somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ: আলোচিত ও অনালোচিত কারণসমূহ পর্ব -১৩

০৫ ই ডিসেম্বর, ২০১১ রাত ১:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ: আলোচিত ও অনালোচিত কারণসমূহ পর্ব -১৩



ঙ. ইসলামের ইতিহাসে জিহাদ ও সন্ত্রাস
ইসলামের ইতিহাসে জিহাদের নামে সন্ত্রাসের প্রথম উদ্ভাবনা করেন খারিজী সম্প্রদায়। তাদের বিষয়ে আগেই উল্লেখ করেছি যে, তারা ‘আল্লাহ ছাড়া কারো হুকুম চলবে না’ এই দাবিতে আলীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন এবং ইসলামী আইন বা আল্লাহর হুকুম প্রতিষ্ঠার জন্য সমগ্র মুসলিম জাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকেন। এদের মূল বিভ্রান্তিই ছিল ‘জিহাদ’ বা কিতালকে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার বাইরে ‘গোষ্ঠি’ বা গ্র“পের হাতে নিয়ে যাওয়া। তাদের ‘ভার্সন’ অনুসারে যাদেরকে তারা ইসলামের বিরুদ্ধে বলে মনে করত তাদের তাদের সাথে তারা যুদ্ধ করত। এখানে লক্ষণীয় যে, এই বিভ্রান্ত ‘খারিজী’ সম্প্রদায় ‘যুদ্ধ’ করেছে। কিন্তু তারা ‘গুপ্ত হত্যা’ করেনি। পক্ষান্তরে আরেকটি বিভ্রান্ত সম্প্রদায় ‘গুপ্তহত্যা’ করত। এরা ছিল বাতিনী শিয়া সম্প্রদায়। এরা নিজেদের ভার্সন অনুসারে ‘ইসলাম’ প্রতিষ্ঠার জন্য গুপ্ত হত্যা করত।
এই দুই বিভ্রান্ত সম্প্রদায় তাদের এই ‘জিহাদ’ মূলত কাফিরদের বিরুদ্ধে পরিচালিত করত না। বরং মুসলমানদের বিরুদ্ধেই পরিচালিত করত। তাদের বিভ্রান্তি চালু করার জন্য তারা তাদের মতের বাইরে সকল মুসলিমকে কাফির বলে ফতওয়া জারি করত। এরপর তাদের বিরুদ্ধে ঢালাও জিহাদের ফাতওয়া দিত। এরপর জিহাদের নামে ঢালাও নরহত্যা বা গুপ্ত হত্যা চালাত।
ইসলামের ইতিহাসে আমরা অনেক যুদ্ধ-বিগ্রহ, বিদ্রোহ ইত্যাদি দেখতে পাই, যেগুলি যুদ্ধের ক্ষেত্রে কুরআন ও হাদীসে উল্লিখিত শর্তগুলি পুরোপুরি পূরণ করে না। এগুলি মানবীয় দুর্বলতার ফল। ইসলামের দৃষ্টিতে মূলত এগুলি অবৈধ। তবে কোনো ক্ষেত্রেই যুদ্ধের ময়দানের বাইরে গুপ্ত হত্যা, নির্বিচার হত্যা ইত্যাদিতে এই দুই বিভ্রান্ত গোষ্ঠি ছাড়া কেউ জড়িত হন নি।
পরবর্তীকালের দুইটি ‘জিহাদের’ বিষয় আমাদের আগ্রহ সৃষ্টি করে: সাইয়েদ আহমদ ব্রেলবীর জিহাদ ও আফগান জিহাদ। প্রথম জিহাদে সাইয়েদ আহমদ ব্রেলবী জিহাদের শর্তগুলি পূরণ করেছিলেন। তিনি বৃটিশ সাম্রাজ্যের সীমানা পরিত্যাগ করে ভারতের ইসলামী রাষ্ট্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার ঘোষণার মাধ্যমে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রপ্রধানের শর্ত পূরণ করেছিলেন। তিনি বৃটিশদেরকে আক্রমণকারী ও দখলদার বাহিনী হিসেবে গণ্য করে জিহাদের বৈধতার দাবি করেন।
আফগান জিহাদও শুরু হয়েছিল প্রায় একইভাবে সোভিয়েট বাহিনীর আক্রমণ ও জবরদখলের মুখে আফগান জনগণ আলিমদের নেতৃত্বে জিহাদ শুরু করেছিলেন। সাধারণভাবে মুসলিম বিশ্বে এই জিহাদ বৈধ জিহাদ বলেই মনে করা হয়। ফলে বিভিন্ন দেশের অনেক মুসলিম যুবক এই জিহাদে অংশ গ্রহণ করে। সোভিয়েট বাহিনীর পরাজয়ের পরে এই জিহাদ আন্তঃদলীয় ও আন্তঃগোত্রীয় রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধে পরিণত হয়। দীর্ঘদিন যুদ্ধে অভ্যস্ত আফগান জনগণ অস্ত্রের ভাষাতেই কথা বললেন স্বদেশীয় ও স্বধর্মীয় বিরোধীদের