somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মোবাইলে পর্নোগ্রাফী, নতুন প্রজন্ম এবং বাবা-মা

২৭ শে মে, ২০১২ রাত ১২:৪৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ঢাকার একটি পরিচিত চেইন রেস্টুরেন্টে বউ-বাচ্চাদের নিয়ে খেতে গিয়েছি। আমাদের টেবিলের পাশে দু-তিনটি টেবিল একসাথে করে ১৩-১৪ বছর বয়স্ক দশ-বারোজন স্টুডেন্টদের একটি গ্রুপও বসেছে। পুরো গ্রুপে বোধ হয় দু-তিনটি মেয়ে ছিলো। আমরা বসতে না বসতেই অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম ছেলেমেয়েগুলো নিঃসংকোচে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাচ্ছে। ওদের কোন লজ্জার চিহ্ন নেই, এদিকে আমরাই যেন লজ্জায় মরে যাচ্ছিলাম। দ্রুত খাওয়া শেষ করে আমরা উঠে পড়লাম, মনটা বিষন্নতায় ছেয়ে গেলো।

ছোটবেলায় টেলিভিশন দেখার সুযোগ আব্বা খুব কমই দিয়েছেন। বাবা-মা'র সাথে একসাথে বসে টিভি দেখেছি এমনটা মনে করতেও কষ্ট হচ্ছে। তবে এটা মনে আছে, সেসময় যদি এমন কোন দৃশ্য আসত যখন কোন মেয়ে ওড়না ছাড়া টিভি পর্দায় এসেছে, তাহলে আব্বার ভয়ে আমরা কুঁকড়ে যেতাম আর কোন মতে উঠে চলে আসতে পারলেই যেন বাঁচতাম। শেষ পর্যন্ত আব্বা ঘর থেকে টিভিই বিদায় করে দিলেন।

আমরা যারা বর্তমান প্রজন্মের ইমিডিয়েট আগের প্রজন্ম, তারা প্রায় সকলেই এমন সময় কাটিয়েছি। কোন কোন স্কুলে মেয়েদের সাথে পড়েছি বটে, তবে বন্ধুত্বের নামে মেয়েদের সাথে কোথাও গিয়েছি বা একসাথে বসেছি এমনটা আমাদের অধিকাংশের সুদূর কল্পনাতেও ছিলো না। কেজি থেকে টুয়েলভ পর্যন্ত পুরো ছাত্র বয়সে আমাদের অসংখ্য বন্ধুদের মধ্যে দুই কি তিন জনের হয়ত কোন মেয়ের সাথে প্রেমের সম্পর্ক ছিলো, তবে একজনেরও এখনকার মত বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিলো না তা নিশ্চিত। আমরা বন্ধুরা তা যে ধর্মের অনুসারীই ছিলামনা কেনো, সকল বাবা মা-ই এমন সুনির্দিষ্ট শাসনে আমাদের বড় করেছেন, আল্লাহ তাদের উপর রহম করুন যেরূপ রহম তাঁরা আমাদের উপর করেছেন।

সময় বয়ে গেছে দ্রুত। বিগত প্রজন্মের আমরা আজ বাবা-মা'র আসনে। আজ হতভাগা এই আমরা চেয়ে চেয়ে দেখছি আমাদের সন্তানেরা সাথে বসে শুধু টিভি নয়, অশ্লীল হিন্দি নাচ দেখে চলেছে। এসব দেখে তারা লজ্জা পায়না বরং আমরা লজ্জায় উঠে পড়ি কিংবা দেখেও না দেখার ভান করে ব্যাপারটাকে সহজ করে নেই। এয়ারটেল, গ্রামীন বা বাংলালিংকের সুদৃশ্য বিজ্ঞাপনগুলোতে আমরা দেখছি ছেলে আর মেয়ে বন্ধুরা কেমন হেসে হেসে গলা জড়িয়ে ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে বা মজা করছে। আমরা নিশ্চিত হয়েছি, এটাই বর্তমান যুগের বন্ধুত্ব। তবে অনেক কষ্ট নিয়ে আমরা দেখছি, আমাদের সন্তানেরা আজ শুধু মেয়েদের সাথে বন্ধুত্বের নামে ফ্রি মিক্সিংই শুরু করেনি, বরং রাতের পর রাত মোবাইলে অজানা সব আলাপে ব্যস্ত থাকছে। আমরা? আবার সেই দেখেও না দেখার ভান করছি আর ভাবছি, যুগের হাওয়া, বাচ্চা তো আর যুগের বাইরে যেতে পারেনা। পেপারে, খবরে দেখছি ছোট ছোট কিশোর কিশোরীর দল পর্নগ্রাফীতে আসক্ত হচ্ছে। আমরা ভাবছি, আমার সন্তানটা নিশ্চয়ই এতোটা খারাপ হবেনা।

