somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সিগন্যালের মুখগুলো...

২৬ শে মে, ২০০৮ রাত ৮:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমি বাসে চড়া পাবলিক। গাড়ি ঘোড়া আমার পোষায় না। মাঝে মাঝে বাসা থেকে দয়া করে আমাকে গাড়ি দেওয়া হয়। তখন এই বিলাসিতাটুকু প্রহসনের মত ঠেকে। আমার এমনও ইতিহাস আছে যে অনভ্যাসজনিত কারণে গাড়ি ক্যাম্পাসে রেখেই আমি ৫:৩০ এর চৈতালী ধরতে কার্জনে ছুটেছি এবং বাসে করেই বাসায় ফিরে এসেছি। অতঃপর গাড়িকে আসতে হয়েছে একা একা। তবে গাড়ি চড়া যে একেবারেই খরচের ব্যবসা তা কিন্তু না বরং গাড়ি চড়লে মাঝে মাঝে অদ্ভুত কিছু মানুষ চোখে পড়ে। এদের বসবাস সিগন্যালে। এরা বাসের যাত্রীদের দিকে কেমন যেন অবজ্ঞার দৃষ্টিতে তাকায়। তাই গাড়ি না চড়লে এদের দেখা মেলা ভার...


১.
শাহবাগের মোড়ের সিগন্যালে গাড়ি থেমে আছে। একজন বৃদ্ধ ছোট্ট একটা মেয়েকে সাথে করে ভিক্ষা করছেন। বাচ্চা মেয়েটার টিউমার। তার চিকিৎসার জন্যে সাহায্যের প্রয়োজন। হঠাৎ পাশ থেকে কর্কশস্বরে কে যেন বলে উঠল, “শালার বেডা!!! ৫ বছর হইয়া গেল এইখানে ভিক্ষা করতাছ। এখনও চিকিৎসা করাইতে পারো নাই। হুহ!!!” আমি ফিরে তাকিয়ে দেখি বয়সের ভারে ন্যুব্জ এক বৃদ্ধাকে। আমি তার এই হিংসামিশ্রিত ক্রোধের উৎস খুঁজে ফিরি। আহা বেচারির সারা দেহে বার্ধক্য ব্যতীত আর কোন ক্ষত নেই। টিউমারের মত দামি রোগের সাথে পাল্লা দেবে এই ক্ষমতা কি আছে তার বার্ধক্যে? বৃদ্ধার এই আক্রোশ কার প্রতি আমি ভাবি। এ ক্রোধ কি ঐ বৃদ্ধ আর শিশুটির প্রতি নাকি নিজের অক্ষমতার প্রতি!!! নাকি এ ঈশ্বরের প্রতি তার ধিক্কার- তার প্রতিবাদ এই বৈষম্যের জন্যে। আমি আমার প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সামনে তাকিয়ে দেখি ক্লান্ত দেখে হাঁটতে হাঁটতে সেই মুখটি মিশে যাচ্ছে ব্যস্ত মানুষের ভিড়ে...


২.
কাওরান বাজারের মোড়ের সিগন্যালে পড়ব না এমন দিন খুঁজে পাওয়া সত্যিই কঠিন। বয়েস হচ্ছে। আজকাল অনেককিছুই বিস্মৃত হচ্ছে। আমি স্মৃতি হাঁতড়ে বেড়াচ্ছি এমন একটা দিন খুঁজে বের করতে। হঠাৎ মিষ্টি একটা হাসি ভেসে উঠে হৃদয়পটে...

বেশ কিছুকাল আগের কথা। কাওরান বাজারের সিগন্যালে বসে আছি। হঠাৎ শুনি রিনরিনে স্বরে কেউ বলছে, “আফা, পুরা আডি ১০ ট্যাকা”। আমি প্রচন্ড বিরক্তিতে ধমক দিতে গিয়েও থেমে গেলাম। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি আমি। কত বছর এত্ত পবিত্র হাসি দেখিনি। বোধকরি কিছু জিনিসকে অবজ্ঞা করার ক্ষমতা দিয়ে সৃষ্টিকর্তা আমাদের পাঠাননি। আমি দীর্ঘশ্বাস গোপন করে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ১০ টাকার নোটটা বাড়িয়ে দিলাম। ছোট্ট মেয়েটি মিষ্টি হেসে তোঁড়াটা এগিয়ে দিতেই বললাম, “লাগবে না, ওটা তোমাকে দিলাম। তুমিই রাখো”। মেয়েটি বিস্মিত নয়নে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

আমি জানি এই আবেগ ক্ষণিকের, বড় সাময়িক, বড়ই ঠুনকো। আমি এও জানি এই ফুলের আঁটি আবার কেউ কিনবে ১০ টাকায়। তারপরও মাঝে মাঝে আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে- তীব্র ভালবাসা, গভীর মমত্ত্ববোধের মত আবেগগুলোকে অবজ্ঞা করার মত ক্ষমতা কি তিনি তার সৃষ্টিকে দিয়েছেন কিনা!!!

