আজ সকাল থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত তিনটা মৃত্যুর খবর পেলাম। আর গতকাল পেলাম আরেকটা খবর। কর্কট রোগের।
মনটা যেনো কেমন হয়ে আছে। ভোঁতা। আবার যেনো শান্তও। কী জানি, জানি না ঠিক। তবে কিছু একটা হয়েছে। যা আমাকে আরো আমার কাছে এনেছে, মনে হয়।
ইন্সপাইরেশনাল মুভ্যি দেখতে আমার ভালোলাগে। খুঁজে-খুঁজে বের করি। ইন্সপাইরেশনাল গল্প পড়তেও ভালোলাগে।
অনেক সময় আমি জোর করে, ধরে-ধরে অন্যকে গল্প শুনিয়ে দিই। ছাত্র-ছাত্রীদেরকে প্রচুর গল্প বলি। পড়া বোঝাতে গিয়েও গল্প বলি। বকা দিতে গিয়েও গল্প বলি। আমার পতির সাথে কথা কাটাকাটি লাগলেও বলি। ছোটো বোন যদি কোনো কারনে বিড়ালের মতন রোয়া ফুলিয়ে থাকে তাহলেও বলি। হয়তো বেহুদাই। তবু, শোনাই। কী জানি, হয়তো অন্যকে শোনানোর ছলে নিজেকেই শোনানো আরকি।
ছোটো ছোটো গল্পের ভেতর দিয়ে মানুষের চোখের সামনে একেকটা বড় সত্য এমন অবলীলায় চলে আসে যা হয়তো হাজার কথাতেও হয় না। এমনি মনে হয় আমার।
এরকমই একটা ছোট্ট গল্প পড়েছিলাম। ইংরেজিতে। সারবস্তুটা এরকম:
এক বাবা তার তরুণ ছেলেকে নিয়ে ট্রেনে করে যাচ্ছেন। সেই তরুণ জানালা দিয়ে যা কিছুই দেখছে তা দেখেই তার খুব উচ্ছাস। খুঁটি-নাটি-তুচ্ছ-সামান্য-তুচ্ছাতিতুচ্ছ যাই দেখে না কেন সব কিছুতেই সে মুগ্ধ। মুগ্ধতায়, সোল্লাসে সে থেকে-থেকেই চিৎকার করে উঠছে। খুব উৎসাহ আর উত্তেজনা নিয়ে বাবাকে সে তার আনন্দের কথা জানাচ্ছে বারবার। এইসব দেখে অন্যকারোর মনে হতে পারে, আদেখলাপনা। মনে হতে পারে, বেকুবি।
ট্রেনের জানালা দিয়ে কী করে একটা গাছ দ্রুত গতিতে পেছনে চলে যায়, চলিষ্ণু মেঘ কত সুন্দর ইত্যকার মামুলি বিষয় নিয়ে সেই তরুণ আনন্দে লাফাচ্ছিল।
একই কামরায় ছিলেন আরেক দম্পতি। বুড়ো ছেলের এমন ছেলেমি দেখে মহিলা খুব বিরক্ত হলেন। বিরক্তি চেপে রাখতে-রাখতে একসময় তিনি অধৈর্যও হলেন। পরে ভাবলেন, এই ছেলে নিশ্চয়ই উন্মাদ বা ছিটগ্রস্থ।
কিন্তু লোকে কী ভাবছে সেই দিকে এই যুবকের কোনো খেয়ালই নেই। সে উৎসাহ ও আনন্দে মশগুল।
এক পর্যায়ে ভদ্রমহিলা ছেলেটির বাবাকে মৃদু গলায় বলেই বসলেন, আহা! আপনার ছেলেটিকে তো হাসপাতালে নেয়া উচিত। ওর ভালো ডাক্তার দেখানো দরকার। ভালো চিকিৎসা পেলে নিশ্চয়ই ও সেরে ওঠবে।
উত্তরে বাবা বললেন, হ্যাঁ। ওকে ডাক্তারখানা থেকেই এনেছি। ভালো চিকিৎসা শেষে সুস্থ্য হয়ে আজই ও হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে বাড়িতে যাচ্ছে।
তিনি সাথে আবার এটিও যোগ করলেন যে, আমার ছেলেটি অন্ধ ছিল। বহু দিনের চেষ্টা ও চিকিৎসা শেষে ওর অপারেশন হয়েছে। দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবার পর এই প্রথম সে ট্রেনে চেপেছে। যা কিছু দেখছে নিজের চোখে সবই আজ তার প্রথম দেখা। তাই, সে শিশুর মতন হুল্লোড় করছে।
সহজেই অন্যকে আমরা নিক্তিতে তুলে নিই। নিজের পছন্দ-অপছন্দ ইচ্ছে-অনিচ্ছের মাপে অন্যকে মাপতে থাকি। মাপামাপির মধ্যেই অন্যের সম্পর্কে একটা ধারণায়, একটা বিচারে, একটা সিদ্ধান্ধে নিজের মনে পৌঁছে যাই।
সবসময় যে সেই বিচার ও সিদ্ধান্ত নিরীহ ও নির্বিরোধী হয়, এমন নয়। নিজের বিচারকে অব্যার্থ ভেবে আমরা নিজের মতকে অন্যের মাঝেও ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করি।
নিজের টক্সিক আচরণ, কথাবার্তাগুলোকে আলগোছে ঢেলে দিই অন্যের মনে। অন্যের জীবন, অনুভূতি, বোধ, বুদ্ধি, সংগ্রাম, লুকানো বিষাদ সম্পর্কে আমরা নির্বিকার। আমরা বুঁদ হয়ে থাকি ‘আমি’ বোধের ভেতর।
