somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রোদ

২৬ শে আগস্ট, ২০১৩ বিকাল ৫:১৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাইরে রোদ। ঝলমলে, উজ্জ্বল, প্রাণ-সঞ্চারী। রোদের সাথে আছে হাওয়া— হালকা হালকা। এই রোদে, এই হাওয়ায় অকারণেই মনটা কেমন চনমনিয়ে ওঠে।

এমন রোদে রিকশায় হুড ফেলে ঘুরতে বেরুলে— যখন কানের পাশে, ঘাড়ের উপর এসে আলতো করে ছুঁয়ে যায় বাতাস, তখন মনের মধ্যে চেপে রাখা অসন্তুষ, গতরাতের মালিন্য, বন্ধু-পরিচিত-সহকর্মীর অনুদারতা যেনো মনেই থাকে না আর!

রোদের প্রতি আমার আসক্তি আশৈশব। যখন শৈশবের স্মৃতি মনে করি, দেখি যে, সেই সব প্রাথমিক বয়সের স্মৃতির সঙ্গেও মাখামাখি হয়ে আছে রোদ।

চৈত্রের রোদ, ভাদ্রের রোদ, শীতের রোদ, আমার বাড়ির উঠোনের রোদ, ঘরের চালে পিঠা বা আচার শুকোতে দেয়ার রোদ, কাপড় ধুয়ে মাঠে নেড়ে দেয়ার রোদ, খেলতে খেলতে গোরস্তানের ভেতরে ফুল তুলতে যাওয়ার রোদ, নানুর বাড়ির পুকুরের রোদ, ধানকাটা শেষের শূন্য ক্ষেতে পড়ে থাকা রোদ, ধানরোয়া দুপুরে কাদাপানিতে মাখানো রোদ, স্কুলে যাবার সময়ের রোদ, স্কুল থেকে ফেরার সময়ের রোদ, কলেজের রোদ, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে আমার রুমের পেছনে শিমুল গাছে এসে বসা রোদ, হল থেকে বেরোনোর পর আমার আকাশহীন বাড়ির জানালার ফাঁকে চকিতে উঁকি দেয়া রোদ, মাঝে মাঝে রোদের জন্য মন আকুল হলে হঠাৎ রিকশা নিয়ে পথে পথে ঘুরে দেখা রোদ!

হঠাৎ হঠাৎ বিকেলের দিকে সুমনকে বলি: “যাবে না-কি ধানমন্ডি লেকে? চলো, চা খেয়ে আসি।”

ও খুব ভালোই বুঝতে পারে, আমি কেবলই চা খেতে যেতে বলছি না। তাই ও বলে: “না বাবু, আমার এখন রোদ দেখতে ইচ্ছে করছে না। তুমি যেয়ে ঘুরে এসো।”

তো আর কি! যাই, আমি একাই যাই। ধানমন্ডি লেকে ঘুরি। চা খাওয়ার ইচ্ছে না থাকলেও চা খাওয়ার ভান করে হাতে কাপ নিয়ে বসি কিছুক্ষণ, তারপর ঘুরি, তারপর আবার বসে থাকি, যতক্ষণ ইচ্ছে করে।

একা একা চা খাওয়া বা রোদ দেখার ঘটনাতো আমার এই প্রথমবার নয়। কিন্তু মাঝে মাঝে যে একা না থেকে মানুষের সঙ্গে গল্প করতে করতে রোদ দেখতে ইচ্ছে করে না এমন তো নয়।

তাই, মাঝে মাঝে আমি এমন করতাম— হয়তো কারো সঙ্গে দেখা করা দরকার, কোনো একটা কাজেই, কোনো একটা আলাপ আছে, প্রয়োজন আছে— তো আমি কখনও কখনও চেষ্টা করতাম সেই সব প্রয়োজনীয় আলাপগুলোকে রোদের সঙ্গে মিশিয়ে দিতে।

যার সঙ্গে আমার দেখা করা দরকার তাকে হয়তো আমি বলতাম: “অমুক সময়ে আমি ধানমন্ডির দিকে থাকবো। আপনি কি ধানমন্ডি লেকে এসে চা খেতে খেতে আলাপটা সেরে নিতে পারেন?”