এক সময় আমরা অবাক হয়ে দেখছি, আমাদের বাচ্চারা আজ আমাদের বন্ধন থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। যুগের হিসাব করে যে কাজগুলোতে আমরা প্রথমেই বাধা দেইনি, আজ সেগুলোতে জড়িয়ে তারা বাবা-মাকে এখনই বোঝা ভাবতে শুরু করেছে। অনেকে জড়িয়ে পড়ছে ড্রাগসের নেশায়, কেউ নারীর নেশায় কেউবা পুরুষের নেশায়। আজ এই ধ্বংস হয়ে যাওয়া সমাজ ব্যবস্থায় আমাদের বৃদ্ধ বাবা-মা'রা এখনও আমাদের সাথেই আছেন। তবে আমরা যখন বার্ধক্যে উপনীত হবো, তখন আমাদের অধিকাংশের অসহায় সময়টা হয়ত বৃদ্ধাশ্রমের বন্দীশালায় জুড়ে যাবে।

পৃথিবীর ইতিহাস এখন সত্যিই ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। এত দ্রুত আর কখনও যুগের সাথে সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন হয়নি। আমরা যেমন দেখছি আমাদের সন্তানদের বেলায়, তা থেকে আমাদের নিজেদের কৈশোর ছিলো অনেক পরিচ্ছন্ন, আবার আমাদের বাবাদের কৈশোর ছিলো আমাদের চেয়েও নিয়ন্ত্রিত আর পরিশুদ্ধ। আমাদের দাদা থেকে নিয়ে আজ যদি আমাদের সন্তানদের কৈশোরের সময়টা নিয়ে ভাবি তাহলে দেখতে পাবো মাত্র শ খানিক বছরের মধ্যে পৃথিবীর প্রতিটি কমিউনিটির সমাজ ব্যবস্থা অবিশ্বাস্যভাবে পরিবর্তিত হয়ে গেছে। এক সময় যা ছিলো ভীষণ অন্যায় আর অনৈতিকতা, আজ তা স্মার্টনেস হিসাবে পরিচিত হয়ে গেছে। এখন চলছে ২০১২, এবং আজ যদি আমরা ১৯১২ সালের সাথে নিজেদের সমাজ এবং মানসিকতাকে মেলাতে যাই তাহলে অবাস্তব মনে হবে। কিন্তু যদি ১৯১২ সালের সাথে ১৮১২ সালকে মেলাতে যাই, তাহলে সেটা ততটা উদ্বেগজনক হবেনা।

মনে পড়ছে ইসলামের ইতিহাসের সন্তানদের লালন পালনের সৌন্দর্যগুলো। আবু বাকর রাঃ যখন খলিফা, তখন তাঁর সন্তান আবদুর রাহমান বিন আবু বাকরকে এমনভাবে লালন পালন করেছেন যে, অধিকাংশ মানুষ তাকে চিনতোই না। উমার বিন খাত্তাব রাঃ যখন খলিফা হিসাবে মৃত্যু শয্যায়, তখন তাঁর পুত্র আব্দুল্লাহ বিন উমারের নাম উল্লেখ করে তিনি বলে যান "তাকে তোমরা পরবর্তি খলিফা কে হবে সে মত দেবার জন্য রাখতে পারো, কিন্তু সে খলিফা হতে পারবেনা"। বিখ্যাত তাবেয়ী উমার বিন আব্দুল আজীজ (যিনি পরবর্তিতে খলিফা হয়ে উমার রাঃ এর মতই ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন) যখন কিশোর, তখন তাঁর বাবা আবদুল আজীজ ছিলেন সিরিয়ার মতো বিরাট প্রদেশের গভর্ণর। তিনি ছেলেকে মদীনায় পাঠিয়ে দেন শিক্ষা গ্রহণের জন্য এবং শিক্ষককে বলে দেন, "আল্লাহর শপথ, যদি গভর্ণরের সন্তান হিসাবে তার প্রতি কোন পক্ষপাত আপনি করেন, তাহলে আল্লাহর কাছে আপনাকে আমি দায়ী করব"। এই উমার বিন আব্দুল আজীজ একবার মসজিদে সালাতে প্রথম রাকাত মিস করেন। তাঁর শিক্ষক তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, "কেন তুমি প্রথম রাকাত পাওনি"? তিনি জবাব দিয়েছিলেন, "আমার চুল আঁচড়াতে দেরী হয়ে গিয়েছিলো"। শিক্ষক তখন বললেন, "যেই চুল তোমার কাছে সালাতের চেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে, সে চুল আমি আজই কেটে দেবো"। বালক উমারের বাবা তার কাটা চুলের এ ঘটনা শুনে বলেছিলেন, "আল্লাহ তার শিক্ষককে উত্তম বিনিময় দিন"।

