আমি বড় হয়েছি গীতের ভেতর। এমন গীতল শৈশব কোটিতেও একজনের মেলে কি-না জানি না। সেই হিসেবে আমার ভাগ্য ভীষণ সুপ্রসন্ন আর আমি আশীর্বাদপুষ্ট মানুষই মনে হয়।
হ্যাঁ, আমি বেড়ে উঠেছি গীতের সুরের ভেতর। আমি যখন শিশু, জীবনের আধো-আধো স্মৃতি যখন থেকে সবে জমতে শুরু করেছে তখন থেকেই আমার স্মৃতিতে আছেন আমার বুড়িমা। বুড়িমা আমার মায়ের নানু অর্থাৎ আমার নানুর মা।
পাকা পেঁপের মতন টকটকে ছিল গায়ের রং। আর গলার স্বর! ওহ মাবুদ! সে কী রিনরিনে! যেনো বেদনা আর মধু দুইটাই একসাথে একাকার হয়ে ঝরে তার স্বরে। আমার চোখে স্পষ্ট ভাসে, বুড়িমা দুপুরের খাবারের জন্য বা রাতের খাবারের জন্য উঠানে মাটির চুলায় রান্না চাপিয়েছেন। বুড়িমা’র কাছ ঘেষে আমি। গীতের জন্য বায়না ধরে বসে আছি। হয়তো ঘ্যান ঘ্যান করছি। অথবা বুড়িমা হয়তো আমাকে নিয়ে শুয়েছেন চৌকিতে। আমি তার বুকের কাছ ঘেষে গীতের বায়না করছি।
চোখের সামনে স্পষ্ট ভাসে, রাঁধতে-রাঁধতে বুড়িমা গীত করছেন। চৌকিতে শুয়ে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করতে-করতে গীত করেছেন। গীত শুনতে-শুনতে আমি ডুবে গেছি অতল ঘুমে।
কতইনা কাহিনী ভরা সেইসব গীত! সুখের, দুঃখের, প্রেমের, বিচ্ছেদের! তখন তো আর এতো কিছু বুঝতাম না। শুধু সুরগুলোই লেগে থাকতো মনে। আনন্দের সুর। ব্যাথা ও বেদনার সুর।
মাঝে মাঝে হয়তো নির্দিষ্ট কোনো একটা গীতের জন্য বায়না ধরতাম। হয়তো বলতাম বুড়িমা, ‘গাঙ্গে দিয়া ভাইস্যা যায়’ গীতটা করেন। বুড়িমা করতেন। তার সুরের মায়া সেই শৈশবেই আমাকে চুরি করে নিয়ে গেছে অচিন দেশে।
সেই থেকেই আমি গীতের পাগল। এই সেদিনও, নানু মারা যাবার মাস কয়েক আগেও একবার বাড়ি গেলাম। নানু এলেন। নানুকে ধরলাম গীত গাইতে। বসে যাওয়া গলায় ব্রীড়া মাখানো সুরে নানু করলেন গীত।
আমি ছাড়া আর কেউ এমন গীত শুনতে চায়নি। কখনোই না। বাড়িতে যখন আমার ছোটোবেলায় খালামণিরা বেড়াতে আসতো, আমাকে নিয়ে খেলতো, আমি তাদের কাছে গীতের বায়না ধরতাম। এহসান খালামণি, বিলকিস খালামণি আমাকে গীত শোনাতো। যতক্ষণ না গীত শুনতে-শুনতে আমি ঘুমিয়ে যেতাম ততক্ষণ। বিশেষত, বিলকিস খালামণি গীত গাইতো খুব ভালো।
এই তো বছর দুয়েক আগে একবার আমাদের বাড়িতে আমার সব খালারা আসলো, নানু আসলো। সেইরাতেও আমার একই বায়না! খালামণি গীত করো। বিলকিস খালামণি, আলে খালামণি, এহসান খালামণি, আম্মি, নানু, নফিসা খালামণি— যে যার সাধ্য মতন গীত করলো। আমি মধ্যমণি। শুয়ে রইলাম এক খালামণির কোলে মাথা দিয়ে। সে আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে গীতে দিয়েছে টান। রাত দুইটা তিনটা পর্যন্ত চললো এমন। আমি সেই সব রেকর্ড করলাম। একটানা দুইঘন্টা রেকর্ড করলাম গীত। তারপর সেভ পাটন টিপ দিতে গিয়ে ভুলে আবার রেকর্ড পাটন চেপে দিয়েছি।
ঘটনার আকস্মিকতায় আমার ভীষণ মন খারাপ দেখে, চোখ ছলছল দেখে খালামণিরা আবার গীত করলো। মিনিট বিশেকের মতন রেকর্ড করলাম। কিন্তু আগের মতন হয়নি। তাল কেটে গেলে যা হয় তেমনি হয়েছিল। কিন্তু তবু, তাদের গীতগুলো ছিল তো! তারপর সেই ফোনটাও নষ্ট হয়ে গেলো। রেকর্ডগুলো সম্ভবত ট্রান্সফারও করা হয়নি।