কখনো কখনো হয়তো উত্তর আসতো “হ্যাঁ।”

ধানমন্ডি লেকে চা খাওয়ার জন্য গত দুই-তিন বছরে সবচেয়ে বেশি বার আমি ফোন করেছি সাগর ভাইকে। মনে আছে, একদিন ভরদুপুরে সাগর ভাইকে ফোন দিয়ে বল্লাম: “আপনি কই?”

সাগর ভাই বলে: “বাসায়। তুই কই?”

আমি বলি: “চা খাবেন?”

সাগর ভাই বলে: “তুই দুপুরে খাইছিস?”

আমি বলি: “না”

সাগর ভাই বলে: “তাইলে বাসায় চলে আয়। দুপুরের খাবার খেয়ে যা।”

আরে কীসের খাবার খাওয়া-খাওয়ি? আমি সাগর ভাইকে বুঝাই যে এই মুহুর্তে আমার ভাতের বাসনা নাই। আমি ধানমন্ডি লেকে চোখের সামনে রোদ নিয়ে বসে থাকবো। সাগর ভাই পরাস্ত হয়। বলে: “আচ্ছা ঠিক আছে। তুই থাক। আমি আসতেসি।”

আরেকবার বর্ষাকালে, গেলো বর্ষার আগের বর্ষার আগের বর্ষায়, সাগর ভাইকে এইরকম ভরদুপুরে ধরে নিয়ে আসলাম।

নিয়ে এসে কী কাজ? কাজ আবার কী! বসে বসে চা সিগেরেট খাওয়াই কাজ। ভরা বর্ষার ধানমন্ডি লেক যে একেবারে টুইটুম্বুর হয়ে উঠেছে সেটা দেখাই কাজ। রোদ এসে যে ধানমন্ডি লেকের পানিতে পড়ছে, আবার ঝিরিঝিরি ঢেউ-এর মাথায় রোদ লেগে কেমন যে আলোর হাজার প্রদীপ জ্বলে উঠছে জলের বুকে— সেটা দেখাই কাজ। লেকের পানিতে, এক্বেবারে কিনার ঘেষে একটা চিকন সাপ যে পানি কেটে কেটে আমাদের সামনে দিয়ে আট নম্বর ব্রিজ-এর দিকে যাচ্ছে সেটা দেখাই কাজ। সুতরাং এর বাইরে কাজ আবার কী!

আমি যখন স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতাম, তখন সেই ‘মাস্টরির’ কালে রীতিমত আমার নেশা হয়ে গেলো ধানমন্ডি লেক। কাক ডাকা ভোরে মাঝে মাঝে ঘুম থেকে উঠে সূর্য উঠার আগেই অস্পষ্ট আলোতে পৌঁছে যেতাম লেকে। তারপর ধীরে রোদ উঠত— আমার চোখের সামনে দিয়ে। কোলাহল বাড়তো, পথে গাড়ি-রিকশা বাড়তো আমার চোখের সামনে দিয়ে।

আবার কখনও কখনও দুপুর বেলায় ইউনিভার্সিটি থেকে টুক করে বেরিয়ে এক পাক ঘুরে যেতাম ধানমন্ডি লেক; দেখতাম— রোদের মধ্যে রঙীন প্রজাপতি হয়ে আছে নানা বয়সী মানুষ; দেখতাম— সেই সব প্রজাপতিরা চা খাচ্ছে, গল্প করছে, ফোনে কথা বলছে, বসে আছে অন্য কারো আসার অপেক্ষায়।

আমার তো আর কারো জন্য অপেক্ষা নেই। আমি রোদ দেখতে আসি। রোদ দেখে চলে যাই। কিন্তু যাওয়া আসলে হয় না। তাই বার বার রোদ আমাকে ফিরিয়ে আনে, টেনে আনে।

কখনো কখনো ঢাকা শহরের ঝলমলে উজ্জ্বল রোদ আমাকে এক ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় নানু বাড়ির পুকুরে। আমি পুকুরে সাঁতরাতে থাকি। আমার এহসান খালার সঙ্গে ছোটো একটা জাল দিয়ে ধরতে থাকি মাছ।

