somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জামতলায় মিসির আলী

১৯ শে জুলাই, ২০১৭ রাত ১০:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আকাশের রঙ কিছুক্ষণ হল বদলেছে। ঘন মেঘ কোথায় যেন হারিয়ে চকচকে নীল মেঘ উপস্থিত, কে বলবে এই পাঁচ মিনিট আগে ঝরঝর করে নামা বৃষ্টি আশেপাশে সব ভিজিয়ে গেছে। অন্তত মেঘ দেখে তা বোঝার উপায় নেই। আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি দিলেন মিসির আলী। এমন পরিবেশ তার খুব ভাল লাগে। প্রকৃতির সারপ্রাইজ খুব মিষ্টি হয়। মেয়েরা যেমন বিশেষ দিনে কিছু পেলে আনন্দে ফিন তুলে, এমন দিনে প্রকৃতির গিফট পেয়ে তার নাগিন ড্যান্স দিতে ইচ্ছে করছে। রাস্তায় বাচ্চাকাচ্চা ঘুরঘুর করছে। কিছু বাচ্চা কাদাভরা জলে জাম্পিং করছে। তিঁনি ভাবছেন এই অবস্থায় হিমু এদের পেলে পাছায় দুটো করে লাথি দিত। কারণ হিমুর লজিকে কাদায় যদি তার খালা জাম্পিং করে তবে সেটা তার কাছে হত মজার ব্যাপার বাচ্চাকাচ্চার নাচাকোঁদা মানে জীবানুর আক্রমণ । বাচ্চাকাচ্চার নাচাকুদো অবশ্য মিসির আলীর কাছেও আজ ভাল লাগছে না। তিনি এর কারণটা খুঁজছেন কিন্তু পাচ্ছেন না। এটা একটা আনসলভড কেস। যেখানে মজা পাওয়ার কথা সেখানে তিঁনি মজা পাচ্ছেন না। বিষয়টা অদ্ভুত। এখন তার মাথায় আর নাগিন ড্যান্স আসছে না। তিনি একটু বিরক্ত। কারণ একটু পরেই তিনি গম্ভীর হয়ে যাবেন। বাসায় ফিরে একটা কেস সলভ করতে হবে। সাইন্স ফাইন্স, লজিক ফজিক তার কাছে খাবারের মত। বাসায় বোতল ভূতের ছানা রহস্য তাকে ডাকছে। অবশ্য তিঁনি মনে করেন প্রকৃতির কোন রহস্য নেই। সব স্বচ্ছ জলের মত পরিষ্কার। প্রকৃতির কোলে এসব ভূত ফূত কেবল বোকা মানুষের পেটে আর মগজে ঘুরে। এটা ভেবেই তার আরও বিরক্ত লাগল। একবার তিনি ভাবলেন যেটা নেই তার আবার কি রহস্য। বোতল ভূতের যে রহস্য ছোটবেলার বন্ধু জাফর সাহেব তাকে দিয়েছেন তার কিনারা করার চ্যালেঞ্জ নিয়ে তিনি বিশাল ভুল করেছেন। বোতলে কিছুই নেই। জাফর সাহেবের মতে এই ভূত কথা বলে প্রতি রাতে। আমগাছ জামগাছ তলার ভূত মনে হয়।

একবার জংগলে ক্যাম্প করতে গিয়ে শিকাগো ইউনিভার্সিটির প্রফেসর মিস্টার মুলার ও তার বন্ধুরা ভূতের আগুন দেখেছিলেন। মিসির আলী তখন সেখানে থিসিস করছিলেন। খবরটা তার কানে যেতেই পড়িমরি করে তা্ঁর প্রফেসর মুলারের কাছে ছুটে যান। প্রফেসরের পালসটা ঘটনার তিন ঘন্টা পরও ঠিক হয়নি। মনোবিজ্ঞানের একজন বিশ্ববিখ্যাত প্রফেসরের ভূত দেখে অজ্ঞান হওয়া তিনি মেনে নিতে পারেন নি। ভূতের বিস্তারিত জেনে একাই তিনদিন সেই জংগলে অবস্থান করে রহস্যের কিনারা করেছিলেন। প্রফেসর আর তার সঙ্গীসাথীরা সেদিন লেকের পাড়ে জমা খালি প্লাস্টিকের বোতলে মিথেন গ্যাসের আগুন দেখে তাকে ভূতের আগুন দেখেছিলেন। বরফে এমন আগুন অনেকেই দেখে ভূত বলে ভুল করে। আর ঠান্ডা বরফে সেই আগুনের আভা বহুদূর প্রতিপ্রভা তৈরী করে আরো ভৌতিক করে তোলে । আর এসব দেখেই সেই বাঘা প্রফেসরও সেদিন বিলাই হতে বাধ্য হয়েছিল। কত রহস্য যে কত মানুষ কে তার নিজ ডেরায় বন্দি করে তার হিসেব নেই। বনে যখন রাত নেমে আসে তখন অনেক বিজ্ঞানমনস্ক মানুষের মনেও কিছু খেলা করে। সেটা হয় অবিশ্বাসের ভূত নয়ত সত্যিকারের।