আমার নানুবাড়ি লোকে গমগম করত সারাদিন। মামারা, খালারা, তাদের আত্মীয়েরা, নিকট প্রতিবেশীরা সব মিলে একটা হাট লেগে থাকতো ভোর-বিহান থেকে শুরু করে রাত পর্যন্ত।
সেই ভরা হাটে সন্ধ্যার পরে মাঝে-মধ্যেই বসতো কিচ্ছার আশর। কুদ্দুস নানা সুর করে-করে কিচ্ছা বলতেন। কিচ্ছা বলার সময় গল্পের ঘটনার সাথে তাল মিলিয়ে উনার স্বরে আসত রাগত বা প্রেমের বা হিংসার বা কুচক্রী ভাব। আর কিচ্ছা বর্ণনার সময় তিনি ঘটাতেন গান আর কথার একটা অপূর্ব মিশ্রন।
(কুদ্দুস নানা যদি তার এই গুণ ধরে রাখতেন তাহলে আজকের কুদ্দুস বয়াতীর চেয়ে কোনো অংশেই বেশি বই কম হতেন বলে মনে হয় না। কিন্তু তিনি তা ধরে রাখেননি। সেই কবে, কোন জীবনেই, ছেড়ে-ছুঁড়ে দিয়েছেন এইসব সুরের টান।)
সন্ধ্যার পরে, আমার নানা যখনো বাড়ি ফিরে নাই; নানা যখন হয় হাটে, নয় কিশোরগঞ্জ শহরের বাজারে বা অন্য কোথাও দূরে গেছে কাজে, বিশেষত, সেই সব সন্ধ্যায় নির্ভয়ে বসতো আশর।
পিতলের কুপি বাতি টিম টিম করে জ্বলতো ঘরের এক কোণে। ঘরের বাইরে থাকতো ভূতুড়ে ঘন অন্ধকার। আর আকাশ জুড়ে থাকতো লক্ষ কোটি অজস্র অগুন্তি তারা।
এইরকম মায়াবী সন্ধ্যায় সকলের অনুরোধে কুদ্দুস নানা হয়তো বসতো ঘরের ভেতর মাঝখানের খালি জায়গাটায় বা বারান্দায় বা বেশি গরমের দিনে উঠানে বড় একটা জলচৌকির উপর বা চেয়ারে। আর তাকে ঘিরে পাটির উপর, খাটের উপর চৌকির উপর, পিঁড়ির উপর, চটের উপর বসতো নানু, খালা, মামা, আম্মি, আশপাশের বাড়ির বাচ্চা-কাচ্চা, যুবক-যুবতী ও বুড়াবুড়ি প্রতিবেশী ও স্বজনেরা। আর আমি কারো কোলে বসে বা আধশোয়া হয়ে বা কারো কাঁধে হেলান দিয়ে বিস্ফারিত চোখে শুনতাম সেইসব মোহন কিচ্ছা সকল।
বন্দিনী অসূর্যস্পর্শা রাজকন্যার বিবরন দিতে গিয়ে কুদ্দুস নানা যেভাবে সুর ধরতেন, সেই সুরে আর তার বলার ধরণে আমার মনে হতো, এই তো রাজকন্যা! আমি তাকে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি মূর্তিমান। বন্দিনী রাজকন্যাকে উদ্ধার করতে যেতো রাজার কুমার। এক দরজা, দুই দরজা, তিন দরজা— এমন করে দরজার পর দরজা আর কক্ষের পর কক্ষের আড়াল ভেঙে সাত দরজা খুলে রাজার কুমার পৌঁছাতো সেই বন্দিনীর কাছে।
কিন্তু তার কাছে পৌঁছোনোর আগেই রাজার কুমারের চোখ সেই বন্দীনির রূপের ছটায় যেনো অন্ধ হওয়ার উপক্রম। কারণ দরজার পর দরজা যতই খোলা হয় ততই ভেতর থেকে ঠিকরে আসতে থাকে কিসের যেনো আলোকআভা। তারপর সাত দরজা খুলে ভেতরে যাবার পর রাজার কুমার দেখে, অপূর্ব সুন্দরী এক দুঃখিনী কন্যা বন্দি আছে কতইনা দিবস-রজনী ধরে! এই বর্ণনা আমি মরনকালেও ভুলব না! আহা! সে- সব মধুর রঙীন দিন! আমার নানুবাড়ি জুড়ে নাতি নাতনি বলতে তখন আর কেউ নেই। সবে ধন আমিই একা। আমিই মধ্যমণি!
জীবনে যদি কিছু ফেরত পাবার ঐশ্বরিক কোনো আশীর্বাদ আমি পাই, আমার ধারণা, আমি সেই গীতল মায়াবী সময়টাকেই ফেরত চাইবো। সেই মধুময় সময়! বানেছা পরীর মতন সুন্দর আমার নানু, আমার খালারা, মামারা, বাড়ি ভরা গাই-গরু, ধান, মাছ, পাখি, ফল, গাছ, মানুষ আর আনন্দ আর আনন্দময় সেই স্বর্গধাম।
সেই সময়ে গহর বাদশা আর বানেছা পরীর কিচ্ছার নাম আমার নানু, আমার খালারা আর আমার মায়ের মুখে কত যে অগুন্তিবার শুনেছি! কুদ্দুস নানার অত-শত কিচ্ছার ভেতরে গহর বাদশা আর বানেছা পরীর কিচ্ছাটাও নিশ্চয়ই ছিল!
