বিয়ের উপযুক্ত বয়স কত? আমাদের গ্রামীণ সমাজে বাল্যবিয়ের সমস্যা রয়ে গেছে এবং এর বিরুদ্ধে আমাদের নীতি নির্ধারক ও বিজ্ঞ সমাজে তথা এনজিওদের বিশেষ সচেতন দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মতৎপরতা রয়েছে। এই নিয়ে জাতিসঙ্ঘেরও মাথাব্যাথা কম নাই; সম্প্রতি, ইউনিসেফ-এর এক গবেষনায় বাংলাদেশকে বাল্যবিয়েতে বিশ্বের শীর্ষে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
ইউনিসেফের তথ্যমতে, বাংলাদেশে ৩৩% মেয়েদের ১৫ বছরের আগে ও ৬৬% মেয়েদের ১৮ বছরের আগে বিয়ে হয়ে যায়। সাধারণভাবে বলা যায়, এটি একটি আর্থ-সামাজিক সমস্যা বটে। বাল্যবিয়ে অবধারিতভাবে নিম্নবিত্ত বা বিত্তহীন পরিবারগুলোতে প্রচলিত; মধ্যবিত্ত/উচ্চবিত্ত পরিবারে এর উপস্থিতি খুবই নগন্য। এ কারণে ইউনিসেফের তথ্যের সঠিকতা আমাদের সমাজ বিশ্লেষনে আমার কাছে খুব সঠিক মনে হয় না। প্রায় একই সময়ে কাকতালীয়ভাবে গত ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৪ তারিখে মন্ত্রীসভার মিটিঙে আইন অনুযায়ী বিয়ের ন্যূনতম বয়স বর্তমানে ছেলেদের ২১ এবং মেয়েদের ১৮ বছর থেকে কমিয়ে যথাক্রমে ১৮ ও ১৬ বছর করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে; অবশ্য আন্তর্জাতিক শিশু সনদ অনুযায়ী মেয়েদের বিয়ের বয়স সরকার কমাতে পারবে কি-না তা পরীক্ষা করেই তা চূড়ান্ত করা হবে (সকালের খবর, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৪ )। বাল্যবিয়ের বিপরীতে, অধিক বয়সে বিয়ে যে কোন সমস্যা তা নিয়ে বিস্ময়করভাবে আমাদের সমাজে, বিশেষ করে শিক্ষিত সমাজে কোন উদ্বেগ বা দুঃশ্চিন্তা নাই। বরং ব্যাপক বিভ্রান্তি আছে, সঠিক করে বললে, গত দুই প্রজন্মে তৈরি হয়েছে। এই বিষয়ে পত্রপত্রিকায় বা টকশোতে এখনও কোন বিশ্লেষন চোখে পড়ে নাই, ব্লগে দুই-একটা পোস্ট পড়েছে, মতামত এসেছে আশানুরূপ কম। আমি এই বিষয়ে নিজস্ব মতামত তুলে ধরতে চাই। মূল বিষয়ে যাওয়ার আগে কতগুলো ফ্যাক্ট (সূত্র: উইকিপিডিয়া) জানা যাক:
১) পিউবার্টি বা বালেগ হওয়ার বয়স মেয়েদের জন্য ১০-১১ বছর, ছেলেদের জন্য ১১-১২ বছর। মেয়েদের মেনুস্ট্রেশন বা মাসিক শুরুর সময় ১২-১৩ বছর।
২) কনসেন্ট এজ বা যৌন কর্মকান্ডে সম্মতিমূলক অংশগ্রহণের বয়স বিশ্বব্যাপী ১৩ বছর (স্পেন) থেকে ১৮ বছর (তুরস্ক) পর্যন্ত। ইয়েমেনে যে কোন বয়সে বিয়ে হওয়াকেই কনসেন্ট এজ হিসাবে ধরে। বাংলাদেশে পেনাল কোড অনুসারে এই কনসেন্ট এজ হল ১৪ বছর।
