somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বায়ুবৎ কর্তৃপক্ষ, প্রাইভেট-পাবলিক ইউনির্ভাসিটি ও ছাত্র আন্দোলন

০১ লা আগস্ট, ২০১০ দুপুর ১২:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



১.
আমরা তখন থার্ড ইয়ার ফাস্ট সেমিস্টারে, পি.এল চলা কালে আমাদের ব্যাচের ৪/৫ জনের চিকেনপক্স দেখা দেয়। সাথেসাথে আমরা কয়েক জন ডিপার্টমেন্টাল হেডের কাছে দেখা করে বলি, “স্যার, পরীক্ষা যদি ১০/১২ দিন পিছিয়ে দিতেন তাহলে এই ছেলেগুলোর জীবন থেকে একটা বছর বেঁচে যায়”

স্যার বললেন, “আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করে তোমাদের জানাচ্ছি।

‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের’ মারফত জানতে পারলাম, “কেয়ামত হয়ে যাবে, তবুও পরীক্ষা যথা সময়ে হবে”

আমরা বললাম, “ঠিক আছে, পরীক্ষা আমরা যথা সময়ে দেব, কিন্তু যে কয়জন অসুস্থতার কারনে পরীক্ষা দিতে পারবে না তাদের পরীক্ষা; ছুটির মধ্যে নিয়ে নিতে হবে”

‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ’ এইবার জানালেন এমন কোন নিয়ম ইউনিভার্সিটির রেজুলেসনে নেই, তাই দুনিয়া উলট পালট হয়ে যাবে বাট পরীক্ষা-পরবর্তী তিন সপ্তাহ ব্যাপি ছুটিতে কোন পরীক্ষা নেওয়া হবে না।

এইবার আমরা বিক্ষোপে ফেটে পড়লাম, ইত্যবসরে চিকেনপক্স আক্রান্তের সংখ্যা ১১ জন হয়ে যায়, সিদ্ধান্ত নিলাম সি.এস.ই ডিপার্টমেন্টের কোন ব্যাচ পরীক্ষা দিবে না। ১১ জনের জীবন থেকে এক বছর নষ্ট হয়ে যাওয়া থেকে ১৮০ জনের জীবন থেকে দুই সপ্তাহ নষ্ট হওয়া অনেক যুক্তিযুক্ত ও এফোর্ডেবল। আমরা যেহেতু ছিলাম সিএসসি ডিপার্টমেন্টের প্রথম ব্যাচ, তাই ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র মোস্ট হিসাবে আন্দোলনের সিংহভাগ দায়িত্ব এসে পড়ে আমাদের উপর। সব ব্যাচের ছাত্রদের একত্রিত করা, মিটিং কল করা, স্যারদের সাথে যোগাযোগ, কর্মসূচি দেওয়া এইসবই আমাদের করতে হতো।

আজ খুব গর্বকরে বলতে পারি আমাদের এই আন্দোলন ছিলো কুয়েটের ইতিহাসে সফলতম আন্দোলন। আর এটা সফল হওয়ার অন্যতম কারন ছিলো দুটি,

ক) একেবারে প্রথমেই আমরা বাকী দুই ব্যাচের জুনিয়র ছেলেদের ডেকে বলেছিলাম, “শুধু আমাদের ব্যাচের ১১ জনের আজ একবছর শিক্ষা জীবন নষ্টের পথে, তোমাদের এতে কোন কিছু যায় আসে না, তোমরা আমাদের সাথে আন্দোলনে থাকতেও পার আবার নাও পার, পুরাপুরি তোমাদের ইচ্ছা। তোমরা থাকলে আমরা সবাই মিলে অবশ্যই অবশ্যই সফল হব, আর না থাকলে একটু অসুবিধা হবে, কিন্তু তারপরেও আমরা সফল হব, কিন্তু এতে করে তোমরা ভবিষ্যতে আমাদের সব ধরনের সমর্থন থেকে বঞ্চিত হবে। আর একটা কথা মনে রাখবে কর্তৃপক্ষ ২/৩ জনের বিরুদ্ধ্যে লড়তে পারে, ৪/৫ জনের কণ্ঠরোধ করতে পারে কিন্তু কোনভাবেই ১৮০ জনের বিরুদ্ধ্যে জয়ী হতে পারে না, ১৮০ জনের যোক্তিক দাবীকে উপেক্ষা করতে পারে না”। সেই সময় আমাদের ছোট ভায়েরা নিঃস্বার্থ, স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন দিয়েছিলো।

