
এরপর ১৯১৪ সালে এডগার রাইস বারোজের কলম থেকে প্রকাশিত হয় কিশোর দুনিয়ার সাড়া জাগানো উপন্যাস ‘টারজান অভ দ্য এপস।’ ১৯১৮ সালে তা চলচ্চিত্রায়িত হয়েছিল। ১৯২৯ সালে হ্যারল্ড ফস্টার এই টারজান চরিত্রটিকে নিয়ে এলেন কমিকসে। শুরু হলো কমিকস দুনিয়ার নতুন পথচলা। সিনেমাটিক কায়দায় করা হলো উজ্জ্বল রঙিন ছবি, চরিত্রদের দ্রুত ও তাৎক্ষণিক অ্যাকশন, সবকিছু মিলিয়ে কমিকস স্ট্রিপেও টারজান এনেছিল আশাতীত সাফল্য।
একই বছরে কমিকস দুনিয়ায় স্মরণীয় হয়ে রইল অন্য আরও একটি কারণে। ১৯২৯ সালে কমিকসে অত্মপ্রকাশ করল বেলজিয়াম নামের ছোট্ট একটি দেশ। আর যে লোকটি বেলজিয়ামকে কমিকসের দুনিয়ায় অমর করে রাখলেন, তার নাম রেঁমি জর্জ। এই মজার মানুষটি নিজের নামের আদ্যক্ষর আর-জিকে মজা করে উচ্চারণ করে নাম সই করলেন-‘হার্জে’। বেলজিয়ামের সংবাদপত্র ‘লা ভিনজতিয়েম সিয়েকল’-এর সাপ্তাহিক ক্রোড়পত্র ‘লা পেঁতি ভিনজতিয়েম’-এ তিনি যে চরিত্রটি সৃষ্টি করলেন, তার নাম ‘টিনটিন’। খবরের কাগজে টিনটিনের আবির্ভাব এতই সাড়া ফেলে দেয় যে, আত্মপ্রকাশের পরের বছরেই ‘টিনটিন ইন দ্য ল্যান্ড অভ সোভিয়েত’ নামে ফরাসি ভাষায় বই বের হয়।
টিনটিন স্রষ্টা হার্জে সম্পর্কে নতুন কিছু বলবার নেই। টেকনিকের দিক থেকেও তার কমিকসের মান অন্যদের চেয়ে অনেক উন্নত। কমিকসের মধ্যে নিখাদ কার্টুনের স্বাদ প্রথম হার্জের তুলিতে পাওয়া যায়। ‘টিনটিন ইন আমেরিকা’ বইটির একটা ছবিতে দেখা যাচ্ছে ১৯৩১ সালের গুণ্ডা সর্দার তার এক হাতে পিস্তল এবং অন্য হাতে নোটের তাড়া নিয়ে চিকাগো শহরের রাজপথ দিয়ে হেটে যাচ্ছে। রাস্তায় দাড়ানো ট্রাফিক পুলিশ তাকে স্যালুট ঠুকছে! কমিকস দুনিয়ায় এরকম অসাধারণ ব্যঙ্গ আগে কখনও দেখা যায়নি।
১৯৩১ সালে চেষ্টার গোল্ড সৃষ্টি করেন কমিকসে প্রথম পুলিশ চরিত্র-‘ডিক ট্রেসি’। অপরদিকে একই সালে লি ফক এবং তার চিত্রকর বন্ধু ফিল ডেভিস মিলে তৈরি করলেন জাদুকর চরিত্র-‘ম্যানড্রেক’।
১৯৩৮ সালে আর একটি বিখ্যাত কমিকস প্রকাশিত হয়েছিল। ফ্রেড হারমানের ‘রেড-রাইডার’। প্রায় সব কমিকস নিয়েই সিনেমা বানানো হয়েছে একাধিক বার। তবে তার মধ্যে ‘রেড-রাইডার’ হয়েছে সবথেকে বেশি, ২২ বার।
১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যেই জন্ম নেয় বব, মন্টানার ‘আর্চি’। এতদিন কমিকসের নায়কেরা ছিল হয় খুদে শিশু কিংবা যুবক। আর্চিই হলো প্রথম কিশোর নায়ক! টাইম ম্যাগাজিনের হিসাবে কোন বই সপ্তাহে ৩ লক্ষ কপি হলে তা ‘বেস্ট সেলার’ হিসাবে গণ্য হত। কিন্তু দেখা গেল, এক মাসে আর্চির বই বিক্রি হয়েছে ১৬৮ লক্ষ কপি!
বিশ্বযুদ্ধের সমসাময়িক কমিক্সগুলোতে ছিল শুধুমাত্র টেরর, হরর ও ক্রাইম-এর এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ। এরই প্রতিবাদে ১৯৫১ সালে ‘সেন্সর কোড’-এর মত গড়ে ওঠে ‘কমিক্স কোড’! কমিকসের বইয়ের উপর ‘ক্রাইম’ কথাটি বড় বড় অক্ষরে লেখা যাবে না। খুন-জখমের কোন ছবি বা পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দেওয়া চলবে না।
সা¤প্রতিক কমিকসের ধারাটি হচ্ছে, মহাকাব্যকে আধুনিক দৃষ্টিতে দেখা। এই দৃষ্টিভঙ্গিতেই ১৯৬৮ সালে ফ্রান্সে হয়েছে ‘ইউলিসি’, ১৯৭৩ সালে জার্মানিতে ‘অ্যানড্রেকস’। আর সবার উপরে ১৯৬৩ সালে ফিলিপিনসের আলফ্রেড আলকালার সৃষ্টি ‘ভোলতার'কে বলা হয় ‘কমিকসের মহাকাব্য’। প্রাচীন উপকথা, ইতিহাস, রুপকথা সবকিছু মিলিয়ে ‘ভোলতার’ এক চিরনতুন চরিত্র।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা এপ্রিল, ২০১৩ দুপুর ১২:৩৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