৩) বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই সরকারিভাবে বিয়ের বয়স নির্ধারিত নাই, বাংলাদেশে আছে, সেটা মেয়েদের জন্য ১৮ বছর ও ছেলেদের জন্য ২১ বছর। অতি সম্প্রতি এই বয়স কমানোর প্রস্তাব মন্ত্রীসভায় গৃহীত হয়েছে যা উপরে উল্লেখ করা হয়েছে।
৪) মাতৃত্বের জন্য শারীরীকভাবে সবচে উপযুক্ত বয়স ১৮ বছর থেকে ২৭ বছরের মধ্যে। ২৭ বছরের পর থেকে মাতৃত্বে উপযুক্ততায় ভাটা পরতে থাকে এবং ৩৫ বছর থেকে মাতৃত্বের উপযুক্ততা ব্যপকভাবে হ্রাস পেতে থাকে (এই তথ্য পশ্চিমা দেশগুলোর, আমাদের ক্ষেত্রে ধারণা করি বয়সের এই চক্র আরও আগে শুরু ও শেষ হয়)।
আমার আপত্তি আমাদের দেশের বৈধ বিয়েতে ইউনিসেফের দুঃখ, দুঃশ্চিন্তা উতলে উঠায়। ১৮ বছরের আগে বিয়ে করলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায় আর ১৮ বছরের আগে বিয়ে না করে সেক্স করলে মানবজাতি উন্নতির চূড়াঁয় উঠে যায়! আমি আফ্রিকাতে শতশত কোলে-শিশু বালিকা-কিশোরী মাতা দেখেছি। ইউনিসেফের সেসবে আপত্তি নাই, আপত্তি শুধু বিয়ে করলে! পাশ্চাত্যে টিনএজ গর্ভধারণ ও টিনএজ মাতৃত্ব একটা যারপরনাই সামাজিক সমস্যা, কিন্তু বিয়ের মাধ্যমে নয় বলে ঐগুলো সমস্যা না, ইউনিসেফের তাতে কোন দুঃশ্চিন্তা নাই। আফ্রিকা বা পাশ্চাত্যে টিনএজ প্রেগনেন্সি বিয়েবহির্ভূত বলে যেসব সমস্যার মুখোমুখি হয় বাংলাদেশ বা দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রে সেসব সমস্যা অনেক ক্ষেত্রেই অনেক কম মাত্রায় উপস্থিত। পাশ্চাত্যে টিনএজ গর্ভধারণ ও মাতৃত্ব প্রায় শতভাগ অপরিকল্পিত এবং এর কারণে একটি মেয়ে সামাজিকভাবে অসহায় ও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখী হয়, লেখাপড়া ক্ষতিগ্রস্থ হয়, যৌনরোগের ঝুঁকির মধ্যে পড়ে এবং আবগগতভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। লেখাপড়ায় ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া ছাড়া আমাদের বাস্তবতায় অন্যান্য ঝুঁকি অনেক কম এবং এটিও পারিবারিক পরিকল্পনার আওতায় হয়ে থাকে। সুতরাং, টিনএজ গর্ভধারণ ও মাতৃত্বের সমস্যা আমাদের দেশে পাশ্চাত্যের তুলনায় অনেকখানি কম। অবশ্য, ১৩-১৪ বছরের মাতৃত্বের শরীরবৃত্তীয় সমস্যা সবখানে একই হলেও পুষ্টি ও চিকিৎসাগত দিক থেকে পাশ্চাত্য অনেক এগিয়ে আছে। আমাদের দেশে টিনএজ মাতৃত্ব একটি