মিসির আলী সেদিনের কথা ভেবে তৃপ্তির একটা চুরুট ধরায়। আগে তার পছন্দ ফাইভ ফাইভ ফাইভ। কিন্তু এখন হাভানা থেকে ইম্পোর্ট করা চুরুট খাবেন। চুরুটগুলো মি. মুলারের উপঢৌকন। বা হাতে দেশালাইয়ে আগুন ধরিয়ে চুরুট জ্বালালেন মিসির আলী। এই ঝরঝরে আকাশের নিচে তিনি ধুয়ার কুন্ডুলী পাকিয়ে চুরুট খাচ্ছেন। প্রকৃতির সারপ্রাইজ দেখতে দেখতে হাভানা চুরুটের ধোয়া দিয়ে এক ধুম্রজাল তৈরী করছেন তিঁনি । গোল গোল ধোয়ার গোল্লা বানিয়ে আকাশে ছুড়ছেন আর তার ভেতর দিয়ে ধোয়ার বর্শা ছুড়ে মারছেন। খোলা পরিবেশে এমন খেলা তিনি প্রায়ই খেলেন। প্রকৃতির সামনে এমন চ্যালেঞ্জ নেওয়া তার রুটিনবাঁধা!


পরদিন সকালে বাসার পাশে রাস্তায় বিশাল রেইনট্রিতে হেলান দিয়ে মিশির আলী ভূত নিয়ে ভাবছেন।লাল টকটকে দুটি চোখ বলছে রাতে ঘুম হয়নি। একটা শিশু কণ্ঠ তাকে ডেকে তুলেছে।

-এই মিসির ভাই উঠ। চল বৃষ্টিতে ভিজি। জামগাছ তলায় ওরা ডাকছে।

মিসির আলী মনে করেন স্বপ্ন মানুষের ঘুমের মধ্যে ভেসে ওঠা এলোমেলো স্মৃতি। একবার বাবাকেও তিনি স্বপ্নে দেখেছিলেন। বাবা ঘুমের ঘোরে অনবরত নাক ডেকে চলেছেন। সে নাক ডাকার মধ্যে কিছু একটা বেজে ছিল। হয়ত কোন মেসেজ। তিঁনি ধরতে পারেন নি। এবারের টাও তার কাছে ভীষণ সমস্যা বলে মনে করছেন। মিসির আলী হুট করে ঠিক করলেন তিনি গ্রামে যাবেন। বাসায় এসে তিনি মতিকে ব্যাগ গুছিয়ে দিতে বলে গোসলে যাবেন এমন সময় মতি হন্তদন্ত হয়ে মিসির আলীকে বলল-

- স্যার,কিছু কথা ছিল।
- বল
- কাল রাতে একটা স্বপ্ন দেখেছি স্যার।
- কি স্বপ্ন
- এক বুড়ো একটা ছেলেকে নিয়ে জাম গাছ তলায় দাঁড়িয়ে। ছেলেটা আমাকে বলছে এই মতি ভাই উঠ। চল ভিজি। জামগাছ তলায় ওরা অপেক্ষা করছে।

মিসির আলীর মুখ শক্ত হয়ে ওঠে। তার মাথার ভিতরে কে যেন একটা মৌমাছি ছেড়ে দিয়েছে। চসমা খুলে টেবিলে রেখে মিসির আলী মতিকে বলেন চা বানিয়ে আনতে। মিসির আলী পকেট থেকে বের করে জাফর সাহেবের দেওয়া বোতলটি নেড়েচেড়ে দেখছেন। ঘোলাটে বোতলের ভেতরে কিছুটা ঘোলাটে। অনেক পুরোনো। জাফর সাহেবের কথামত তিনি বোতলের ছিপিটা খুলছেন না। নেড়ে চেড়ে দেখছেন।
কিছুই মনে হচ্ছে না। মতি চা দিয়ে গেছে। মিসির আলী দ্রুত চা খেয়ে নিচ্ছেন। তার হাত কাঁপছে।

