মা খুবই এক্সাইটেড । ঘটা করে পাত্রী দেখছেন আমার জন্য । পাত্রীর এটা পছন্দ হয়তো ওটা হয়না । যথাসম্ভব নিখুঁত একটা বউমা চাই তাঁর । বউমার সাথে সম্পর্কের রসায়ন টা কি হবে , কতটা আদরে তাকে বুকে জড়িয়ে রাখবে সে হিসেব কষতে কষতেই সময় পার। আমি ভাবি , কি বিচিত্র ! যে মা ভাবী বউমাকে নিয়ে এত এক্সাইটেড সে মা ই ছেলের হলুদ গোসলে হলুদ মাখাতে গিয়ে এক অজানা কারণে কেঁদে ফেলবে। ছেলের বিয়ে যাত্রায় দুধ ভাত খাওয়াতে গিয়ে হাত কাঁপবে কিংবা সালাম দিয়ে বিদায় নেবার সময় জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদবে । হয়তো এই ভেবে যে ছেলেকে সুদীর্ঘ ৩০ টি বছর নিজের অধিকারে রেখেছেন , আজ নিমিষেই সে অধিকারে অন্য কেউ ভাগ বসাবে । যে ছেলের হৃদয়ের প্রায় পুরোটা জুড়েই ছিলো মা আজ সেখানে বিস্তার করবে অন্য কারোর আধিপত্য। আমি বলি মা জেনেশুনে কেন বিষপান করছেন । আপনিতো আপনার ছেলেকে হারাবেন । মায়ের শুষ্ক হাসিতে জবাব , তবুও আমার একটা বউমা চাই । কি বিচিত্র ! আমি দ্বিধায় পড়ে যাই।
আজ আমাদের পঞ্চম এনিভার্সারি । তিন বৎসরের ফুটফুটে শুভ ঘরময় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে । ওর এই পৃথিবীটা বড় বেশী নির্জঞ্ঝাট । ও বড্ড মা ঘেঁষা । মা'র সাথেই ওর যাবতীয় হিসেব নিকেশ । মাকে বোধ হয় অনেক বেশী ভালবাসে । আমিও কি আমার মাকে এরকমই ভালবাসতাম ? নাকি এর চাইতেও বেশী ? নাহ মনে করতে পারছিনা ।
মা গত হয়েছেন প্রায় সাড়ে তিন বৎসর হতে চলল। বউমাকে নিয়ে মায়ের দেখা প্রতিটি স্বপ্নই দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছিলো । এক রাক্ষুসে ভালোবাসার অক্টোপাসে আমি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়ছিলাম । আমি বুঝতেই পারিনি আমি একটা মেরুদণ্ডহীন সরীসৃপ হতে চলেছি । মার কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম । শয়নে , স্বপনে , জাগরণে আমার সমগ্র অস্তিত্ব জুড়ে শুধুই আমার প্রেয়সী। মনে হতে লাগল আমার জন্মই বুঝি ওর জন্য । ও ছাড়া আমার জীবন অর্থহীন । অথচ আমি ভুলেই গিএয়েছিলাম গত ত্রিশ বছর ধরে কত বিনিদ্র রাত, কত ত্যাগ তিতিক্ষা দিয়ে একজন আমায় ভালোবাসার চাঁদরে জড়িয়ে রেখেছিলেন। মুহুর্তেই সে ভালোবাসা আমার কাছে গৌণ হয়ে গিয়েছিলো । আমি বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম কত স্মৃতি, কত হাসি-কান্না-আনন্দ আমার মায়ের সাথে জড়িয়ে । যেখানে প্রতিদিন প্রতিবার ঘরের বাহির হবার সময় মায়ের দোয়া নেয়া ছিলো অবধারিত , সেখানে আজ নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রেয়সীর অভিশপ্ত আলিঙ্গন। আমি বুঝতেই পারিনি আমি কতটা পশু হয়ে যাচ্ছি । প্রতিদিন অফিসে যাওয়ার সময় মা অধীর আগ্রহে বসে থাকতেন এই