সাদা কাগজটাতে ঘসাঘসি করে যাচ্ছি অনেকক্ষণ। কলমের আঁকিবুকি। একটা গল্প লিখব ভাবছি। প্রধান চরিত্রের নাম শিউলী। বাইশ বছর বয়সী। সুন্দরী, শিক্ষিতা, বিবাহিত। সোবহান নামের এক ছেলের সাথে চটুল প্রেম করে। এভাবে কাহিনী এগুবে। লেখা তেমন আগাচ্ছেনা না। মাথা ফাঁকা। যেই জানালার পাশে আমার লেখার টেবিল, সেই জানালাটা পশ্চিমে মুখ করা। জ্বলন্ত সূর্য চোখে পড়ে না। শুধু হেলে পড়া সূর্য আমার সঙ্গী।
যেই বাসাটায় থাকি, সেটা নিখুঁত একটা আয়তক্ষেত্র। চারতলার সিঁড়ি বেয়ে উঠে ডান দিকে ফিরলে পাশাপাশি দুটো দরজা। একটা দিয়ে ঢুকলে ড্রয়িং রুম। এখানেই আসলে থাকি আমরা। আরেকটা দিয়ে ঢুকলে চিকন একটা করিডর। সামনে যাবার। এখান দিয়ে ঢুকে সামনে এগুলে অথবা ড্রয়িংরুমটা পেরুলে পড়বে ডাইনিং স্পেস। কোন টেবিল নেই। একটা শিতলপাটি পড়ে আছে। এখানে দাঁড়িয়ে বাম দিকে মুখ করলে পাশাপাশি দুটো রুম। ওদুটোয় সাবলেট দিয়েছি। এক কর্মজীবী ভদ্রমহিলা থাকে। সারাদিন বাইরে চাকরী করেন। সন্ধ্যার দিকে ঘরে ফিরেন। আর, পাশের রুমে উনার বৃদ্ধ শাশুড়ি থাকেন। মহিলার কিছু একটা রোগ আছে। অথবা, হয়ত বয়সের ভারে ন্যুজ। কারও সাথে কথা বলেন না। ঝিম মেরে থাকেন। ঘরে থেকেও নেই। নিজের রুমের বাইরে বের হন না।
যাক, রুম দুটোর ঐ পাশে বারান্দা। আরেকটা বারান্দা ডাইনিং স্পেসের এইদিকে। ড্রয়িংরুমেই আমাদের খাট। আমার লেখার টেবিল। নিজেদের তিন রুমের ঘরে আমি সাবলেট দিয়েছি দুটো রুম। এই বাড়িটা ফুফার। ফুফা আমাকে এই ফ্ল্যাটটা দিয়েছেন নামে মাত্র ভাড়ায়। সাবলেটের ভাড়ার টাকাটাই ফুফাকে দেই। আমরা দুজনেই শুধু জানি।
আমি, মিলি আর আমার ছোট্ট ছেলে বাবু। এই আমাদের সংসার। আমি আর মিলি এক সময়ে পালিয়ে বিয়ে করি। অতীত স্মৃতি। এসব এখন বিশ্বাস হতে চায় না। মনে হয়, আদৌ কী এসব দিন ছিল! মিলি এখনও আগের চেহারা ধরে রেখেছে। হাজার অনটনের মাঝেও সে কখনও অভিযোগ দেয় না। কোন অভাবের কথা বলে না। বলে না যে এটা নেই, ওটা নেই। মাঝখান দিয়ে আমিই বোধ হয় আরও বুড়ো হয়ে গেলাম। আসলে খুব বেশি একটা বয়স কিন্তু হয়নি। লেখকরা কেন যেন আগে আগে বুড়ো হয়ে যায়। তাদের চিন্তা যে বেশি। তাও যদি সত্যিকারের বড় লেখক হতাম।
আমি একটা সাহিত্য পত্রিকায় লেখালিখি করি। এটুকুই। আর কিছু পাই না করার। সেখানেও ইদানীং লিখতে পারিনা। আমার লেখা নাকি পাবলিক খায় না। “বুঝলে, শাহেদ, এখনকার যুগ মোবাইলের। গল্প বুঝার পাবলিক কই? আর, তুমিই বা এমন গল্প লেখ কেন? গল্প লিখবা বড়লোকের। কেএফসি তে একটা মেয়েকে দেখে প্রেমে পড়ে গেল পাভেল—এই সব টাইপ। নইলে, লাইব্রেরীর সিড়িতে বসে নতুন মেয়েটিকে দেখে অবাক হল পলাশ। কাহিনী বানাবা এই রকম।সামনের দিকে দিবা আঠা আঠা যৌনতা। বলেও বলবা না। আর নায়িকা অবশ্যই প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়বে বুঝছ? নইলে এইসব আঠা আঠা ব্যাপারগুলা ম্যাচ করেনা। পাবলিকের ডিমান্ড।”, সম্পাদক সাহেব অনেক ভাবেই বুঝিয়ে বলেন আমাকে। আমিও বুঝি।