বৈধ বৈবাহিক পরিবেশে হওয়ায় টিনএজ মার পারিবারিক ও সামাজিক স্বীকৃতি ও নিরাপত্তার পাশাপাশি সাধ্যমত যত্ন এবং শারীরীক ও মানসিক সহযোগীতা পায়, যার খুবই অভাব একটি পাশ্চাত্যের টিনএজ মার ক্ষেত্রে। অথচ এই নিয়েই ইউনিসেফের ভাবনার অন্ত নাই। আমাদের আবাল ইন্টেলেকচুয়াল, আবাল সাংবাদিকরা সেইটা নিয়ে হুক্কাহুয়া করে খুব লাফায়। এই ইস্যুতে এনজিও ব্যবসাও রমরমা, বাল্যবিয়ে ঠেকাতে কাড়ি কাড়ি টাকা নিয়ে দাতারাতো বসেই আছে! এই নিয়ে বিজ্ঞাপন বানাতেও মিথ্যা তথ্য দেয় যে ১৬-১৭ বছরে মা হলে নাকি শিশু পুষ্টিহীন এবং শারীরীক, মানসিক প্রতিবন্ধি হবে... আবালগুলা ইন্টারনেট ঘেঁটেও এই সামান্য তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে পারে না, তাদের দৌড় বলিউডের নায়িকাদের নষ্ট দিনলিপি গোগলানো পর্যন্তই।
বস্তুত, মানবজাতির লক্ষ লক্ষ বছরের ইতিহাস বাল্যবিয়ের ইতিহাস, মানবসভ্যতা বাল্যবিয়ের মধ্য দিয়েই এদ্দুর এগিয়েছে। এই কিছুদিন আগে পর্যন্ত আমাদের পূর্বপুরুষরা সবাই বাল্য বিয়ে করেছেন, আমাদের দাদী-নানীরাও বাল্য বিয়ে করেছিলেন। তারা অশিক্ষিত, মূর্খ ছিলেন, কিন্তু পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও বাল্য বিয়ে করেছিলেন, তার কন্যাকেও বাল্য বিয়ে দিয়েছিলেন। এইসব বাল্যবিয়েতে আমরা কেউ পুষ্টিহীন ও প্রতিবন্ধি হয়ে পড়িনি, রবীন্দ্রনাথও না। মানব সভ্যতা যেভাবে এগিয়েছে, সেটাই প্রাকৃতিক আর আমরা বাল্য বিয়ের বিরুদ্ধে যেভাবে গত ৪০-৫০ বছর ধরে লড়ছি, সেটাই অপ্রাকৃতিক, অস্বাভাবিক। বরং আমার ব্যক্তিগত ধারণা, জরিপ করে দেখলে এই যুগে জন্মগত প্রতিবন্ধিদের সংখ্যা দুই-তিন প্রজন্মের চেয়ে অনেক বেশি হবে। স্পেনের ১৩ বছরের বা বাংলাদেশের ১৪ বছরের মেয়েদের (এবং ছেলেদের) যদি যৌনকর্মে অংশগ্রহণে সমস্যা না থাকে, তবে বিয়েতে আপত্তি কেন? যার মাতৃত্বের গড় উপযুক্ত বয়সের শুরু ১৮ বছরে, তাদের কারও কারও ক্ষেত্রে তা ১৬ হতেই পারে, এমনকি ১৫ও খুব ব্যতিক্রম হবে না। আর কনসেন্ট এজ ১৪ হলে যদি বিয়ের বয়স ১৮ হয় তবে তা বিয়েবহির্ভূত সম্পর্ককে ৪ বছরের জন্য আইনত স্বীকৃতি দেয় যা সমাজ ও ধর্ম এখানে দেয় না। এই অসঙ্গতি একটি সুস্থ সমাজ বিনির্মাণে অবশ্যই সহায়ক না। বৈবাহিক বয়স কমানোর ইস্যুতে সরকারকে ধন্যবাদ দিতে চাই একটি বাস্তবমুখী সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য। আমাদের দেশে রাজনীতি ও ধর্ম সংক্রান্ত কোন বিষয়ে পান থেকে চুন খসলে ব্যাপক আলোচনা হয়; অন্য বিষয়ে না জনগণ, না মিডিয়া, না টকশো-তে তেমন কোন আলোচনা, বিশ্লেষন হয়! এই বিষয়টি তেমনই একটা।