নানু বাড়ির রোদের গন্ধ আমার আমির মধ্যে ঢুকে গেছে। বিরাট জাম্বুরা গাছ থেকে জাম্বুরা পেরে ভর দুপুরে ভর্তা করে খাওয়ার সাথে আছে রোদ। খড়ের গাঁদার মধ্যে হুটোপুটি করে, টমেটো ক্ষেত থেকে টমেটো তুলে, কাঁচা মরিচের ক্ষেত থেকে মরিচ তুলে লবণ দিয়ে খাওয়ার সাথে আছে রোদ।

ধানের ক্ষেতে চারা রোপনের সময় সকালবেলায় ক্ষেতে কর্মরত কামলা-মুনিষ-মামা-নানা সকলের জন্য রুটি-ভর্তা-ভাজি দিয়ে নাশতা নিয়ে যাবার সময় ছিল রোদ। মামাদেরকে পটিয়ে-টটিয়ে ধানের চারা লাগানোর ক্ষেতে নেমে যাবার সময় কাদার মধ্যে মাখামাখি হয়ে ছিল রোদ।

কখনও উদাস দুপুরে নানু-বাড়ির সামনের পকুর পাড়ের তালগাছটা— যেটি কি-না পুকুরের পাড় থেকে হেলতে হেলতে প্রায় শুয়ে পড়েছে পুকুরের জলের উপর— তার গায়ে আমার বসে থাকা বা শুয়ে থাকার মধ্যে মাখামাখি হয়ে আছে উজ্জ্বল ঝলমলে রোদ।

আর আমার নিজের বাড়িতে মা যখন প্রতি সপ্তাহে বিশাল এক গাট্টি কাপড় ধুয়ে বাড়ির চারদিকে এবং বাড়ির পিছনে এক মাঠের মধ্যে প্রায় মাঠ ভরে কাপড় নেড়ে দিত কাউকে দিয়ে, তখন আমাকে বসাতো কাপড় পাহারায়। আমি তো মহাখুশি। ঘরে বসে থাকার যাতনা তো নাই-ই নাই, তার উপরে কাপড় পাহারা দেবার নাম করে আমি যদি একটু বনে-বাঁদারে ঘুরেও আসি, আজকে আর ‘আম্মি’ মানে আমার মায়ের আর জানার কোনো উপায়ই থাকবে না। অতএব আজ “আহা! কী আনন্দ আকাশে বাতাসে।”

তো, পাহারাদারির সুযোগ নিয়ে আমি ঘাসের উপর রোদের দিকে মুখ করে শুয়ে থাকি ঘন্টার পর ঘন্টা। রোদের তাপে যখন মুখ জ্বলতে থাকে তখন ঘাসের মধ্যে উপুর হয়ে আকাশের দিকে পিঠ দিয়ে শুয়ে থাকি রোদে। মাঝে মাঝে আমার দাদি এসে ডেকে বলবে: “কি-রে! তুই রইদের মইদ্যে কি-তা করস?”

হঠাৎ হঠাৎ আম্মি যদি এসে দেখে ফেলে যে আমি রোদের দিকে মুখ করে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছি তাহলে মাইর আর মিস নাই। কারণ আম্মির দেওয়া নির্দেশনা অনুযায়ী কাপড় পাহারা দেওয়া মানে বাড়ি থেকে বারে বারে বের হয়ে মাঠে গিয়ে একটু ঘুরে দেখে আসা; অথবা ঘরের পাশে দু-চার মিনিট ছায়ার মধ্যে গাছের তলায় দাঁড়িয়ে মাঠের দিকে দেখা।

কিন্তু সুযোগ তো আর রোজ রোজ আসে না। আমি তাই, প্রখর পাহারাদার হয়ে উঠি। তাই, কাপড় ছেড়ে যেনো আমার আর ঘরেই যেতে মন চায় না।

আবার পিঠা বা আচার বানিয়ে কখনো কখনো রোদে শুকোতে দিলে আম্মি বলতো: “এই একটু পাহারা দিস তো। নাইলে কাউয়া খাইয়ালবো।”

আরে আমি থাকতে কাক আসবে কেমনে! আমার চোটপাটে সব কাক দূরে থাকে আর কল্পিত কাকের ভাগটা আমি খেয়ে নিই। যদি ভুল করে বেশি খেয়ে ফেলি এবং সেটা যদি আম্মি বুঝে যায় তাহলে সে বলে: “কিরে কাউয়া তো আজকে আরো বেশি খাইসে!”

