somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হতভাগা ছেলে (পর্ব-১)

১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ রাত ১২:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমি এক হতভাগা ছেলে। সবাই জানে, আমার ফ্যামিলি আমাকে নিয়ে অনেক গর্ববোধ করে। হ্যাঁ, সেটা সত্যিই করে। ফ্যামিলি বলতে আমার মা, এক ভাই আর এক বোন। আমার বাবা মারা গেছেন দুই বছর হলো। তিনি সরকারী অফিসের সামান্য ক্লার্ক ছিলেন। তার বেতনে আমাদের সংসার ভালোভাবে না চললেও কখনো কোন অশান্তি ছিলো না সেটা নিয়ে। তবু তিনি কীজন্য আত্মহত্যা করলেন, সেটা সবার জন্য একটা রহস্য। শুধু আমিই এর পেছনের কারণটা জানি। সেজন্যই আমি হতভাগা। কারণ, আমি কখনোই কারণটা কাউকে বলতে পারবোনা।
আমার বাবা আমাদের সবাইকে খুব ভালোবাসতেন। বড় ছেলে হওয়ার সুবাদে আদরের ভাগটা আমিই সবচেয়ে বেশী পেয়েছিলাম। আমার এখনো মনে আছে- আমি যখন খুব ছোট ছিলাম, তখন একবার ভয়ংকর বন্যা হলো। আমাদের বাসার চারদিকে অথৈ পানি। তখন সেই পানির মাঝে নিজে ভিজে, আমাকে মাথায় করে প্রতিদিন স্কুলে নিয়ে যেতেন। সেই বন্যার মাঝেও আমার একদিনও স্কুল মিস হয়নি। আমি চোখ বন্ধ করলে এখনো দেখতে পাই, বন্যার পানিতে মাঠ-ঘাট বিলীন হয়ে আছে। তার মাঝে বুক সমান পানিতে ভিজে একজন মধ্যবয়সী মানুষ এগিয়ে চলছে। তার কাঁধে পরম নির্ভরতায় আমি তাকে জড়িয়ে আছি। এই পরম মমতাময় মানুষটির মৃত্যুর জন্য আমি কখনো নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারবোনা। সেজন্যই আমি হতভাগা।
আমার এস.এস.সি. পরীক্ষার সময়ের কথা এখনো মনে পড়ে। পরীক্ষা দিতে ঘড়ি লাগবে। সেটা বাবাকে অনেক আগেই জানিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু দারিদ্র্যসুখে জরজর আমার বাবা একটা ঘড়ি কিনে দেওয়ার মত টাকা জোগাড় করতে পারেননি। আমি ভেবেছিলাম, বাবা হয়তোবা পরীক্ষার আগের দিন আমার হাতে ঘড়ি তুলে দিবেন এবং সে বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ ছিলাম। কিন্তু, পরীক্ষার আগের দিনও যখন ঘড়ি হাতে পেলাম না, তখন ভাবলাম পরের দিন পরীক্ষা দিতে যাওয়ার আগে নিশ্চয়ই পাবো।
পরেরদিন সকালবেলা। পরীক্ষার হলে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। পরীক্ষায় যাওয়ার আগে বাবাকে সালাম করতে গেলাম। এমন সময় তিনি তার হাত থেকে নিজের ঘড়ি হাত থেকে খুলে আমার হাতে তুলে দিলেন। বললেন- “পারলাম না বাবা। আপাতত এটা দিয়ে পরীক্ষা দে, আমি পরে তোকে অনেক দামী একটা ঘড়ি কিনে দেবো।”
আমি মনে মনে একটু আহত হলাম। তারপর করুণ দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকালাম। কিন্তু, তিনি আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলেন না। বুঝতে পারলাম, নতুন ঘড়ি না পেয়ে আমি যতটা কষ্ট পেয়েছি, তার থেকে বেশী কষ্ট পেয়েছেন বেচারা বাবা। আমি অনেক কষ্টে অশ্রু সংবরণ করে বললাম –“এতেই আমার হয়ে যাবে বাবা।”
সেদিন নিশ্চয়ই আমার বাবা মনে মনে বলেছিলেন- “হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছো মহান।”
তারপর বিষণ্ণ বদনে সেই ঢিলেঢালা ঘড়িটাই হাতে নিয়ে পরীক্ষা হলে চলে গেলাম। অবশ্য, ঘড়িটা হাতে গলানোর মতো অবস্থা ছিলো না। কেননা, আমি ছিলাম খুবই হালকা-পাতলা গড়নের। সে দিক থেকে বাবা ছিলেন আমার পুরো বিপরীত। অগত্যা, হাতে না পড়ে পকেটে করে ঘড়ি নিয়ে পরীক্ষা হলে উপস্থিত হলাম।