বুঝি তাঁর খোকা এসে বলবে--- মা আমি অফিসে যাচ্ছি , দোয়া কর। আর তিনি প্রাণ ভরে ছেলের জন্য দোয়া করবেন , কিন্তু প্রতিদিনই একটা নিঠুর আঘাত মায়ের হৃদয়টাকে দুমড়ে মুচড়ে দিত । নিদারুণ আঘাত নিয়েও মা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতেন , যতক্ষণ খোকা কে দেখা যায় ততক্ষণ গ্রীল ধরে দাড়িয়ে থাকতেন আর আচলে চোখ মুছতেন । এতটা আঘাত মা নিতে পারেননি । প্রচণ্ড মানুষিক আঘাতে আঘাতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছিলেন । প্রায়শই আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাতেন , সে দৃষ্টিতে ছিলো এক ধরনের অবিশ্বাস আর অনুযোগ । কি যেন বলতে গিয়েও বলতেননা । হয়তো তাঁর ত্রিশ বছরের চেনা খোকা এত আমূল বদলে যাবে এটা বিশ্বাস করতে পারছিলেননা । তবুও মা প্রতিদিন জায়নামাজে বসে চোখের পানি ফেলতেন আর আমার জন্য দোয়া করতেন । আমি যেন সুখী হই , বউমা যেন আজীবন এরকম সুখে থাকে ।
পৃথিবীতে বেঁচে থাকার শেষের দিকের সময় গুলোতে মা প্রায় অস্থির হয়ে পায়চারী করতেন , আমি ঘরে আসলেই মা সময়ে অসময়ে আমার ঘরে চলে আসতেন । উস্ক-খুস্ক বেশে স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতেন । প্রথম প্রথম গুরুত্ব না দিলেও একসময়ে এসে আমার চৈতন্য হয়। বুঝতে পারি কিছু একটা গড়বড় হয়ে গিয়েছে । বিয়ের পরবর্তী সময়টাকে পোস্টমর্টেম করতে বসলাম । সিনেমার রিলের মত সব কিছু আমার মানস্পটে এসে ধরা দিল। কি করেছি, কি করিনাই কিংবা কি করা উচিত ছিলো ? কিন্তু ততদিনে সব শেষ । তীব্র অনুশোচনায় দগ্ধ হতে থাকলাম আমি । পৃথিবীতে বেঁচে থাকাটা অর্থহীন মনে হতে লাগল। যতক্ষণ ঘরে থাকতাম মায়ের হাতটা বুকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকতাম । মায়ের চুল আঁচড়িয়ে দিতাম, নিজ হাতে খাইয়ে দিতাম। মা পরম পরিতৃপ্তিতে খোকার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতেন । তারপর একসময় সব শেষ ।
শুভ কখন যেন এসে আমার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে । ওর অদ্ভুদ নিষ্পাপ সুন্দর মুখটার দিকে চেয়ে আছি । যদি সব কিছু ঠিক থাকে তাহলে আনুমানিক ২৫ বছর পর শুভর মা ওর জন্য প্রচণ্ড এক্সাইট্মেন্ট নিয়ে মেয়ে দেখবে । একটা যথাসম্ভব নিখুঁত মেয়ে বউ হিসেবে ঘরে আনবে। বউমাকে নিয়ে জানা অজানা স্বপ্নে ভাসবে । ততদিনে কি শুভ বদলে যাবে? একটা রাক্ষসে ভালোবাসার অক্টোপাসে বাধা পড়বেনাতো ? তাঁর মা কি প্রতিদিনকার আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়ে নিঃশেষ হয়ে যাবে? ধুর কি ছাই ভাবছি............
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই মে, ২০১৭ সকাল ৭:৩১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




