পর্ব-১ এখানেঃ Click This Link
বাবাকে আমার নতুন ঘড়িটা দেখানোর জন্য আর তর সইছিলো না। তাই খাবার শেষ করেই বাবাকে দেখালাম। বাবা শুধু আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন, তারপর মৃদু হেসে বললেন “সুন্দর হয়েছে।” তার হাসিটাতে কি যেনো একটা কিছু ছিলো। কেমন যেনো মেকি মেকি লাগলো। আমি বলতে পারবো না কেনো আমার এমনটা মনে হয়েছিলো, তবু মনে হয়েছিলো।
সেদিন এমন একটা কান্ড ঘটলো, যেটাতে আমি অনেক অবাক হয়ে গেলাম। বাবার আমাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার কথা থাকলেও তাকে দেখলাম মশারি টাঙ্গিয়ে ঘুমানোর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। যারা আমার বাবাকে চেনেন না তারা হয়তোবা ভাবতে পারেন, এটা আর এমন কি জিনিস? একজন মানুষ তো একটা কিছু ভুলে যেতেই পারেন। তাদের জন্য ছোট্ট একটা তথ্য দিয়ে রাখি- আমি আমার জীবনে আমার বাবাকে কোনকিছু ভুলে যেতে দেখিনি। বিশেষ করে এসব বিষয়ে তিনি খুবই সচেতন। আমাদের ভাইবোনের কোনদিন কার বার্থডে, এসব তার নখদর্পণে ছিলো এবং পুরো বাড়িতে একমাত্র তিনিই সবসময়ই মনে রাখতেন। একবার তো বড় ভাইয়ার বার্থডের কথা আমরা সবাই ভুলে গিয়েছিলাম। এমনকি বড় ভাইয়া নিজেও ভুলে গিয়েছিলো। সেইদিন বাবা যা সারপ্রাইজটা দিলেন, তা আর বলার মতো না।
এমনকি বাবা-মার ম্যারিজ ডের কথা মা ভুলে গেলেও বাবা কখনোই ভুলতেন না। মার জন্য প্রতিবারই একটা একটা সারপ্রাইজ পার্টি এরেঞ্জ করতেন।
আমাদের এত দারিদ্রতার মাঝেও বাবা এসব বিষয়ে ছিলেন খুবই সচেতন। এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারলেন, আমার অবাক হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে বৈকি। আমি বাবার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “বাবা! তুমি না বললে আমার জন্য সারপ্রাইজ আছে?”
বাবা বিষণ্ণ মুখে বললেন “শরীরটা অনেক খারাপ লাগছে বাবা। তুমি ঘুমিয়ে পড়ো। কালকে কথা হবে।”
হঠাৎ কি কারণে আমার বাবা এরকম মনমরা হয়ে গেলেন, আমি বুঝতে পারলাম না। কিছুক্ষণ আগেও তো কেমন হাশিখুশি ছিলেন। কিছুক্ষণ চেষ্টা করেও কারণটা বের করতে পারলাম না। অগত্যা, মনের মাঝে একটা খচখচানি নিয়ে ঘুমাতে গেলাম। এসব কিছু চিন্তা করতে করতেই কখন ঘুমিয়ে গিয়েছি, বলতেই পারিনা।