যথারীতি পরীক্ষা শেষ হল এবং বেশ কৃতিত্বের সাথে উৎরে গেলাম। তারপর চলে গেলাম ফরিদপুর। সেখানে পি. কে. পাবলিক কলেজে ভর্তি হয়ে কলেজের হলে উঠে গেলাম। মা, বাবা, ভাই, বোনকে ছেড়ে একা একা শুরুতে খুবই কষ্ট হতো। তার উপর আবার, মাসের শুরুতে বাবা যা টাকা পাঠাতেন সেটা দিয়ে মাস চলা খুবই দুরূহ হয়ে উঠেছিলো। আমি গণিতে ছিলাম খুবই ভালো এবং আমার গণিত স্যার শ্রদ্ধেয় আশরাফুল আলম ছিলেন আমার প্রতি খুবই সদয়। তিনি আমার পারিবারিক অবস্থা খুব ভালোভাবেই জানতেন এবং সেজন্যই একটা টিউশনির ব্যবস্থা করে দিলেন। তারপর থেকে মুটামুটি ভালোই চলছিলো। টিউশনির টাকা পাওয়ার পর থেকে দেখা গেলো, ভালোভাবে চলাফেরার পরেও মাস শেষে কিছুটা সঞ্চয় করতে পারছি।
প্রথম দিকে কলেজে উঠার পরপর বাবাকে মাঝে মাঝে একটা ঘড়ি কিনে দেওয়ার জন্য তাগাদা দিতাম। টিউশনিটা পাওয়ার পর অবস্থা কিন্তু চেঞ্জ হয়ে গেলো। বুঝতে পারলাম, আমাদের পরিবারের যে অবস্থা তাতে বিলাসসামগ্রী কিনতে হলে নিজের টাকায়ই কিনতে হবে। সুতরাং, বাবাকে তাগাদা দেওয়া বন্ধ করে দিলাম। নিজেই টাকা জমানো শুরু করলাম। অবশ্য প্রথম দুই মাসের টাকা জমিয়েই আমি অনেক সুন্দর এবং দামী ঘড়ি কিনে ফেলতে পারতাম। কিন্তু, কার্যত তা হলো না। কেননা, নতুন নতুন টাকা হাতে পাওয়ার পরই আমার খরচাও বেড়ে গেলো। মাঝে মাঝেই বন্ধুদের সাথে খেতে বের হওয়া, অথবা মনোয়ারা সিনেমা হলে সিনেমা দেখতে যাওয়া এসব ঘটতে থাকলো প্রতিনিয়তই। সুতরাং, আশানুরূপ টাকা জমাতে পারলাম না। তাই, একটা সুন্দর দামী ঘড়ি কিনতে আমাকে ৫ মাস অপেক্ষা করতে হলো। অবশেষে যখন ফরিদপুর সুপার মার্কেট থেকে ঘড়ি কিনে হলে ফিরলাম, আমার খুশি আর দেখে কে?
এর কয়েকদিন পরই সামার ভ্যাকেশনের বন্ধে বাড়িতে চলে এলাম এক সপ্তাহের জন্য। বাড়িতে এসে দেখলাম করুণ অবস্থা। বাসায় সবার খাওয়া দাওয়া বন্ধ হবার শামিল। বড় ভাইয়াকে ভার্সিটিতে ভর্তি করানোর সময় আব্বুকে তার এক বন্ধুর কাছ থেকে মোটা পরিমাণ টাকা ঋণ করতে হয়েছিলো। সেই টাকা আব্বু এখনো শোধ করতে পারেন নি। সেজন্য সেই লোক প্রতিদিন তাগাদা দিয়ে যায়। হুমকি ধামকিও নাকি দিচ্ছে মাঝে মধ্যে। টাকা তাড়াতাড়ি দিতে না পারলে পুলিশের ভয়ও দেখাচ্ছে। আমার অসহায় বাবা এসব সহ্য করা ছাড়া কিই বা করতে পারেন?
সারারাত জার্নি করে সকালবেলা বাড়ি এসে পৌছুলাম। সারাদিন কেটে গেলো। বাবা বাসায় এলেন রাত ৯ টার দিকে। যদিচ তিনি অনেক টায়ার্ড(এবং মনের অবস্থা খুবই শোচনীয়) ছিলেন, তার অবস্থা দেখে তা বোঝার উপায় ছিলো না। আসলে, আমার বাবা বস্তুটাই ছিলেন সেরকম। তিনি তার সুখগুলো আমাদের সবার সাথে শেয়ার করলেও দুঃখগুলো ছিলো নিতান্তই তার নিজের। দুঃখের কথাগুলো কখনোই তিনি আমাদের সাথে শেয়ার করতেন না। সেজন্য, তার কথাবার্তায় আমি ধান্দায় পড়ে গেলাম। দেখলে কে বলবে যে এই মানুষটির কোন দুঃখ থাকতে পারে!
বাবা আমার সকল খবরাখবর নিলেন। কিছুক্ষণ খোশগল্প করে বললেন, “তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।”
“কি সারপ্রাইজ বাবা?” আমি উৎসাহভরে বললাম।
“উহু, এখন না। খাওয়াদাওয়া শেষ করো। তারপর।”
আমার বাবাকে আমার চেয়ে বেশী কেউ জানেনা। সুতরাং, স্পষ্টই বুঝতে পারলাম খাওয়াদাওয়া শেষ করার আগে বাবার মুখ থেকে কোন কথা বের হবেনা। অগত্যা, হাতমুখ ধুয়ে খাবার টেবিলে বসে গেলাম। অনেকদিন পর ফ্যামিলির সাথে ডিনার করলাম। সবাই মনমরা। কারো মুখে কোন কথা নেই। শুধু বাবা কিছুক্ষণ পরপর একটা না একটা বিষয় নিয়ে কথা বলে গেলেন। এটা যে পরিস্থিতি হালকা করার জন্য তার একটা প্রয়াস, এটা আমরা সবাই বুঝতে পারলাম। মনে মনে ভাবছিলাম, “এই মানুষটাকে কি কোন দুঃখ-কষ্টই স্পর্শ করতে পারে না?” এখন বুঝতে পারি, এই মানুষটাই সকল দুঃখ-কষ্ট মেনে নিয়ে আমাদেরকে আগলে রাখতেন।

