বোশেখ মাসেও নিয়মিত বৃষ্টি হচ্ছে। আমি কলাবাগানের এদিকে এসেছিলাম এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে। বাসায়
ফেরার পথেই ঝুম বৃষ্টি নামলো। বৈশাখী ঝড় নয়, একদম শ্রাবণের ধারা। যদিও বৃষ্টিতে ভিজতে আপত্তি নেই তবুও আশ্রয় ছিল তাই আশ্রয় গ্রহণ করলাম। আমাদের এক পারিবারিক বন্ধুর বাসা এই কলাবাগানেই। তিনি একসময় এক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ছিলেন। উনার বাসায় আমাদের আসা যাওয়া ছিল এবং আছে।
টিং টং, আমি বেল টিপলাম।
দোতলা বাড়িটায় প্রফেসর একাই থাকেন। কাজের লোকেরা দিনের বেলা কাজ করে দিয়ে চলে যায় আর একতালায় একজন দারোয়ান থাকেন।
দারোয়ান আমাকে দেখে কেচিগেট খুলে দিলো।
এই সন্ধ্যাকালীন বৃষ্টিতে গরম পুরি আনা হয়েছে। দারোয়ান প্রকাশ্যে তার ভাগ গলাধঃকরণ করছে আর আমাকে দেখে মুচকি হাসছে। আমি পুরো কাকভেজা হয়েই উপরে উঠে আসলাম।
সন্ধ্যের সময় তিনি পড়াশোনা করেন, কিন্তু বৈশাখে তো আর রুটিন ধরে চলা যায় না। দেখি তিনি বারান্দায় বসে আয়েশ করে চা- পুরি সেবন করছেন।
-"প্রান্ত, এই বৃষ্টিতে কোথা থেকে এলে.."
মনে মনে একটু লজ্জা পেলাম।
-'' যাও, বাথরুমে তোয়ালে রাখা আছে।''
হাত পা কোন রকম মুছে, আমি প্রফেসরের পাশে এসে বসলাম।
তিনি মুচকি হেসে বললেন,''এদিকে হটাৎ কি মনে করে?''
আমি একটু বিব্রতবোধ করলাম। উনি কি কিছু আঁচ করতে পারলেন?
-''না মানে, এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে এসেছিলাম।''
-"হা হা, এত ইতস্তত করার কি আছে? কেমন বন্ধু?"
-"বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী।"
-"ভালো, নাও গরম পুরি খাও।"
আমি পুরি খেতে খেতে বললাম,"আসলে মেয়ে বন্ধু, কিন্তু অন্য কোন সম্পর্ক নেই। ওর বয়ফ্রেন্ডের জন্য শপিং করার জন্য আমায় ডেকেছিলো। "
প্রফেসর একেবারে চুপ মেরে গেলেন। আমিও অস্বস্তি নিয়ে পুরি খেয়ে চললাম।
-"আসলে চরিত্র খুব নাজুক জিনিস।"
আমি প্রফেসরের দিকে চাইলাম।
-"মানুষই নিজেকে নিজে মূল্যহীন করে ফেলে।"
আমি প্রফেসরের দিকে তাকিয়ে বললাম, এ কাজের জন্য আমি তিনশত টাকা পারিশ্রমিক নিয়েছি।
এবার তাঁর মুখে হাসি ফুটলো। -"সাবাস"
-"দুপুরে খাওয়া হয়েছে?"
-"জ্বী, বান্ধবীর টাকায় দুপুরে এক হোটেলে খেয়েছি।"
-"ওয়েটারকে টিপস দিয়েছিলে?"
-"জ্বী"
-"বান্ধবীর গাড়িতে ঘুরলে নাকি?"
-"না, রিকশায়।"
-"রিকশাওয়ালাকে টিপস দিয়েছো?"
আমি খাওয়া বন্ধ করে বললাম,"নাতো"
-"ওয়েটার খাবার সার্ভ করে, এজন্য তাকে বেতন দেওয়া হয়। তারপরও আমরা তাদের টিপস দেই, খুশি করি। অথচ চোখের সামনে
একজন রিকশাওয়ালা কষ্ট করে প্যাডেল চাপেন, তাকে ৫-১০ টাকা বেশি দিতে হলে, আমরা প্রথমে দুটো কথা শোনাই। কখনো ভেবেছো।"
আমি ভাবতে বসলাম।
প্রফেসর সাহেব নিরবতার অবসান ঘটিয়ে বললেন,"আসলে এগুলো হচ্ছে সংস্কৃতির বিষ। ভিনদেশী সংস্কৃতি মানুষের পোশাক রুচি পাল্টায় না, পাল্টায় মানুষের দর্শন।"
দর্শনের সাবেক এই অধ্যাপকের কথা খুব ভালো ভাবে জরিপ করলাম। আসলেই, কালো হওয়া কি দোষের কিছু। কেন সবাই চায়, ইংরেজদের মতো ফর্সা হতে। সব দাঁত সমান না হলে কেন স্কেলিং করতে হবে? আমাদের ভাবনার জায়গাটা আসলে কোথায়? চুল
ছোট রাখলে, তাতে দোষটা কি। দেশও ভালো নেই, মানুষও ভালো নেই। আইন শৃঙ্খলার যা দশা! এসব আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে পুরি আর মুখে রুচলো না।
প্রফেসর সাহেব আরেকটা কথা বললেন," এশিয়ায় আমরা হতে চেয়েছিলাম ইউরোপ, কিন্তু হয়ে যাচ্ছি আফ্রিকা! "
বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। প্রফেসর সাহেব একটা সিগারেট ধরালেন।
-"প্রফেসর একটা ভালো বাংলা বইয়ের নাম বলুন। সাহিত্য মান ভালো হওয়া চাই।"
-"সাহিত্যে আমরা সেন্টিমেন্টাল জাতি। যা পড়ে লোকে কাঁদে, মন খারাপ হয়ে যায়, তাই লোকপ্রিয়। সাহসের কথা আমাদের মাঝে নেই।"
উত্তর পেলাম না, কিন্তু বৃষ্টি থামলে বেরিয়ে এলাম। আরেকদিন আসবো।
©প্রান্ত-২০১৮
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জানুয়ারি, ২০২০ বিকাল ৫:৩২