খ) আমাদের মধ্যে নানান ধরনের গ্রুপিং ছিলো, যেমন, “ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, তাবলীগ, ছাত্র ইঊনিয়ন, হলের রুম নিয়ে গ্রুপিং, বিড়িখোর গ্রুপ, গাঞ্জা গ্রুপ, জুয়ারী গ্যাং ইত্যাদি ইত্যাদি (প্রথম গ্রুপটার পাতি-নেতা আর শেষের তিনটি গ্রুপের অন্যতম সক্রিয় সদস্য ছিলাম B-)B-) আহা! সে জীবনের এক অন্ধকার অধ্যায়)। আন্দোলনের প্রথম থেকেই আমরা এইসব গ্রুপিংকে একেবারে বেমালুম ভুলে গিয়ে কি এক অদ্ভুত আবেগে একিভূত হয়ে গেলাম।

তারপরের সে এক বিশাল ইতিহাস, স্যারদের নানান ভয়ভীতি, আবদার, অনুরোধ হাইকোর্ট কোনকিছুই আমাদের টলাতে পারেনি। একেএকে সব গুলো পরীক্ষার ডেট পার হয়ে গেলে এবং আমাদের অসুস্থ ১১ জন সুস্থ হয়ে ফিরে এলে আমরা স্যারকে গিয়ে বলি, “হ্যা, এইবার আমরা রেডী, বলেন কবে পরীক্ষ নিবেন?”

বলা বাহুল্য সেই সেমিস্টারে স্যারেরা কোন পরীক্ষাই নেননি। পরের সেমিস্টারে দশটা পরীক্ষা এক সাথে দিতে গিয়ে জান বের হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু সবাই হাসিমুখে এই কষ্ট মেনে নিয়ে ছিলাম।
অথচ এই সব কিছুই কত সহজেই পাশকাটিয়ে যাওয়া যেত! শুধু যদি আমাদের যোক্তিক যেকোন একটা দাবী মেনে নেওয়া হতো! আসলে আমাদের সমসময় ‘ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষ’ এক বায়বীয় হাইকোর্ট দেখিয়ে দমিয়ে রাখা, নাজেহাল করার এক অদ্ভুত প্রবনতা প্রশাসনে দেখা যায়। এর থেকে যত তাড়াতাড়ি বের হয়ে আসা যাবে জাতির জন্য ততই মঙ্গল।

২.
প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির টিউশন ফী-র উপর সরকার হঠাৎ করে কার বুদ্ধিতে কর বসাতে গেলো সেটা এখনো আমার মাথায় ধরছে না। সরকারের উচ্চপর্যায়ে যে সব নীতি নির্ধারকরা বসে আছেন তাদের বিচক্ষণতার উপর আমার কোন কালেই আস্থা ছিলো না, তাই অবাক হইনি, তবে কিঞ্চিৎ অবাক হয়েছি তুখোড় বাম নেতা নুরুল ইসলাম নাহীদ শিক্ষামন্ত্রী থাকা অবস্থায় এটা হলো বলে। অবাক হয়েছি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের নির্লিপ্ততা, উন্নাসিক মনোভাব দেখে। বাম ছাত্রসংগঠন গুলোর প্রতি আমার অন্যরকম আস্থা ছিলো, অন্ততপক্ষে তারা একটি বিবৃতি দিয়ে এর ন্যায্য এই আন্দোলনের সাথে একত্বতা প্রকাশ করতে পারতো।

আমাদের মধ্যে নানান ধরনের গ্রুপিং, দলাদলি, বিভাজন বিদ্যমান। বলার অপেক্ষা রাখে না যে পাবলিক-প্রাইভেট ইসুতে ছাত্র সমাজ সুস্পষ্টভাবে দুটি ধারায় বিভক্ত। এটাকে আমার অসুস্থ অবস্থা মনে হয়; পজিটিভ কারনে এমন বিভাজন মেনে নিয়ে যায়, কিন্তু ন্যায্য দাবিতে আন্দোলনরত লিলিপুটের দল যখন দানবতুল্য পেটোয়াবাহিনীর সামনে বুকচিতিয়ে দাড়িয়ে থাকে তখন কিভাবে এই বিভাজন মেনে নেই?

বাঙ্গালি মাত্রই কৌতুহলি, ঠিক যেভাবে “বিলাই মরে কৌতুহলের কারনে”। রাস্তায় দুই রিকসাওয়ালা কিলাকিলি করলে শত শত লোকের ভিড় জমে যায়, মজাই মজা। রাস্তায় একটু খুড়াখুড়ি হলেও তার চারপাশে দেখা যাবে মজা লুটেরারা ভিড় করছে। প্রাইভেটের ছাত্ররা যখন রাজপথে আন্দোলনের জোয়ারে ভাসছে, সরকারের পেটোয়া বাহিনীর হাতে মার খাচ্ছে পড়ে পড়ে পাবলিকের ছাত্র হিসাবে দূর থেকে বসে মজা নেওয়াটা ঠিক এমনই মনে হয়েছে আমার। অথচ আমরা বারবার ভুলে যাই, স্বতঃস্ফুর্ত আন্দোলনকে চোখ রাঙিয়ে দমিয়ে রাখা যায় না, আর সেই আন্দোলন যদি হয় ন্যায্য দাবিতে তাহলে একে ঠেকাবে সাধ্য কার!