সকালবেলা যখন ঘুম ভাঙলো, শুনতে পেলাম- মা বিলাপের সুরে কাঁদছেন। আমি ধরমর করে উঠে বসলাম। বাড়ির পরিবেশ থমথমে। কেউ কোন কথা বলছে না। রুম থেকে বের হয়ে দেখতে পেলাম, ড্রয়িং রুমে অনেক মানুষের ভীড়। যখন কিছুই বুঝতে পারছিলাম না, কাকে জিজ্ঞেস করবো সেটাও বুঝতে পারছিলাম না, ঠিক সেই সময়ে আমি দেখতে পেলাম। দেখতে পেলাম, আমার বাবাকে একটা চাটাইয়ের উপর শুইয়ে রাখা হয়েছে। তার মাথাটা থ্যাতলানো, রক্তে লাল। বাবার নিথর দেহটাকে ঘিরে সবাই কান্নাকাটি করছে। আমার যে কি কষ্টটা টা লাগছিলো, সেটা আর বলার মতো না। মুহূর্তের মাঝে নিজেকে কেমন যেনো ভাবাবেগশূন্য বলে মনে হলো।
পরে জানতে পারলাম, বাবা একদম ভোরে উঠে ছাদে গিয়েছিলেন। তারপর কোনভাবে ছাদ থেকে নিচে পড়ে যান। ৫ তলা থেকে নিচের পিচঢালা রাস্তায় পড়ে তার মাথাটা ভীষণভাবে থেতলে যায়। কিন্তু, এতো ভোরবেলায় বাবার ছাদে যাওয়ার কারণটা কি হতে পারে? বাবার কখনোই মর্নিং ওয়াক করার অভ্যাস ছিলো না। এবং এই সময়ে তিনি কখনোই ছাদে যেতেন না। তার মানে কি এটা একটা আত্মহত্যা ছিলো? হ্যাঁ, সবাই তাই ধরে নিয়েছে। ঋণের দায়ে জর্জরিত হয়ে আমার বাবা আত্মহত্যা করেন।
বাবাকে সমাধিস্থ করার পর সেদিন রাত্রে হঠাৎ করেই আমার মনে হলো, বাবা আমার জন্য কি সারপ্রাইজ রেখেছিলেন? সেটা জানার জন্য তার ড্রয়ার ঘাঁটাঘাঁটি করতে শুরু করলাম। ভাবতেও অবাক লাগলো, বাবা জীবিতদশায় এই ড্রয়ারে হাত দেওয়ার কথা আমরা ভাবতেও পারতাম না। আর এখন! আমার কেমন একটা কান্না কান্না ভাব চলে এলো। অনেক কষ্টে নিজেকে সংবরণ করলাম।
অনেক খোজাখুঁজির পর একটা প্যাকেটিং করা ছোট বাক্স পেলাম। তার উপরে লেবেলিং করা- “আব্দুল্লাহকে বাবা।” বুঝতে আর বাকি রইলো না, এটাই বাবা আমাকে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু, কি থাকতে পারে ভেতরে?
প্যাকেটটা আমার ঘরে নিয়ে এসে খুলে দেখলাম। খুব যত্নের সাথে প্যাকিং করে যে জিনিসটা রাখা হয়েছে, সেটা একটা ঘড়ি। আমার কেনা ঘড়িটার মতো অতো দামী না হলেও বেশ সুন্দর একটা ঘড়ি। যে ঘড়িতে আমার মমতাময় বাবার পছন্দ মিশে আছে, সেটা কি সুন্দর না হয়ে পারে?
আমি তখনো বুঝতে পারিনি আমার জন্য কি চমক অপেক্ষা করছে। প্যাকেটের কোণায় একটা চিরকুট দেখতে পেলাম। দুইবার ভাঁজ করা কগজটা মেলে ধরে যা দেখতে পেলাম, সেটা এই- “বাবা আব্দুল্লাহ,
তুমি আমার কাছে সুন্দর একটা ঘড়ি চেয়েছিলে। যদিও ইদানিং আর ঘড়ির কথা তেমনভাবে বলোনি। হয়তোবা ভুলেই গিয়েছো। অথবা মেনেই নিয়েছো যে তোমার এই অধম পিতার সেই সামর্থ্য নেই যে তোমার সাধ-আহ্লাদ পূরণ করে। যাই হোক। আমি কিন্তু ভুলিনি এবং আমি বেঁচে থাকতে আমার সন্তানেরা কিছু নিয়ে কষ্ট পাবে, সেটা আমি হতে দিতে পারিনা। তাই, এই সামান্য ঘড়িটা দেওয়ার জন্য আজকের থেকে ভালো আর কোন দিন হতে পারে না।
শুভ জন্মদিন আব্দুল্লাহ।
তোমার পিতা।”
