somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ওকুরিবিটো’: লোকাচার ও সম্পর্কের ভাগাভাগি

২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১০ রাত ১০:৪০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ওকুরিবিটো’ জাপানী শব্দ। ইংরেজী থেকে বাংলা অর্থ দাড়ায়, যে মৃত ব্যক্তির আত্নাকে স্বর্গ যাত্রায় পাঠায়। ‘ওকুরিবিটো’ মুভিটি ইংরেজী টাইটেল ‘ডিপারচারস’।

‘ডিপারচারস’ মুভিটি ডিয়াগো কোবেইসী নামক এক তরুণ সেলোবাদককে কেন্দ্র করে। সে টোকিওতে একটা অকোস্ট্যায় সেলো বাজাত। হঠাৎ করে চাকুরীচ্যুত হলে স্ত্রী মিকাকে সাথে নিয়ে নিজ শহরে ফিরে আসে। ট্রাভেল এজেন্সীর কাজের বিজ্ঞাপন দেখে যোগাযোগ করলে জানতে পারে বিজ্ঞাপনটি ভুলভাবে ছাপানো হয়ে ছিলো। এটা আসলে মৃতদেহ সাজিয়ে দেখার প্রতিষ্টান। ডিয়াগো অনিচ্ছা সত্ত্বেও কাজটিতে যোগদান করে। প্রথমে পর্যায়ে এই কাজটিকে বৈরী মনে করলেও- কিন্তু ভালো বেতন সুবিধা এবং অন্য কোনো কাজ না পাওয়ায় সে এই কাজটি বেছে নেয়। পরবর্তীতে সে এটাকে অন্যভাবে মূল্যায়ন করে। তার বস একজন অনুভূতিপ্রবণ কোমল হৃদয়ের মানুষ। যখন পরিচিতজনদের কেউ কেউ তার পেশার বিষয়টি জেনে যায়- কোবেইসী নানাভাবে অপদস্থ হয়। তার স্ত্রীর মধ্যেও একই ধরনের ট্যাবু কাজ করে। সে ডিয়াগোকে ছেড়ে চলে যায়। ডিয়াগো তার কাজ চালিয়ে যেতে থাকে। সেই ভয়ংকর নিসঙ্গ সময়ে ডিয়াগো এই কাজের ভেতর কিছু একটা খুঁজে পায়।

কয়েক সপ্তাহ পর মিকা ফিরে আসে। মিকা জানায় সে গর্ভবতী। সে সময় একটা ফোন আসে, ডিয়াগোর এক পারিবারিক বন্ধু মারা গেছেন। তার শেষকৃত্যের কাজ করতে হয় ডিয়াগোকে। তখন মিকা তার সাথে যায় এবং সে তার ভুল বুঝতে পারে।

এরপর ঘটনা মোড় নেয় অন্যদিকে। ডিয়াগোর ভেতরকার যে বিষস্নতা সবসময় মূর্ত তার পেছনে কাজ করে বাবার প্রতি রাগ। ডিয়াগোর মনে পিতার দুটো স্মৃতি। সে তার বাবার সামনে বসে সেলো বাজাচ্ছে এবং পিতার সাথে পাথরের চিঠি বিনিময় করছে। এই পাথর চিঠি প্রাচীন জাপানের লোকাচার। যেখানে একে অপরের প্রতি মনের ভাব জানাতে পরস্পরকে পছন্দসই পাথর উপহার দেয়। ডিয়াগোর স্মৃতিতে তার বাবার ছবি অস্পষ্ট। ডিয়াগোর বাবা ছয় বছর বয়সে অন্য নারীতে আসক্ত হয়ে তাদের ছেড়ে চলে যায়। ডিয়াগো বাবাকে একই সাথে ভালোবাসে আবার ঘৃণা করে। মুভির শেষ দিকে দেখা যায়, ডিয়াগোর বাবা মারা গেছে এমন খবর আসে। ডিয়াগো তার লাশ গ্রহণ করতে যেতে অস্বৃকীতি জানায়। মিকা তাকে সেখানে যেতে বাধ্য করে। একপর্যায়ে, ডিয়াগো বাবার মৃতদেহ সাজাতে থাকে, দেখে বাবার হাতে সেই ছোট্টবেলায় ডিয়াগোর দেয়া পাথর চিঠি। ডিয়াগো সেই পাথর চিঠি তার অনাগত সন্তানকে দেয়।
‘ডিপারচারস’ সম্পর্কে এককথায় বলা যায়, একগেয়েমীহীন অসাধারণ মুভি। জাপানী জীবনে যে হাল হকিকত, তাতে মনে হয় পুঁজিবাদের উৎকর্ষিত যান্ত্রিক জীবনে সে সীমাবদ্ধ। সেই জানা হাল হকিকতের বাইরে জাপানী জীবনের গভীরতায় ডুব দেবার ভালো সুযোগ করে দিয়েছে মুভিটি। বোধহয় এই পূর্ব ধারণায় কিছু ভুল ছিলো।