অথচ সব ধরনের গ্রুপিংকে এক পাশে রেখে পাবলিকের ছাত্র বা প্রাইভেটের ছাত্র এই পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে শুধু ছাত্র পরিচয়টাই যদি আমাদের কাছে বড় হয়ে দেখা দিত তাহলে কতোইনা ভালো হতো! যদি প্রাইভেটের ছাত্ররা এই আন্দোলনে সফল না হতো তবে অবধারীত ভাবে পরবর্তীতে প্রাইভেট কলেজ ও স্কুল, কিন্টারগার্ডেনগুলোও এর আওতায় আসতো। প্রাইভেটের ছাত্রদের এই অর্জন জাতীকে সুদূরপ্রসারি এক চক্রান্ত থেকে আপাতত রক্ষা করেছে। এই অর্জন শুধু মাত্র প্রাইভেটের ছাত্রদের। শুধুই তাদের। তোমাদের লাল সালাম ও অন্তর থেকে শুভেচ্ছাবাদ জানিয়ে গেলাম। অথচ আর একবার সালাম জানাতে পারতাম সমগ্র ছাত্র সমাজকে।

৩.
বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন ছাত্র যখন ভর্তি হয় তখন তার মাথায় প্রথমেই যা থাকে তা হলো, পড়াশুনা করতে হবে, দেশকে কিছু দিতে হবে, অন্তত পক্ষে আত্মউন্নয়ন করতে হবে। আন্দোলন করতে হবে, ভাংচুর করতে হবে বা মিসিল করতে যাবো এমন চিন্তা ক্ষুণাক্ষরেও কেউ করে কিনা সন্দেহ। কিন্তু আমাদের সিস্টেমে এমন পশ্চাৎদেশ নি:সৃত বায়ুবৎ এক কর্তৃপক্ষ আছে যার কারনে শেষ অস্ত্র হিসাবে ছাত্রদের বেছে নিতে হয় চরমপন্থা।

ঠিক যেমন চলছে চিটাগাং ইউনিভার্সিটিতে। জানি না আমাদের বায়ুবৎ কর্তৃপক্ষ কবে তরল আকার ধরন করবেন। একটা জিনিস তাদের মনে রাখতে হবে ছাত্রদেরকে দমনপিড়ন চালিয়ে যৌক্তিক দাবি থেকে সরিয়ে আনা যায় না, তারুন্যই তাদের সবচেয়ে বড় শক্তি। তারা যেকোন মূল্যে বেতন বৃদ্ধি ও ক্রমান্বয়ে প্রাইভেটাইজেশন রুখে দিবে এ আমার বিশ্বাস। যে দুটি কৌশল অবলম্বন করে আমরা সফল হয়ে ছিলাম তাদেরকেও তাই করতে হবে। আমি আশা করবো দেশের আপাময় ছাত্রসমাজ এই অপচেষ্টার বিরুদ্ধ্যে রুখে দাঁড়াবে, কি ঢাবি, কি খুবি, বুয়েট, কি চুয়েট, প্রাইভেট পাবলিক নির্বিশেষে সবাই।
২৭টি মন্তব্য ২৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিব নারায়ণ দাস নামটাতেই কি আমাদের অ্যালার্জি?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৫:৫৭


অভিমান কতোটা প্রকট হয় দেখেছিলাম শিবনারায়ণ দাসের কাছে গিয়ে।
.
গত বছরের জুন মাসের শুরুর দিকের কথা। এক সকালে হঠাৎ মনে হলো যদি জাতীয় পতাকার নকশাকার শিবনারায়ণ দাসের সঙ্গে দেখা করা সম্ভব... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতি মাসে সামু-ব্লগে ভিজিটর কত? মার্চ ২০২৪ Update

লিখেছেন জে.এস. সাব্বির, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৮

মার্চ ২০২৪ সালে আমাদের প্রিয় সামু ব্লগে ভিজিটর সংখ্যা কত ছিল? জানতে হলে চোখ রাখুন-

গত ৬ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভিউ ছিল জানুয়ারি মাসে। ওই মাসে সর্বমোট ভিজিট ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×