সাথে। প্রত্যেকেই নিজের কাজকে জিহাদ এবং প্রতিপক্ষকে ইসলামের শত্র“ বলে দাবি করলেন। বাইরে থেকে আফগান যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুজাহিদগণ স্বভাবতই কোনো না কোনো আফগান পক্ষে থেকে একই কর্মে লিপ্ত হয়ে পড়েন। অনেকে আফগান ত্যাগ করে নিজ নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। এসব যুদ্ধ ফেরত সৈনিকদের অনেকের জন্য ‘অস্ত্রের ভাষা’ পরিত্যাগ করা কষ্টকর হয়ে যায়। এদের অধিকাংশই জিহাদের শর্তের চেয়ে জিহাদের ফযীলতের বিষয়েই বেশি জানতেন ও ভাবতেন। তারা নিজ দেশেও ‘জিহাদী’ পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা করেন।
(৫) জিহাদ পরিভাষার অতিব্যবহার
জঙ্গি তৎপরতায় লিপ্ত মানুষদের কথাবার্তা থেকে একথা প্রমাণিত হয় যে, গত অর্ধ শতাব্দী ধরে জিহাদ শব্দের অতিব্যবহার তাদের বিভ্রান্তির পক্ষে পরিবেশ তৈরি করেছে। ইসলামে বিভিন্ন পরিভাষার পারিভাষিক ব্যবহার ছাড়াও অনেক সময় আভিধানিক অর্থেও ব্যবহার করা হয়। কিন্তু আভিধানিক অর্থের অতিব্যবহার অনেক সময় পারিভাষিক অর্থের বিকৃতি সহজ করে। যেমন ‘সালাত’-এর আভিধানিক ‘অর্থ’ প্রার্থনা। যে কোনো প্রার্থনাকেই সালাত বলা যায় এবং কুরাআন-হাদীসে কখনো কখনো তা বলা হয়েছে। কিন্তু ইসলামের পরিভাষায় ‘সালাত’ একটি নির্দিষ্ট ইবাদাতের নাম। সকল প্রার্থনাকেই সালাত বলে নামকরণ করলে তা বিভ্রান্তির জন্ম দিতে পারে। মাঝে মাঝে প্রার্থনা করেই ‘সালাত’ কায়েম হয়ে গিয়েছে বলে হয়ত কেউ দাবি করবেন, অথবা অন্য কেউ যে কোনো প্রকারের প্রার্থনাকেই ফরয বলে দাবি করবেন, অথবা কেউ সালাতের ফযীলত বা আহকামের আয়াত ও হাদীসগুলি সকল প্রার্থনার ক্ষেত্রেই প্রয়োগ করবেন।
জিহাদ, ইমাম, বাইয়াত, জামা‘আত ইত্যাদি সবই ইসলামের ‘রাষ্ট্রীয়’ বা ‘রাজনৈতিক’ পরিভাষা। জিহাদ রাষ্ট্রীয় যুদ্ধের নাম। ইমাম রাষ্ট্র প্রধানের নাম। বাইয়াত রাষ্ট্রপ্রধানের প্রতি আনুগত্যের প্রতীক শপথের নাম। জামা‘আত মুসলিম রাষ্ট্রের ঐক্যবদ্ধ জনগণ ও জনমতের নাম। এই পারিভাষিক অর্থের বাইরে আভিধানিক অর্থে এগুলির ব্যবহার অবৈধ নয়। তবে তা অনেক সময় কঠিন বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে।
বর্তমান যুগে ‘জিহাদ’ শব্দটির ব্যাপক ব্যবহার লক্ষণীয়। আমরা দেখেছি যে, জিহাদ অর্থ ‘প্রচেষ্টা’ বা ‘সর্বাত্মক চেষ্টা’। এই অর্থে ইসলাম পালনের কোনো কোনো কষ্টকর প্রচেষ্টাকে কুরআন-হাদীসে ‘জিহাদ’ বলা হয়েছে। যেমন ‘আত্মশুদ্ধি’-কে জিহাদ বলা হয়েছে; শীতের মধ্যে নিয়মিত ওযু করা ও মসজিদে গমন করাকে ‘জিহাদ’ বলা হয়েছে; ‘হজ্জ’ পালনকে জিহাদ বলা হয়েছে বা জালিম শাসকের সামনে সত্য ও ন্যায়ের কথা বলাকে জিহাদ বলা হয়েছে। কিন্তু এ সকল আভিধানিক ব্যবহারের বাইরে ইসলামী শরীয়তে জিহাদের একটি পারিভাষিক অর্থ আছে, তা হলো ইসলামী রাষ্ট্রের সশস্ত্র যুদ্ধ। জিহাদের ফযীলত, জিহাদের বিধান, জিহাদের শর্ত ইত্যাদি যা কিছু কুরআন, হাদীস ও ইসলামী ফিক্হ-এ বলা হয়েছে সবই এই ‘পারিভাষিক জিহাদের’ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য

মুলঃ ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর
পি-এইচ. ডি. (রিয়াদ), এম. এ. (রিয়াদ), এম.এম. (ঢাকা)
অধ্যাপক, আল-হাদীস বিভাগ,
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×