এইসব পাহারাদারির সুযোগ তো আর নিত্যদিন আসতো না। কিন্তু এরপরেও সূর্য থাকতো, রোদ থাকতো আমার সঙ্গে নিত্যদিন।

স্কুল থেকে ফেরার পথে বিকেলে সূর্য যখন হেলে পড়েছে পশ্চিমে তখন নরসুন্দা নদীতে রোদের রং হতো খুব মায়াময়। ছোটো ছোটো ঢেউয়ের মাথায় অস্তগামী সূর্যের আভা লেগে কেমন যে ঝিকমিক ঝিকমিক করতো!

আবার চৈত্রের প্রখর রোদে যখন চরাচর ঝাঁ ঝাঁ করছে, তখন কেবল রোদের দিকে তাকিয়েই আমার মন আনচান করে উঠতো। ঘরের মধ্যে আর আমার বসে থাকতে মন চাইতো না। মনে হতো কোথাও চলে যাই, দূরে কোথাও, অনেক দূরে... অনেক দূরে... আমি যেই সুদূরের ঠিকানা জানি না।

কিন্তু মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে কতদূরে আর যেতে পারি আমি! পশ্চিমপাড়ার কেউ এসে আম্মিকে বলে যাবে: “কি-গো চাচী, সুমারে (সোমারে) ত দেখছি গুরুস্তানের (গোরস্তানের) ভিতরে ফুল তুলতাছে।”

কেউ এসে বলে যাবে: “মামানী, সুমারে ত দেখছি মরাখলার (শ্মশ্মান) সামনে।”

কেউ এসে বলে যাবে: “খালাম্মা, সুমারে ত দেখছি পুলাফানের (পোলাপান) লগে গাঙ্গের মইদ্যে সাঁতারাইতাসে।”

কেউ এসে বলবে: “ভাবী, সুমারে ত দেখছি বজলুর দিঘির ফারঅ (পাড়ে) একলা একলা ঘুরতাসে।”

কেউ এসে বলবে: “কি-গো বেডি, তোমার ছেরিরে দু (তো) দেখছি, দুইফরঅক্ত (বেলা দ্বিপ্রহরে, মানে ঠিক দুপুর বেলায়) ফড়াবাড়ির (যেই বাড়ি পতিত পড়ে আছে কয়েক যুগ ধরে। মানুষজন নাই। কেবল গাছ-গাছরা।) তেঁতুল গাছের তলে।”

অতএব, এতো এতো চোখ ফাঁকি দিয়ে আমার আর যাবার সুযোগ নেই।

আমার উপরে আমার মায়ের বিরাট কড়া শাষণ— এই করা যাবে না, ওই করা যাবে না, এইখানে যাওয়া যাবে না, অমুক সময় ঘুমাতে হবে, অমুক সময় ঘুম থেকে উঠতে হবে, এইভাবে কথা বলতে হবে, এইভাবে হাঁটতে হবে, হাঁটার সময় পায়ের মধ্যে ধুলা লাগানো যাবে না... আরো আরো যত সব কায়দা-কানুন আমার জন্য নির্ধারিত। কিন্তু সব কানুন কি আর আমাকে বাঁধতে পারে?

