somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ফেসবুক প্রজন্মের এক তরুণের কাছে ড. জামাল নজরুল ইসলাম

০৭ ই এপ্রিল, ২০১৩ সকাল ৯:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমি ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িনি, তাই কখনো জামাল নজরুল ইসলাম স্যারের লেকচার শোনার সুযোগ হয়নি। আমি পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম না, সে কারণে আমি কখনও নজরুল স্যারের ছাত্র ছিলাম না। আমি গণিত নিয়ে কখনো গবেষণা করিনি, সে কারণে স্যারের সহযোগী হতে পারিনি।
কিন্তু আমি সেই ছেলে যে ছোটবেলায় ক্লাস ফাইভে থাকার সময় বিজ্ঞান মেলায় তন্ময় হয়ে তাকিয়ে ছিলাম, কোট টাই পরা ভীষণ অভিজাত ড. জামাল নজরুল ইসলামের বক্তৃতার সময়, বলছিলেন রবীন্দ্রনাথের গান আর বিজ্ঞানের মেলবন্ধনের কথা। সেই আমিই ঠিক পনের বছর পর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবার পরেও একই রকম আভিজাত্য নিয়ে দেখেছি জামাল স্যারকে। সেই একইভাবে টাই পরা, একই ভঙ্গিতে স্টিফেন হকিন্সের গল্প বলা। আমার মু্গ্ধতা বিন্দুমাত্র কমেনি, দিন দিন বেড়ে গেছে। আমাদের মত একটা প্রজন্মের পুরো বেড়ে ওঠাটাই জামাল নজরুল স্যারকে দেখে। আমাদের আটপৌরে চট্টগ্রাম শহরে এক ফেরিওয়ালা জামাল নজরুল স্যার, যেই ফেরিওয়ালার ঝুড়িতে ছিল স্বপ্ন, বিজ্ঞানের জন্য ভালোবাসা, দেশ বিদেশের অসংখ্য বিখ্যাত মানুষের সান্নিধ্যের গল্প আর কল্পনার সুতা।

একজন গায়ক, নায়ক কিংবা খেলোয়াড় এই বিশ্বায়ন আর সাম্রাজ্যবাদের সময়ে অনেক বেশি বিখ্যাত। আর একজন বিজ্ঞানী? সে তো সবচেয়ে অবহেলিতদের দলে এই বাণিজ্যিকীকরণের যুগে। কিন্তু জামাল নজরুল স্যার ছিলেন এর ব্যতিক্রম। তার মৃত্যুর খবর সবার আগে আমাকে স্কাইপেতে দিয়েছে আমারই এক ছাত্র। তার মৃত্যুর পরমুহূর্তই কানাডার টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছেলের ফেসবুকের স্ট্যাটাস ছিল, খালি হয়ে গেল চট্টগ্রাম শহর। সিঙ্গাপুরের আরেক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া চট্টগ্রামের ছেলে লিখল সার্সন রোডের পিয়ানো আর বাজবে না। সবার প্রোফাইল পিকচায় হয়ে গেল জামাল নজরুল ইসলামের ছবি। প্রিয় জামাল স্যার, আপনি না থাকলেও আপনার এই প্রজন্মের সৈনিকরা কিন্তু জেগে আছে আপনার চেতনাকে ধারণ করে। বিতর্ক করার কারণে আমার মাঝে ভাল ও বৈচিত্র্যময় বক্তৃতার প্রতি একটা তীব্র আকর্ষণ কাজ করে। কি অদ্ভুত! একটা মানুষ বক্তব্য শুরু করে মহাকাশ নিয়ে কিন্তু একটু পরেই সেই মানুষটিই বলছে সভ্যতার জেগে ওঠার গল্প, রুমির কবিতা, ইলিয়টের সাহিত্য, ইসলাম ধর্মের দর্শন, মার্শাল ম্যাকলোহানের অর্থনীতির তত্ত্ব। একটা মানুষের জানার জগত এত ব্যাপক হয় কিভাবে? এই বিশালত্বকে ধারণ করতেন জামাল স্যার। আমেরিকানরা সব সময় একটা কথা বলে থাকে, একজন বিজ্ঞানী শুধু একটি বিষয়কে নিয়ে জানলেই হবেনা, তাকে জ্ঞানের অনেকগুলো রাজ্যে বিচরণ করতে হবে। তাহলেই সে নিত্যনতুন অভিনব কাজের আইডিয়া পাবে। জামাল নজরুল ইসলাম ছিলেন সেই পর্যায়ের একজন উঁচু মাপের বিজ্ঞানী। আমাদের প্রজন্মের অনেকেই স্বপ্ন দেখে দেশের বাইরে পড়ার, গবেষণা করার। কিন্তু আবার মনটা ভীষন উদাস হয়ে যায় যখন ভাবি, দেশ ফিরে কি করব? কিন্তু জামাল নজরুল স্যার ই সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। তার ভাষায়, কাজ করার জন্য নিজের দেশই সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান, কারণ এখানে খুব সহজে পরিবেশ, মানুষ আর প্রাসঙ্গিকতার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা যায়।