নিজের অজান্তে আমি লক্ষ্য করলাম যে আমার চোখ থেকে অশ্রু ঝড়ে পড়ছে। এখন বুঝতে পারছি, আমি ঘড়ি কিনেছি এটা জানার পর বাবা কেনো অমন ছিটিয়ে গিয়েছিলেন। সেদিন যে আমার জন্মদিন, সেটা আমার মনেই ছিলো না। কিন্তু বাবা মনে রেখেছিলেন। অথচ আমাকে উইশ না করে, আমাকে গিফট না দিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। এর শুধুমাত্র একটাই কারণ হতে পারে। আর সেটা হচ্ছে, আমার ওরকম দামী ঘড়ি দেখে আমার বাবা হীনমন্যতায় ভুগেছিলেন। এটা কে তার নিজের ব্যর্থতা হিসেবে নিয়েছিলেন এবং এটাই তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিলো।
আচ্ছা, ব্যাপারটা এমন নয়তো যে, এই ব্যাপারটাই বাবাকে আত্মহত্যা করতে প্ররোচনা প্রদান করেছে? হয়তোবা, ঋণের বোঝা একটা কারণ, কিন্তু আমার বাবা যে আবেগপ্রবণ তাতে এই ব্যাপারটা যে একটা প্রচ্ছন্ন কারণ হিসেবে কাজ করেছে, সেটা নিয়ে আমার আর সন্দেহ থাকে না।
আমার ভেতরটা ভরে গেলো নিজের উপরই তীব্র বিতৃষ্ণায়। হাতে তখনো আমার কেনা ঘড়িটা পড়া ছিলো। কেনো যেনো খুব রাগ হলো। ঘড়িটা ছুঁড়ে ফেলে দিলাম জানালা দিয়ে। কোথেকে এক টুকাই এসে ঘড়িটা তুলে নিলো। তারপর আমার দিকে একবার তাকিয়েই ভোঁ দৌড় দিলো। এতো সুন্দর একটা ঘড়ি পেয়ে তার আজকের দিনটা যে খুব ভালো যাবে, সেটা বলাই বাহুল্য। আমার দিনটা কিন্তু ভালো গেলো না। বাবার দেওয়া ঘড়িটা হাতে পড়লাম। বুক ফেটে কান্না বের হয়ে আসতে চাইলো। কিন্তু, কি আশ্চর্য! আমি কাঁদতে পারলাম না! সম্ভবত সেদিনই আমার কাঁদার ক্ষমতা হারিয়ে গেছে।
অনেকদিন পার হয়ে গেছে। এখনো আমি একটা দিনের জন্যও বাবার কথা ভুলতে পারিনি। একসময় কতো ঘটা করে জন্মদিন পালন করতাম। জন্মদিনে গিফট পেতে অনেক ভালো লাগতো। আর এখন! আমার জন্য বছরের সবচেয়ে খারাপ দিনটা হলো আমার জন্মদিন। সেদিন যে আমার স্নেহময় পিতার মৃত্যুবার্ষিকী!
বন্ধুরা অনেকেই বলে, এটা একটা কাকতালীয় ঘটনা। কিন্তু, আমি তো জানি আমার পিতার মৃত্যুর জন্য একটু হলেও আমি দায়ী। আর এই কথাটা আমি এক সেকেন্ডের জন্যও ভুলতে পারিনা। কখনো ভুলতেও পারবো না। তাই তো এখনোও জন্মদিন আসলেই আমি অজানার উদ্দেশ্যে চলে যাই। সবার থেকে দূরে থাকার আর কোন ভালো উপায় আমার জানা নেই।
এখনো যখন কোন বাবাকে যদি দেখি তার সন্তানকে আদর-স্নেহ করতে, আমি কেন যেনো সহ্য করতে পারিনা। কারণ, তখন নিজেকে খুব একা লাগে আর বুকের ভেতরটায় কেমন যেন একটা অপরাধবোধ মাথা চারা দিয়ে উঠে। কেবলি মনে হয়- “আমি সত্যিই হতভাগা। ভাগ্যবঞ্চিত একজন পিতার এক হতভাগা ছেলে!”
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ রাত ৮:৩৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