বেশি বয়সে বিয়ে করার আইডিয়া আমাদের সমাজ এত বেশি খেয়েছে যে, ছেলেদের ৩০-এর আগে এবং মেয়েদের ২৩-২৪ এর আগে বিয়ে মধ্যবিত্ত সমাজ গোনার বাইরে রেখেছে। আমাদের আঁতলামি টিভি নাটকগুলোতে (ও কিছু কিছু সিনেমাতে) ইঁচড়ে পাঁকা, ত্যাড়া-ঢংগী নায়িকা বা তাদের মা-বাবারা আইবুড়োদের নিয়ে নিয়মিত ঢং করে ডায়লগ দেয়, 'লেখাপড়া শেষ না করে বিয়ে নিয়ে ভাবছি না'। বিয়েতে যত আপত্তি, বিয়ে বহির্ভূত দৈহিক সম্পর্কে নয়। আমাদের ছেলেমেয়েরা দুই প্রজন্ম আগের মত উপযুক্ত বয়সে বিয়ে করতে পারছে না, আর সামাজিক-ধর্মীয় কারণে পাশ্চাত্য বা আফ্রিকান তরিকায় অবাধে জৈবিক চাহিদাও মেটাতে পারছে না; এতে অনৈতিকতা থেমে থাকছেনা, থাকার কথাও না; বাড়ছে লুকোচুরি সম্পর্ক, বাড়ছে পাপাচার এবং ব্যক্তি ও সামাজিক অবক্ষয়। সমাজে ধর্ষণ ও যৌননির্যাতন বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ আমার মতে এই বিলম্ব বিয়ে (অন্যান্য প্রধান কারণগুলো – মাদক ও পর্ণগ্রাফির বিস্তার, হিন্দি ছবি ও সিরিয়ালের নেতিবাচক প্রভাব, ক্রবর্ধমান পারিবারিক ও সামাজিক অবক্ষয়, আইনের শাসনের অভাব, ধর্মীয় ও নৈতিক মটিভেশনের অভাব)। যার মাতৃত্বের গড় উপযুক্ত বয়সের শেষ ২৭ বছরে (এটা পশ্চিমা হিসাবে, আমাদের দেশে তা আরও আগে হওয়ার কথা), তাকে লেখাপড়া শেষ (মাস্টার্স) করে ২৫-২৬ বছরে বিয়ে করার নসিহত কী পরিমাণ গর্হিত তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর বাস্তব পরিস্থিতি হল, পড়ালেখা শেষ করেই সে বিয়ের পিঁড়িতে গিয়ে বসবে, এমনটা খুবই কম ঘটে। ততদিনে আইবুড়ো হয়ে নিজ ও পরিবারের জন্য হতাশা, কোন কোন ক্ষেত্রে কেলেঙ্কারি নিয়ে আসে।
পশ্চিমা বিশ্ব ও আমাদের দেশে প্রচলিত তাদের শিক্ষাব্যবস্থা পারলে মাতৃত্বের শরীরবৃত্তীয় চক্রকে ১৮-২৭ বছর থেকে বাড়িয়ে ২৫-৩৫ বছর করে দেয়! পারলে সেটাই হত, কিন্তু স্রষ্টার ইচ্ছাকে কে রদ করবে? আমাদের আধুনিক সমাজব্যবস্থা এই প্রাকৃতিক নিয়মকে তুচ্ছ করতে চাইছে, সেটা হবার নয়। প্রকৃতির নিয়মকে ধারণ করে জীবন সাজানোই সমস্যার সবচে সেরা সমাধান।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জুলাই, ২০১৮ সকাল ৭:২৬