পরবর্তী পর্ব এখানেঃ Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ রাত ৮:২৮
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামাত কি দেশটাকে আবার পূর্ব পাকিস্তান বানাতে চায়? পারবে?

লিখেছেন ঋণাত্মক শূণ্য, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৭:২৮

অন্য যে কোন সময়ে জামাতকে নিয়ে মানুষ যতটা চিন্তিত ছিলো, বর্তমানে তার থেকে অনেক বেশী চিন্তিত বলেই মনে করি।



১৯৭১ এ জামাতের যে অবস্থান, তা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে... ...বাকিটুকু পড়ুন

১৯৭১ সালে পাক ভারত যুদ্ধে ভারত বিজয়ী!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯


দীর্ঘ ২৫ বছরের নানা লাঞ্ছনা গঞ্জনা বঞ্চনা সহ্য করে যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বীর বাঙালী অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে দেশ প্রায় স্বাধীন করে ফেলবে এমন সময় বাংলাদেশী ভারতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা গান্ধীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক: ওরিয়ানা ফলাচির সাক্ষাৎকার

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৫


১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইতালীয় সাংবাদিক ওরিয়ানা ফলাচি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার নেন। এই সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধ, শরনার্থী সমস্যা, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক, আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্ট্রনীতি এবং পাকিস্তানে তাদের সামরিক... ...বাকিটুকু পড়ুন

=যাচ্ছি হেঁটে, সঙ্গে যাবি?=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:০৬


যাচ্ছি হেঁটে দূরের বনে
তুই কি আমার সঙ্গি হবি?
পাশাপাশি হেঁটে কি তুই
দুঃখ সুখের কথা ক'বি?

যাচ্ছি একা অন্য কোথাও,
যেখানটাতে সবুজ আলো
এই শহরে পেরেশানি
আর লাগে না আমার ভালো!

যাবি কি তুই সঙ্গে আমার
যেথায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

আগামী নির্বাচন কি জাতিকে সাহায্য করবে, নাকি আরো বিপদের দিকে ঠেলে দিবে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:১২



আগামী নির্বচন জাতিকে আরো কমপ্লেক্স সমস্যার মাঝে ঠেলে দিবে; জাতির সমস্যাগুলো কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। এই নির্বাচনটা মুলত করা হচ্ছে আমেরিকান দুতাবাসের প্রয়োজনে, আমাদের দেশের কি হবে, সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×