সিগন্যাল ছেঁড়ে দিয়েছে। গাড়ি চলতে শুরু করেছে। আমি পেছনে না তাকিয়েও বলতে পারি এক জোড়া বিস্মিত নয়ন এখন আমাকে অনুসরণ করছে। আর আমি- আমি তখন উত্তরের অপেক্ষায় প্রশ্নকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছি সামনের দিকে; নতুন কোন প্রশ্নের আশায়...


৩.
এমনিতেই প্রচন্ড দেরি হয়ে গেছে। আল্লাহ আল্লাহ করছি যেন জ্যামে না ফেলে। কোন একটা অগ্যাত কারণে আজকে ফার্মগেটে তেমন জ্যাম নেই। ড্রাইভারও দেখলাম টান দিয়েছে তেমনই...

কিন্তু শালার সিগন্যালটা আটকে দিল। মেজাজটাই গেল খিঁচড়ে। শালার কি যে ফাঁটা মার্কা কপাল লিখায়ে আনছিলাম উপর থেকে আল্লাহ মালুম। একে তো দেরি হয়ে যাচ্ছে সেই টেনশন; তার উপর প্রচন্ড বিরক্তি- দুই মিলে মুখে থুতু জমতে শুরু করেছে। আমি জানালা খুলে এদিক ওদিক তাকালাম কুকর্মটা সম্পন্ন করার আশায়। চোখ আটকে গেল ৭- ৮ বছরের একটা ছোট্ট ছেলের উপর। হাতে রঙ বেরং এর তোয়ালে। সিগন্যাল পড়েছে কিন্তু ছাগলটার সেদিকে নজর নাই। তার ছোট্ট চিন্তার জগৎটা জুড়ে আছে সিনেমা হলের উপরের টিভির বড় পর্দাটা। শালার বেকুব- বাসায় হয়ত পঙ্গু রিকশাচালক বাবাটা পড়ে আছে বিছানায়, সারাদিনের অভুক্ত ছোট্ট বোনটা হয়ত অপেক্ষা করছে ভাই কখন আসবে, মানুষের বাড়িতে সারাটা দিন ছুটা খেটে ক্লান্ত মা হয়ত এত্তক্ষণে বাসার দিকে রওয়ানা হয়েছে- অথচ সবকিছু ভুলে বেকুবটা তাকিয়ে আছে স্ক্রিনের দিকে... তিন্নি তখন বলছে, “আমরা ভাল আছি, আপনি ভাল আছেন তো?” হায়!!! বলদটা এখনও শিখেনি এই সমাজে গরীব হয়ে জন্মিয়ে এমন বিলাসিতা মানায় না। সিগন্যালে এখন সবুজ বাতি জ্বলে উঠেছে। অথচ ভাদাইম্যাটা এখনও তাকিয়ে আছে স্ক্রিনের দিকে। প্রচন্ড বিতৃষ্ণায় আমি পিচিক করে থুতুটা ফেললাম।


৪.
শেরাটন মোড়ের সিগন্যাল। গাড়িতে বসে আছি। দৃষ্টি আকাশ পানে। একটু আগেও এমন ঝাঁঝালো রোদ ছিল মনে হচ্ছিল প্রচন্ড গরমে পুরো শহরটা যেন ঘামছে। অথচ এখন ঝলসানো আকাশটার নীল বুকে একটু একটু করে ধূসর মেঘ জমছে ক্ষতের মত। মনের ক্ষতগুলো একটু একটু করে যেন আকাশের বুকে ফুটে উঠছে। আমি প্রচন্ড তৃষ্ণা নিয়ে অপেক্ষা করছি কখন আকাশ ভেঙ্গে ঢল নামবে সেই ক্ষণের। কেননা আজ যে আমিও শহরটার সাথে সাথে মেতে উঠব বৃষ্টিবিলাসে। আমি স্নায়ু টানটান করে অপেক্ষা করছি সেই মহেন্দ্র ক্ষণের... আমি তৃষ্ণার্তের মত বসে আছি... আমি বসে আছি বৃষ্টি শেষে মেঘের মত নিঃস্ব হতে...
১০১টি মন্তব্য ৩৯টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×