এই মুভিটিতে প্রায় নাটকীয়তা বিহীন সাধারণভাবে একটা গল্প বলেছে- যার উপরিকাঠামো এই সময়ে অথচ যার শিকড় রয়েছে জাপানী ঐতিহ্যিক জীবনবোধ ও লোকাচারে।

ডিপারচারস’ সম্পর্কে বলতে গেলে, যে বিষয়টি সব' চে’ সামনে আসে তাহলো, মৃতদেহের সৎকার প্রণালী। হিন্দু ও বৌদ্ধ মতে, আত্না বারবার ফিরে আসে। মৃতদেহ পড়ে থাকে জীর্ণ বস্ত্রের মতো। এই অপ্রয়োজনীয় অংশটি অপর জম্মে কোনো কাজে আসে না। তাই তারা মৃতদেহকে পুড়িয়ে ফেলে। পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্মে নিশ্চয় এই বিষয়টি নানাভাবে উদযাপন করা হয়। কিন্তু জাপানী ধারণার পিছনে কি দর্শন কাজ করে তা বলা কঠিন হলেও, তা কিন্তু এই জাগতিক জীবন ও তার সৌন্দর্য সম্পর্কে তাৎপর্যপূর্ণ অনুভূতি দান করে। জন্ম এবং পুর্নজন্মের যে ধারণা তার ভেতর যে যোগসুত্র তা অন্যকিছুর সাথে সাথে নন্দনের ভেতর দিয়েও গোচরীভূত হয়। অর্থ্যাৎ এই জীবন সম্পর্কে আলাদা মূলায়ন হাজির করে। এই কাজটি ডিয়াগো পেশা হিসেবে বেছে নেয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ডিয়াগোর অনুভূতির রূপান্তর ঘটে। সে হয়ে উঠে অনন্তযাত্রা পথে শেষ নন্দন কারিগর। সে হয়ে উঠে জন্ম এবং পুর্নজন্মের দ্বার রক্ষক। সে ইহলোক আর পরলোকের মাঝামাঝি বাস করে। ডিয়াগোর বস যখন বলে তাদের কাছে হিন্দু বৌদ্ধ মুসলমান খৃস্টান কেউ তাজ্য নয়, এতে মানুষ সম্পর্কে একটা মিশ্র ধারণা তৈরি হয়।
ডিয়াগো মৃত্যুর কাছাকাছি থেকে জীবনকে অনুধাবন করে। যা মহৎ কোনো সংগীতের মতো। সে যখন সেলো বাজায়, তাতে অপার্থিব সুর বেজে উঠে, সেখানে ভ্রম হয়- এই সংগীত কোথাকার? জীবন এবং মৃত্যুকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে দেয়।