যুগের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে যে সন্তানদের আমরা ভয়াবহ অনৈতিকতার দিকে ঠেলে দিয়েছি, সেই আমাদের মনে রাখতে হবে যে, যদি এমন কোন কাজের জন্য আমাদের সন্তান পরকালে আগুনের অধিবাসী হয় যা তার বাবা-মা শৈশবে শিক্ষা দেননি, তাহলে সে সন্তানেরাই আল্লাহর কাছে বলবে, "হে আল্লাহ, আজ আমাদের বাবা-মা'কে আমাদের পায়ের তলায় এনে দিন, আমরা আজ তাদের পিষে মারব, আর তাদেরকে আপনি দ্বিগুন শাস্তি দিন"।

আপনি নিশ্চিত থাকুন তা ঘটবেই, কেননা আল্লাহ তাই বলেছেন।
২৯টি মন্তব্য ২৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামাত কি দেশটাকে আবার পূর্ব পাকিস্তান বানাতে চায়? পারবে?

লিখেছেন ঋণাত্মক শূণ্য, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৭:২৮

অন্য যে কোন সময়ে জামাতকে নিয়ে মানুষ যতটা চিন্তিত ছিলো, বর্তমানে তার থেকে অনেক বেশী চিন্তিত বলেই মনে করি।



১৯৭১ এ জামাতের যে অবস্থান, তা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে... ...বাকিটুকু পড়ুন

১৯৭১ সালে পাক ভারত যুদ্ধে ভারত বিজয়ী!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯


দীর্ঘ ২৫ বছরের নানা লাঞ্ছনা গঞ্জনা বঞ্চনা সহ্য করে যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বীর বাঙালী অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে দেশ প্রায় স্বাধীন করে ফেলবে এমন সময় বাংলাদেশী ভারতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা গান্ধীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক: ওরিয়ানা ফলাচির সাক্ষাৎকার

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৫


১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইতালীয় সাংবাদিক ওরিয়ানা ফলাচি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার নেন। এই সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধ, শরনার্থী সমস্যা, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক, আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্ট্রনীতি এবং পাকিস্তানে তাদের সামরিক... ...বাকিটুকু পড়ুন

=যাচ্ছি হেঁটে, সঙ্গে যাবি?=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:০৬


যাচ্ছি হেঁটে দূরের বনে
তুই কি আমার সঙ্গি হবি?
পাশাপাশি হেঁটে কি তুই
দুঃখ সুখের কথা ক'বি?

যাচ্ছি একা অন্য কোথাও,
যেখানটাতে সবুজ আলো
এই শহরে পেরেশানি
আর লাগে না আমার ভালো!

যাবি কি তুই সঙ্গে আমার
যেথায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

আগামী নির্বাচন কি জাতিকে সাহায্য করবে, নাকি আরো বিপদের দিকে ঠেলে দিবে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:১২



আগামী নির্বচন জাতিকে আরো কমপ্লেক্স সমস্যার মাঝে ঠেলে দিবে; জাতির সমস্যাগুলো কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। এই নির্বাচনটা মুলত করা হচ্ছে আমেরিকান দুতাবাসের প্রয়োজনে, আমাদের দেশের কি হবে, সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×