ইদানীং আমার লেখা নিতে উদাসীন তিনি। সারাদিন বসে থাকলে হয়ত এক কাপ চা খাওয়ান। আগের মত খাতির নেই। আসলে হয়ত আমারই দোষ। পাবলিক ডিমান্ডের লেখা লিখতে পারিনা। কী করব ! মাথায় আসে না ইদানীং। কষ্টের লেখা ছাড়া লিখতে পারিনা।
বাবু আর আগের মত ছোটটি নেই এখন। আর, আদো আদো কথা বলেনা। বাথরুমে যেয়ে ভয় পেয়ে কান্না কাটি করে না। বাবার সাথে বল খেলা নিয়েও তার আর আগ্রহ নেই। অপুষ্টিতে শরীর তেমন বাড়েনি ওর। ও এখন ‘চাই চাই’ স্টেজে। আমি ওকে টেবিলে বসিয়ে বলব, “ওই দেখ মেঘের ভেতর হাতি ”, এসবে আর আগ্রহ নেই ওর। এসব বলা বাবার চেয়ে খেলনা পিস্তল গিফট করা রেহান চাচাকেই বেশি পছন্দ তার। রেহান তার জন্য ব্যাট আনবে, মাঝে মাঝে বল। কোনদিন চকোলেট। রেহান আমার ফুফাত ভাই। এই ফ্ল্যাট যাদের।
রেহান কখনও ঘরে এসে আমাকে দেখলে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। আমার সাথে অল্প দুয়েকটা কথা বলে উঠে যায়। বারান্দায় যেয়ে মিলির সাথে কিছুক্ষণ গল্প করে চলে যায়। আমি না থাকলে কী হয় বলতে পারিনা। জানি না। জানার ইচ্ছাও নেই। বাবুকে নিয়ে রেহানের আগ্রহ চোখে পড়ে শুধু। আমি বলতে পারিনা যে, ব্যাট না এনে কিছু ফল আন। বাবুর ওটাই দরকার। বলতে পারিনা যে, বাবুর শুধু দুটো হাফপ্যান্ট। একটা লাল আরেকটা খয়েরী। খেলনা পিস্তল না এনে আরেকটা প্যান্ট বাবুর জন্য আনতে পার। রেহান এসব খেয়াল করে না। মিলিও কী করে না !!
দুদিন পরে বাবুকে স্কুলে দিব। তখন কী হবে ! এমনিতেই দেরি হয়ে গেছ অনেক। জানি না সামনে কী হবে!
“শোন, কালকে একটা ভাল স্বপ্ন দেখেছি। কালকে দেখি কী আমরা সবাই ঘুরতে যাচ্ছি কোথায় যেন।”, কথা শেষ না হতেই মিলি উঠে চলে গেল। আমার কথা শোনা ছাড়াও ওর কাজ আছে। হাজার অনটনের মাঝেও সে কখনও অভিযোগ দেয় না। কোন অভাবের কথা বলে না। বলে না যে এটা নেই, ওটা নেই। আসলে ও এখন কোন কথাই বলে না আমার সাথে।
সম্পাদক সাহেবের কথা মত লিখতে পারিনা। ইদানীং সংসার যেন চলছে না। ভদ্রভাবে বেঁচে থাকার টাকাটাতেও টান পড়েছে। ধার নেয়ার আর লোক খুঁজে পাই না। তাও মাঝে মাঝে মিষ্টি আসে। মাস শেষে চাল ডালও আসে। আমি বাজার না করলেও আসে। হঠাত কখনও ভাল খাবার এসে পড়ে। মিলি চালিয়ে নিচ্ছে সব। আঠা আঠা প্রেম কাহিনী লিখতে পারছিনা। নয়তলা ফ্লাটের আটতলায় বসে কফি খাওয়া চরিত্রের গল্প লিখতে মন সায় দেয় না। মাথায় আসে না আর এসব। মাঝে মাঝে মনে হয়, মন খুলে সব লিখে দেই। লিখে দেই আমার কথা। গরীব মানুষের রোজকার কথা। আমি ত তাও এখানে থাকি, যারা থাকার মত ফ্ল্যাটটা পায় না তাদের কথা। যাদের বাসায় এরও দুজন মানুষ বাড়তি অথচ আমার মত অনশ্চিত জীবন তাদের কথা। ইচ্ছা করে এসব কথা লিখে দেই।