দুনিয়াবী এই কাল আধুনিক, উত্তরাধুনিক নানা নামে চিহ্নিত হয়েছে। আমরা প্রায়শ বলি, যুগের পরিবর্তন এসেছে মন মানসিকতা বদলাও। এই কালের মূলমন্ত্র মানবিকতা/উদারতা। আসলে কতটা? যখন ডিয়াগো’র পরিচিত’রা জেনে যায় সে কি কাজ করে, তখন সবাই বলে এই কাজটি ছেড়ে দিতে। ডিয়াগো অপারগতা জানালে তারা তাকে এড়িয়ে চলে। পরিচালক খুব দক্ষভাবে মানুষের ভেতরকার সংস্কার, ভীতিকে তুলে ধরেছেন। অথচ, এই আচারটি তাদের শেষ বিদায় সৌন্দর্যময় করে তোলে। হায়, মানুষের ভেতর কেমন দ্বৈততা।

মুভিটিতে চমৎকার কিছু মিথিক্যাল ট্রিটমেন্ট আছে। যেমন- মিকা রান্না করার জন্য একটা অক্টোপাশ কিনে । বাসায় এসে দেখে অক্টোপাশটি জীবিত। তখন অক্টোপাশটিকে নদীতে ছেড়ে দেয়। আবার এক দৃশ্যে দেখা যায় মাছেরা স্রোতের প্রতিকূলতায় নিজের জম্মস্থানে ফিরে যাচ্ছে। যেন ফিরে ফিরে আসাই আমাদের নিয়তি। অথবা ডিয়াগো আর তার বাবার সেই পাথর চিঠির কেচ্ছা। এটা সময়সুত্রের অভিন্ন যোগাযোগকে নির্দেশ করে। অতীত বর্তমান ভবিষ্যত কি একই সুতোয় বাধা নয়? এটা প্রশ্ন আকারে যেমনি বলা যায়, আবার নিজস্ব পর্যবেক্ষণের ভেতর জীবন নানা প্রতীকি আকারে ধরা দেয়।

ডিপারচারস সম্পর্কের গল্প। মানুষের সাথে মানুষের, জীবের সাথে বস্তু সম্পর্ক। সম্পর্কই সত্য ঘটনা। সম্পর্কের টানপোড়নে নানা সত্য উম্মোচিত হয়। যেমন ডিয়াগো তার বাবার প্রতি প্রচন্ড মমত্ব অনুভব করে অথচ সে তাকে ঘৃণা করে। যদি এটাকে জীবনের টুকরো একটা ঘটনা বলি, কিন্তু তার তাৎপর্য জীবনের ভেতরকার মাজেজা। হয়তো জীবনের সৌন্দর্য। এই মুভির কাহিনী কি? এক মৃতদেহ সজ্জাকারী ব্যক্তির জীবন যে কিনা আবার সেলো বাদনে দ। এখানে জীবনের অন্তিমমুহূর্ত বারংবার চোখের সামনে ভেসে উঠে। যা প্রায়শ জীবনহীনকে অর্থময় করে বলে মনে হয়। না, এই মুভিটি দেখে জীবন অর্থহীন মনে হয় নি। এই প্রশ্নের উত্তর পেয়েছি, একই পৃথিবীর মানুষ হিসেবে আমাদের সবার একাত্ন হবার বিন্দু কোনটি?
আমাদের মতো জনবহুল দেশে যারা বসবাস করে, বিশেষ ঢাকা শহরে- তাদের কাছে ডিয়াগোর নিস্তরঙ্গ শহরটি ভূতুড়ে মনে হয়। এই মুভির কাহিনীতে সিনেম্যাটিক কোনো বাঁক নেই। এখানে জাপানী জীবন যাপনের কিছু সাধারণ উপাদান টের পাওয়া যায়। যেগুলো একই সাথে লোকাচার এবং সম্পর্ককে বৈশিষ্ট্যসূচকভাবে দেখিয়ে দেয়। সবশেষে বলা যায়, আমাদের চিন্তাকে যদি জাপানী চিন্তার সমান্তরালে না রাখা যায় তবে আপাত সহজ সাবটাইটেলের মুভিটির ভেতরে ঢুকা অনেকাংশে অসম্ভব। বোধ করি ‘ওকুরিবিটো’ শব্দটির ইংরেজী তা পাশ্চাত্য ধারণাকেই ব্যক্ত করে। তাই এর গুঢ় অর্থ খোঁজা কঠিন চেষ্টার বিষয়।