কিন্তু আমার সেসব মনে নেই। আলাদা করে কোনো বিশেষ কাহিনী বা গল্পের কথা মনে নেই। বরং ছোটো ছোটো ঝিলিকের মতন আমার মনে আছে কোনো একটা কাহিনীর কোনো একটা ছোট বর্ণনা, কোনো একটা গীতের কোনো একটা বিশেষ বেদনার ধাৎ। তাই, গহর বাদশা বানেছা পরীর কথা আমার মনে নেই। কিন্তু কত যে হাজারবার আমি এই কাহিনীর নাম শুনেছি নানুর মুখে। শুনেছি তাদের মুখে, গহর বাদশাহ বানেছা পরী সিনেমার গল্প। শুনতে শুনতেই এই নাম কবে যে আমারো স্মৃতির অংশ হয়ে গেছে!
শিল্পকলায় এবার গঙ্গা-যমুনা নাট্যোৎসবের তালিকায় দেখলাম গহর বাদশা বানেছা পরী’র নাম। এই নাম দেখেই আমার মনে এসেছে আমার নানুর মুখ। গোলগাল মুখ। কাঁচা হলুদের মতন তার রং।
মঞ্চে নাট্যদলের কাজ কেমন হয়েছে, কী ছিল খুঁত, কেমন ছিল উপস্থাপন— সেইসব আজ এখানে নিক্তিতে মূল্যায়ন আমি করবো না। কারণ, এই নাটকের নাম ধরে আমি আসলে নিয়েছিলাম পিছু আমার শৈশবের; আমার স্বর্গধামের।
নাটক দেখতে দেখতে আমার কেবলি বারবার মনে হচ্ছিলো, আমার নানুর মুখ! আহা! মায়াবী মুখচ্ছবি! কেমন ফাঁকি দিয়ে চলে যায়! মনে পড়ছিল, এক ভরা বাড়ি কেমন খাক হয়ে গেলো! সামনে পেছেন থাকা জোড়াদিঘীওয়ালা বাড়ি কেমন হয়ে উঠলো প্রায় শ্রীহীন ভিটা! সোনার পিদীম কেমন চোখের সামনে নিভে গেলো ধীরে ধীরে, অচিন বাতাসে!
গহর বাদশা আর বানেছা পরীর পালা নামটা শুনলেই আমার নানুর চোখ চকচক করে উঠতো। নানু বেঁচে থাকলে নানুকে যদি এই পালা ঢাকায় হচ্ছে বলতাম, নানু নিশ্চয়ই খুব উচ্ছসিত হয়ে শুনতেন।
এই নাটক দেখতে-দেখতে আমার ভেতরে কান্না উৎলে উঠেছে। কেমন একটা বেদনা চিনচিন-চিনচিন করে উঠেছে বুকের ভেতর। বারবার মনে হয়েছে, আহারে! আমার বানেছা পরী তো আমার নানু! কী মায়াবী ছিল তার মুখখানি!
শুনেছি, নানুবাড়িতে একবার ডাকাত পড়েছিল। ডাকাত এসেই নানাকে হাত প্যাঁচিয়ে বেঁধে ফেলেছিল। আর নানু দূরে চাল-টাল রাখার মটকা আর টাইলের পেছনে লুকিয়েছিল। কিন্তু তার গায়ের রং এতই উজ্জ্বল ছিল যে সেই অন্ধকারেও একটা আবছা নড়াচড়া নাকি ডাকাতেরা দেখতে পাচ্ছিলো। তাই ডাকাতের হাতে ‘বেইজ্জতি’ হওয়ার ভয়ে বাঁশের বেতে দেওয়া ঘরের বেড়া ভেঙে পালিয়ে গিয়ে নানু উঠেছিল পাশেই থাকা তার আত্মীয় বাড়িতে। সেই আমার বানেছা পরী। যে পরী আজ মিলিয়ে গেছে অচিন দেশে।
এভাবেই হয়তো পরীরা মিলিয়ে যায়। এভাবেই হয়তো সেভ বাটনে চাপ দিয়ে গিয়ে ভুল করে হারিয়ে যায় জীবনের অমূল্য ধন। আর আমাদের হারিয়ে যাওয়া ঘিরে হয়তো আমৃত্যু আবহসঙ্গীতের মতন বাজে কোনো একটা রিনরিনে সুর। যেই সুরে একই সঙ্গে থাকে মধু আর বেদনার অদ্ভুত মায়াবী মিশেল।
১৩ই অক্টোবর ২০১৭
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই অক্টোবর, ২০১৭ রাত ১২:৪৪