বস্তিতে যারা থাকে তারা ত রিকশা চালাতে পারে। আমরা যারা, বস্তির মত ফ্ল্যাটে থাকি, আমরা তাও করতে পারি না। ইচ্ছা করে এসব লিখে দেই।
আমার ছেলে বাবু প্রতিদিন বিকেলে নিচে থেকে খেলে আসার পর, খালি বিস্কুটের টিনে হাত বাড়িয়ে দুটো বিস্কুট খোঁজে, প্রতিদিন। পরপর দুটো প্যান্ট পড়ে দিনের পর দিন কাটায় ও। এসব কথা লিখতে পারি না। কারণ, আমি দেখেও দেখি না।
ইচ্ছা করে হাফিজের কথা লিখি। ঐ যে আমার বন্ধু, আমার সাথে স্কুলে পড়ত। কয়েকদিন আগে ওর আথে দেখা। প্রায় ৬ বছর পর। আমি আর সংবাদপত্রের আরেক স্টাফ সফিউর সাহেব ছিলাম। হাফিজ চেনে নি আমাকে। আমিই চিনেছিলাম। ময়লা একটা শার্ট। ভাঙ্গা ফ্রেমের চশমা। ছেড়া স্যান্ডেল পায়ে হাঁটছে।“ কী রে হাফিজ, চিনিস না? আমি শাহেদ।”, হাফিজকে ইতস্তত করতে দেখে বললাম। কিন্তু ও আসলে অন্য কারণে ইতস্তত করছিল। “ শুনেন শাহেদ সাহেব, ৫০০ টা টাকা দেন ত। খুব লাগবে।”, হাফিজ আমার দিকে তাকিয়ে বলল। বুঝলাম, আমাকে হাফিজ চেনে নি। কিন্তু, না চিনেও আমার কাছে টাকা ধার না চেয়েও পারে নি। আমি চুপ করে থাকতেই সফিউর সাহেবের দিকে তাকাল হাফিজ। বলল,“ভাই, আপনি কী কোন সাহায্য করতে পারেন? মাত্র ৫০০ টাকা দিতে পারেন? আমি কালকেই আপনাকে ফেরত দিয়ে আসব।” আমি আর দাঁড়াইনি। সফিউর সাহেবের হাত ধরে টেনে এনেছি।
পাগলের কাণ্ড সম্পাদক সাহেবকে বলেছিলেন সফিউর সাহেব। পত্রিকা অফিসের সবাই হেসেছিল। শুধু আমি সারাটা রাত বাবুকে বুকে জড়িয়ে স্বপ্নের মধ্যেও কেঁদেছিলাম।
যে ঈশ্বর পৃথিবীতে সব মানুষকে খাবার দিতে পারে না, পরকালে সে ঈশ্বর সবার খাবার দেবে আমি বিশ্বাস করি না। আবার, নিজেকেই বুঝাই, ঈশ্বর খাবার ঠিকই দিয়েছেন শাহেদ। সবাইকে দেন নাই। পরকালেও সবাইকে দেবেন না। নিজের কথায় নিজেই দীর্ঘশ্বাস ফেলি। ভালই ত বলেছি। না আছে টাকা, না আছে নেকী। এখানেও ফ্রী খাবার নেই, ওখানেও নেই।
সম্পাদক সাহেবের কথা রাখতে ইদানীং নতুন একটা গল্প শুরু করেছি। আঠা আঠা যৌনতা থাকবে এমন কাহিনী। প্রধান চরিত্রের নাম শিউলী। বাইশ বছর বয়সী। সুন্দরী, শিক্ষিতা, বিবাহিত। সোবহান নামের এক ছেলের সাথে চটুল প্রেম করে। সোবহান মনে করে, শিউলীর স্বামীটা হাবা। বুঝে না কিছু। কিন্তু, শিউলীর স্বামী সবই জানে। জানে শিউলীও। কেউ কিছু বলে না। শিউলীর স্বামী ভাবে, তাও ভাল। তাও ত মাঝে মাঝে কিছু টাকা আসে ঘরে। বাবুর ত এখন কত কিছু দরকার!
কোথায় যেন একটা গান শুনেছিলাম, “শোন ও প্রিয়তমা, বসন্তের দিন শেষ হয়েছে। ভালবাসাবাসি দিয়ে সে দিনকে দূরে রাখা গেল না।”
© আকাশ_পাগলা
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ রাত ১০:২৩