এই মুভির কলাকুশলীদের নিয়ে তেমন কিছু বলার নাই। সবার অভিনয় বিশ্বাসযোগ্য। পুরো মুভি জুড়ে ছিলো ডিয়াগো। এমন কোনো দৃশ্য পাওয়া যাবে না যেখানে ডিয়াগোর উপস্থিতি নাই। তিনি এমনভাবে অভিনয় করেছেন, তার আচঁ পাওয়া যায় মনে। ডিয়াগো চরিত্রে অভিনয় করেছেন মাশাহিরো মোটোকি, এর জন্য তিনি জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন। ছবিটি ২০০৮ সালে মন্ট্রিল ওয়ার্ল্ড ফিল্ম ফ্যাস্টিভেলে সর্বোচ্চ পুরস্কার আর ২০০৯ সালের অস্কারে সেরা বিদেশী ভাষা ক্যাটেগরীতে পুরস্কার জিতে নিয়েছে।

মিউজিক স্কোর অসাধারণ। মিউজিক করেছেন জো হিসাইশী। বলা যায়, ডিয়াগোর পরে যার উপস্থিতি শক্তিশালী - তাহলো মিউজিক।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা অক্টোবর, ২০১০ দুপুর ১২:৪১
১০টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামাত কি দেশটাকে আবার পূর্ব পাকিস্তান বানাতে চায়? পারবে?

লিখেছেন ঋণাত্মক শূণ্য, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৭:২৮

অন্য যে কোন সময়ে জামাতকে নিয়ে মানুষ যতটা চিন্তিত ছিলো, বর্তমানে তার থেকে অনেক বেশী চিন্তিত বলেই মনে করি।



১৯৭১ এ জামাতের যে অবস্থান, তা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে... ...বাকিটুকু পড়ুন

১৯৭১ সালে পাক ভারত যুদ্ধে ভারত বিজয়ী!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯


দীর্ঘ ২৫ বছরের নানা লাঞ্ছনা গঞ্জনা বঞ্চনা সহ্য করে যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বীর বাঙালী অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে দেশ প্রায় স্বাধীন করে ফেলবে এমন সময় বাংলাদেশী ভারতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা গান্ধীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক: ওরিয়ানা ফলাচির সাক্ষাৎকার

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৫


১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইতালীয় সাংবাদিক ওরিয়ানা ফলাচি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার নেন। এই সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধ, শরনার্থী সমস্যা, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক, আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্ট্রনীতি এবং পাকিস্তানে তাদের সামরিক... ...বাকিটুকু পড়ুন

=যাচ্ছি হেঁটে, সঙ্গে যাবি?=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:০৬


যাচ্ছি হেঁটে দূরের বনে
তুই কি আমার সঙ্গি হবি?
পাশাপাশি হেঁটে কি তুই
দুঃখ সুখের কথা ক'বি?

যাচ্ছি একা অন্য কোথাও,
যেখানটাতে সবুজ আলো
এই শহরে পেরেশানি
আর লাগে না আমার ভালো!

যাবি কি তুই সঙ্গে আমার
যেথায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

আগামী নির্বাচন কি জাতিকে সাহায্য করবে, নাকি আরো বিপদের দিকে ঠেলে দিবে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:১২



আগামী নির্বচন জাতিকে আরো কমপ্লেক্স সমস্যার মাঝে ঠেলে দিবে; জাতির সমস্যাগুলো কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। এই নির্বাচনটা মুলত করা হচ্ছে আমেরিকান দুতাবাসের প্রয়োজনে, আমাদের দেশের কি হবে, সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×