আমি যেমন আমার মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে যেথা ইচ্ছা সেথায় যেতে পারি না, ঠিক তেমনি আমার মায়ের করা কানুন সকলও পুরোটা আটকাতে পারে না আমাকে। আমি ঠিক-ই ফাঁকি-ঝুঁকির রাস্তা বের করে ফেলি।

বাড়ির চারদিকে টিনের বেড়া এবং টিনের গেট আটকানো থাকলেও বেড়া বেয়ে টুক করে চলে যাই বেড়ার ওই পাড়ে। গেট খুলি না কারণ গেট বন্ধ থাকলে আম্মি ভাববে আমি ঘরে আছি।

কিন্তু আমি তো ঘরে থাকবো না। থাকবো রোদে, মাঠে, নদীর পাড়ে, শ্মশ্মাণ ঘাটে, আলুর অফিসে (বিএডিসি হিমাগার অফিস), রাস্তায়, পড়াবাড়ির তেঁতুল তলায় এবং আরো কোথায় না কোথায়। তারপর আম্মি যখন হঠাৎ কোনো কারণে আমাকে ডাকবে, সোমা সোমা বলে অনেক্ষণ ডেকেও সাড়া পাবে না, তখন ঘরে গিয়ে দেখবে সোমা ঘরে নাই। সোমাকে ডেকে নিয়েছে দুপুর বা বিকেলের রোদ।

এই রোদ নিয়ে আমার পতি সুমনের সঙ্গেও মাঝে মাঝে ঈষদোষ্ণ বাক্যবিনিময় ঘটে। আমি রোদে বেরুতে চাই। আর সে রোদ দেখলেই বের হওয়া বন্ধ। সে বেরুবে রোদ ফুরালে, ছায়ায় ছায়ায়। মাঝে মাঝে তাকে আমি জবরদস্তি যে কিছু করি না তা নয়। এই কিছুদিন আগে রোদ দেখার জন্য দুপুরবেলায় তাকে ধরে নিয়ে গেলাম সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। সেখানে যেতে না যেতেই এক বালকের ক্রিকেট বল এসে লাগলো আমার পায়ে। তো, গলায় খুব শ্লেষ নিয়ে সুমন বললো: “নাও, রোদ দেখো।”

তার শ্লেষ এর উত্তরে আমি কিছু বললাম না। কারণ সে বার বার বলছিল: “চলো, আগে দুপুরের খাবারটা খেয়ে নাও (কারণ আমাদের ঘরে রান্না-বান্না নাই, খাবো রেস্টুরেন্টে। তার উপরে আমার স্বাস্থ্য বিষয়ক জটিলতা রয়েছে। ক্ষুধা বেশিক্ষণ চেপে রাখতে পারি না। ভমিটিং শুরু করে; শরীর কাঁপতে থাকে।)। তারপর রোদ দেখতে যাই।”

আমি বল্লাম: “না না, তাহলে তো রোদটা মরে যাবে। আমি কড়কড়া রোদ দেখতে চাই।”

তো, সেই কড়কড়া রোদ দেখতে এসে পায়ে একটা ক্রিকেট বল খেলাম। এখন আমার ব্যাথা পাওয়ায় সে তো ব্যথিত হয়েছেই, তার উপরে তার মা-না না শুনে ভরদুপুরে তাকে আমি বলতে গেলে ধরে এনেছি উদ্যানের কাঠফাঁটা রোদে, যেই রোদে সে দরদর করে ঘামছে— সেই সময় তার একটু শ্লেষ তো আসতেই পারে!

পায়ে বল খাওয়ায় একদুপুরে ওর মুক্তি মিলেছে ঠিক-ই। কিন্তু রোদের হাত থেকে তার সহসা মুক্তি মেলে না।

একদিন সুমনকে বলি: “শোনো, আমাদের ছেলের নাম আমি ঠিক করেছি।”

ও বলে: “কী নাম?”

আমি বলি: “রোদ।”

ও বলে: “আবার রোদ!”

আমি বলি: “হ্যাঁ, রোদ।”

ও বলে: “ছেলে আছে আসমানে আর তুমি তার নাম ঠিক করো কেমনে?”