ব্যাগ গুছিয়ে তিনি দ্রুত বাসার দিকে রওনা দেন। সারাটা পথে মিসির আলী ভাবছেন আর ভাবছেন। জাম গাছের কথা, শিশুর কথা বাবার কথা। ছোটবেলার সব স্মৃতিগুলো মনে নেই। কিছু আছে, কিছু নেই। গ্রামের পাশে বাস স্টপে নেমে তিনি গ্রামের বাসার দিকে এগিয়ে চলেন। তিনি বাস থেকে নেমে খেয়াল করে দেখেন তার পায়ে জুতো নেই। এমন সময় রাস্তায় তার একমাত্র চাচাতো ভাই আক্কাস তাকে চিনতে পেরে এগিয়ে এল।

- আরে মিসির ভাই না। ভাল আছিস? একা কেন? জাফর ভাই কই?
- হুম, আছি। তুমি কেমন আছ? আমাকে একটু জাম গাছ তলায় নিয়ে চল। জাম গাছটা আছে কি?
- আছে ভাই। কিন্তু কেন?
- আহ, চল। পড়ে বলছি।


মিসির আলী দীর্ঘ ত্রিশ বছর পরে গ্রামে এসেছেন। জামগাছ তলায় এসে তার মনে পড়ে গেল পকেটের বোতলটা শহরের বাসার টেবিলে রেখে এসেছেন। তাড়াতাড়ি করতে গিয়ে ভুলে বসেছেন। এমন অবস্থা তার হয় না। তিঁনি গোছানো মানুষ কিন্তু আজ হয়েছে। জাম গাছ তলায় এসে তিনি ছোটবেলার সব স্মৃতি মনে করতে পারছেন। আক্কাস তাকে প্রায়ই ঘুম থেকে ডেকে তুলত। বৃষ্টির দিনে সবাই এই জামগাছতলায় কাদার মধ্যে লাফালাফি করত। জাফর সাহেব জাম গাছে চড়ে জাম পাড়তেন। বৃষ্টিতে পিছলে জামগাছ থেকে বহুবার তার হাত পা ছড়ে গিয়েছিল। মিসির আলী ও তার দলবল তার সেবা যত্ন করত।চোখ চকচক করে উঠল। জাফর সাহেবের বোতল ভূত রহস্য তিনি বুঝে উঠেছেন। এক্ষুনি তিনি শহরে ফিরবেন।

-আক্কাস আমি যাব।
- সেকি ভাই, কেবল তো এলেন।
- আমি একেবারে ফিরে আসব কাল পরশু। শহরে আর নয়।
-ঠিক আছে। বাসায় চলেন। শিং মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে তারপর না হয় গেলেন।
- চল।


মিশির আলী শহরে ফিরে এসেছেন। জাফর সাহেবকে বোতল ভূত রহস্য সমাধান করে দিয়েছেন। তাকে আজই গ্রামে যাবার পরামর্শ দিলেন। জামগাছতলায় না গেলে আরো বিপদ। এমন সময় বৃষ্টি এলো।

মিসির সাহেব এখন আর প্রকৃতির সারপ্রাইজের কথা ভাবছেন না। তিনি ভাবছেন প্রকৃতির রহস্যের কথা। মিটিমিটি চোখে তিনি বোতলের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। তার চা খেতে মন চাইছে।

- মতি, এই মতি, এদিকে আয়।
- স্যার বলেন!
- তোর গ্রামে জামগাছতলায় তুই ছেলেদের সাথে দল বেধে ভিজতিস।
মতি অবাক হয়না। মিসির স্যারকে তার সবজান্তা বলে মনে হয়। একবার পাশের দোকানের দর্জি মেয়েটার সাথে তার চিঠিপত্র আদান প্রদান হয়েছিল। বহু চেষ্টায় মতি তা লুকাতে পারেনি। মিসির আলী প্রতিটি লাইন না পড়েও হবহু বলে দিয়েছিলেন। তার কাছে সত্য অস্বীকার করা মানে নিজের গু খাওয়া।

- জ্বী স্যার। প্রতিবার ঝড়ে বহুত জাম পড়ত। আমরা জাম খাইতে জাইতাম।
- হুম।
- যা, চা নিয়ে আয়।

মিশির আলী বোতলের ছিপি খুলে ভূতকে মুক্ত করে দিলেন। আকাশে ভুতের ছানা উড়ুক। তারও যে স্বাধীনতা দরকার জাফর সাহেব সেটা বুঝতে পারেনি। প্রকৃতির সারপ্রাইজ বঞ্চিত ভূতের ছানা বোতলে নয়, প্রকৃতিতে উড়ছে।মিসির আলী তার পুরোনো ধোয়ার গোলায় ধোয়ার বর্শা নিক্ষেপ খেলায় মেতে উঠলেন। চুরুটের সাদা ধোয়ায় ঘরে হাজারটা চুরুটের ধোঁয়ার ভুতের নাচন শুরু হল।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই আগস্ট, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:২৫
৩৭টি মন্তব্য ৩৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×