আমার অনেক বন্ধুকেই দেখেছিলাম ভীষণ মেধাবী ছেলে, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাল ফল করত না। কারণ ইংরেজি ভাষা কে ভীষণ দুরুহ মনে হত তাদের কাছে। সবসময় শুধু বলত, ইশ্ বইগুলো যদি বাংলায় হত লিখে তুলকালাম করে ফেলতাম। এই তীব্র সত্যটি আর কেউ উপলব্ধি না করলেও জামাল স্যার ভীষণভাবে অনুভব করতেন। তিনি চিরকাল মাতৃভাষায় ভাল বিজ্ঞান চর্চা ও উচ্চতর গবেষণার জন্য সবাইকে উৎসাহ দিতেন। কাজ করে গেছেন মাতৃভাষায় বিজ্ঞান চর্চা ও বই লেখার জন্য। আমাদের প্রজন্মের কাছে একজন মানুষের আইডল হওয়ার অন্যতম শর্ত হচ্ছে ইতিবাচকতা। একজন ইতিবাচক মানুষের প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত ছিলেন জামাল নজরুল ইসলাম। আমার মনে আছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে এক মিটিং এ সাবেক উপাচার্য আবু ইউসুফ সার দুঃখ করে বলছিলেন, সবাই শুধু দায়িত্বে যারা থাকে তাদের নিন্দা নিয়ে ব্যস্ত থাকে, ভাল কাজ দেখে না। তখন জামাল স্যার বলেছিলেন, এটা হল থ্যাঙ্কলেস জব, যেখানে ধন্যবাদ পাওয়ার আশা আপনি কখনোই করতে পারেন না। আপনি যে দায়িত্ব পেয়েছেন এটাই আপনার জন্য সবচেয়ে বড় ধন্যবাদ। কারও কথায় মন খারাপ করবেন না।

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্যের জায়গাগুলোর একটি হল, এখানেই সবাই বিতর্কিত। কিন্তু জামাল নজরুল ইসলাম সার এমন একজন মানুষ ছিলেন যিনি ব্যতিক্রম। ছোটবেলায় আমাকে যে হুজুর পড়াতে আসত তিনি বিজ্ঞান শিক্ষায় আমাদেরকে আইডল হিসেব জামাল স্যারের উদাহরণ দিতেন, আমার মা বিজ্ঞানী বললেই বলতেন তোমাকে জামাল নজরুলের মত হতে হবে, আমার মামারা শিল্পপতি হলেও অন্যরকম শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন বিজ্ঞানীদের। আর সবার আগে বলতেন জামাল নজরুলের কথা, সাংস্কৃতিক কোন অনুষ্ঠানে সবার আগে অতিথি হিসেবে যার নাম আসত তিনি জামাল স্যার, অর্থনীতি সমিতির গোল টেবিল বৈঠকে তালিকায় সবার উপরের দিকে যে কয়েকটা নাম থাকতো তার একটি জামাল নজরুল ইসলাম। সব পর্যায়ের সব স্তরের মানুষ তাকে অন্যরকম একটা উচ্চতায় দেখত। এখানেই তার গ্রহণযোগ্যতা, সার্থকতা।
বিদায় বাংলার স্টিফেন হকিন্স। আপনার নোবেল পুরস্কারের দরকার নেই, আপনার যুক্তরাষ্ট্র কিংবা কানাডার স্বীকৃতির দরকার নেই, আপনার রাষ্ট্রীয় সম্মাননায় বিদায়ের দরকার নেই। আপনি বেঁচে থাকবেন এই প্রজন্মের চোখের আলোয়। মৃত্যুর ওপারে ভাল থাকবেন প্রিয় জামাল স্যার। অনেক অনেক ভালো থাকবেন আমাদের অনুপ্রেরণা হয়ে, অহংকার হয়ে, আলোকবর্তিকা হয়ে।

লেখক : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের শিক্ষক এবং বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষণারত.
(৬।৪।২০১৩ তে দৈনিক পুর্বকোনে প্রকাশিত-
Click This Link )
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই এপ্রিল, ২০১৩ সকাল ৯:০৫
৭টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিব নারায়ণ দাস নামটাতেই কি আমাদের অ্যালার্জি?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৫:৫৭


অভিমান কতোটা প্রকট হয় দেখেছিলাম শিবনারায়ণ দাসের কাছে গিয়ে।
.
গত বছরের জুন মাসের শুরুর দিকের কথা। এক সকালে হঠাৎ মনে হলো যদি জাতীয় পতাকার নকশাকার শিবনারায়ণ দাসের সঙ্গে দেখা করা সম্ভব... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতি মাসে সামু-ব্লগে ভিজিটর কত? মার্চ ২০২৪ Update

লিখেছেন জে.এস. সাব্বির, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৮

মার্চ ২০২৪ সালে আমাদের প্রিয় সামু ব্লগে ভিজিটর সংখ্যা কত ছিল? জানতে হলে চোখ রাখুন-

গত ৬ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভিউ ছিল জানুয়ারি মাসে। ওই মাসে সর্বমোট ভিজিট ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×