তারপরক্ষণেই ও বলে: “তুমি শুধু ছেলের কথাই ভাবলা কেন? মেয়েও তো হইতে পারে।”

আমি বলি: “কেন ছেলের কথাই মাথায় আসলো জানি না; আসলো আরকি। আর বাস্তবে মেয়ে হলেও তার নাম হবে রোদ।”

এইবার সুমন বোধহয় একটু অসহায় বোধ করে। যাই হোক, সে অসহায় বোধ করুক, আমাদের কোনোদিনই ছেলেমেয়ে কিছু আসুক বা না-আসুক, তবু আমার কল্পিত ছেলের নাম রোদ।

আমার কবিতায়ও অসংখ্যবার অসংখ্যভাবে এসেছে রোদ। আমি যদি কিছু পূজা-টুজা করতাম তাহলে বোধ হয় সূর্য পূজারী হতাম বলে মনে হয়। সূর্য নামে একটা কবিতাও আছে আমার 'অন্ধঘড়ি' বইয়ে। বেশ দীর্ঘ সে কবিতা।

যখন জার্মানিতে গেলাম, তখন প্রথম একটা সপ্তাহে একবারের জন্যেও রোদের দেখা মেলে নি। এমন রোদের দেশ থেকে গিয়ে হঠাৎই এক্কেবারে রোদহীন হয়ে আমি তো পুরাই বিষণ্ন। পরে রোদ ওঠেছে। আমিও চনমনিয়ে ওঠেছি।

বৃষ্টিও সুন্দুর। তারও একটা অদ্ভুত ঘোর আছে। কিন্তু রোদের যে ঘোর, চরাচরকে রাঙিয়ে দিতে, প্রাণোচ্ছল করে দিতে রোদ ঠিক যেমন ভাবে পারে, তা কে পারে আর!

তাই, রোদ শুনলেই আমার চোখে এসে ভীড় করে মায়া। তাই, রোদের কথা ভাবলেই আমি দেখি ভরদুপুরে চরাচরকে এক ঘোরলাগা পরাবাস্তব করে দিয়ে আমার নানু বাড়ির পিছনের জঙলায় বসে ডাকছে ঘুঘু! তার ডাকে আমি পলে পলে খুন হয়ে যাচ্ছি। খুন হয়ে যাচ্ছি। খুন হয়ে বহুচেষ্টায় বেঁচে উঠছি স্বেচ্ছায় পূনরায় খুন হবো বলে। এই খুনের মধ্যে আহা, দুপুর! কী সুন্দর! কী সুন্দর রোদ, প্রাণ-সঞ্চারী।

মায়ের কাছে জেনেছি, আশ্বিনের সতেরো তারিখ সকাল দশটা নাগাদ যখন আমার জন্ম হয়, তখন জন্মের সময়টা রদ্রোজ্জ্বল ছিল। তবে, বিকেল থেকেই না-কি আকাশ ছিল মেঘলা আর রাতভর ছিল বৃষ্টি। কিন্তু আমার মৃত্যুর দিনে আমি খুব রোদ চাই। জগতকে মাতোয়ারা করে দেয়ার মতন ঝলমলে, উজ্জ্বল সুন্দর রোদ; রোদের প্রেমে পরে গভীর তৃপ্তিতে সানন্দে মরে যাবার মতন মোহাচ্ছন্ন রোদ।

সুন্দর সেই রোদের দিনে, কোনো এক নরোম ভোরে সূর্যের সোনালি আভায় চরাচর জেগে ওঠবে; শুধু আমি আর জাগবো না। কিন্তু তখনো দুপুরবেলায় ঘুঘু ডাকবে দূর গ্রামের গাছে গাছে; পুকুর পাড়ের বড়ই গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে রোদ পড়ে তখনো জলের মধ্যে চলবে আলোর খেলা; চাই-কি, সেই দিন সেই রোদে, নাগরিকদের বিষন্ন করে দিতেই গাছ-গাছালির পাতার আবডালে থেকে ধানমন্ডি লেকে হয়তো চকিতে ডেকে-ও উঠতে পারে একটি পথভোলা ঘুঘু।


২৬.০৮.১৩
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ সকাল ১০:২৬
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ও পদ্মশ্রী পুরস্কার

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৬



এ বছরের পদ্মশ্রী (ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা) পদকে ভূষিত করা হয়েছে, বাংলাদেশের রবীন্দ্র সংগীত এর কিংবদন্তি শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে।

আমরা গর্বিত বন্যাকে নিয়ে । ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×