বহু বছর আগের কথা। আমার এক নিকটজন ক্যাডেট কলেজে পড়তেন। তখন তার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা চলছে। সেদিন তিনি শেভ করে যাননি। তাই দেখে তার কলেজের প্রিন্সিপাল তাকে আর তার আরেক বন্ধুকে পরীক্ষার হল থেকে তুলে হাউজে ফেরত পাঠিয়েছিলেন শেভ করে আসার জন্য। ওই অবস্থায় আমি হলে কী করতাম, আমার নার্ভে কুলোতো কিনা জানি না। তবে, তাড়া খাওয়া হরিণ শাবকের মতন সেই দু’জন হাউজে গিয়ে শেভ করে এসে আবার পরীক্ষা দিতে বসেছিলেন।
কেন প্রিন্সিপাল এমন করেছিলেন? কারণ তার ধারণা হয়েছিল যে, এরা দুষ্টু ছেলে। তিনি ভেবেছিলেন, যেহেতু এরা দুষ্টুছেলে তাই স্ট্যান্ড করা বা স্টার-টার পাওয়া এদের দ্বারা হবে না। পরে অবশ্য সেই শিক্ষকের ভুল ভেঙেছিল। কিন্তু ধুকপুক বুক নিয়ে দৌড়ে যাওয়া সেই দুই যুবকের স্মৃতিতে ব্যাথাটা হয়তো আজো বাজে।
হাইস্কুলে পড়ার সময় আমি খুব খারাপ ছাত্রী ছিলাম। এখনো যে খুব উৎরে গেছি এমন নয়। তবে, ক্লাশ সিক্সে ও সেভেনে পরপর দু’বছরই ফেল করে দুই বছরের জায়গায় চার বছর দুই ক্লাশে পড়েছি।
এছাড়া, স্কুলের খাতার পেছনের দিকের পাতাগুলোতে বাংলা সিনেমার পছন্দের গানগুলো লিখে রাখতাম। ক্লাশ নাইনে পড়ার সময় আমার এক খুব কাছের বন্ধু একবার তার বাসায় আমার খাতাটা কী একটা কাজে যেনো নিয়ে গিয়েছিল। খাতায় বাংলা সিনেমার গান লেখা দেখে আমার বন্ধুর মা তাকে আমার সাথে মিশতে বারন করেছিলেন। বন্ধু অবশ্য মায়ের কথা শোনেনি।
খারাপ ছাত্রী ছিলাম। বিশেষ খারাপ আর বিশেষ ভালো স্টুডেন্টদেরকে স্যার-ম্যাডামরা আলাদা ভাবেই চিনতেন। ক্লাশ এইটে পড়ার সময় সাধারণ জ্ঞানের একটা কুইজ কম্পিটিশান হচ্ছিলো। আমি টিচার্স রুমে ফরম আনতে গিয়েছিলাম। তখন আমার এক টিচার বলেছিলেন, পড়ালেখা কিছু পারো না আবার কুইজের ফরম নিতে আসছো!
আমরা এমন করি। হয়তো বুঝে। হয়তো না বুঝে।
আমিও হয়তো বুঝে ও না বুঝেই বহু বার বহুজনের মুখ কালো করে দেবার কারন হয়েছি। এসব মনে হলো আজো অনুতাপ হয়।
তবে হ্যাঁ, ক্রমে-ক্রমে আমি শেখার চেষ্টা করেছি কী করে কখনোই অন্যের মুখ কালো করে দিতে না হয়। শেখার চেষ্টা করেছি, ভুল হয়ে গেলে শোধরানোর চেষ্টায় দোষ নেই। শেখার চেষ্টা করেছি, শোধরানোর সুযোগ না থাকলে অন্তত অনুতাপে, প্রায়শ্চিত্যে কী করে নিজের অপরাধকে স্বীকার করতে হয়।
চেষ্টা করি, আমার সাথে অন্যের ভুলেও কোনো কথা কাটাকাটি হলে নিজে মাফ চেয়ে নিতে। না হলে মন খচখচ করে। করে। আমি এটা নিয়ন্ত্রন করতে পারি না। তাই, অন্যের ভুলেও আমি সরি বলি। রিকশাওয়ালাকেও। সিএনজিওয়ালাকেও। বেশি ভোগান্তি দেয়ার কারনে ঝারি মারার পর ডেকে নিয়ে পাশে বসিয়ে অন্য কথার ছলে স্টুডেন্টকেও সরি বলি। লোকে হয়তো আমাকে বেকুব ভাবে। ভাবুক।
সরি বলা রপ্ত করতে হয়। দিনে-দিনে তা আয়ত্বে আসে।
কারো সাথে কলহ-বিবাদ জিইয়ে রাখলে আমার কষ্ট হয়। খারাপ লাগে। মন খচখচ করে। আর মনে হয়, আজই তো হতে পারে আমার জীবনের শেষ দিন! কী দরকার অহেতুক কারো মনে কষ্ট দেওয়া!
কিন্তু এরপরেও হয় না। সবসময় শান্ত মেজাজে থাকা হয় না। সবসময় হৃদয় বুঝ মেনে চলে না।
এই তো গত কিছু দিন আগেই বারিধারায় একটা অনুষ্ঠান ছিল। সেখানে যেতে উবার ডেকেছিলাম। রাস্তায় বিশেষ জ্যাম-ট্যাম ছিল না। বরং ফাঁকাই বলা যায়। যে সময় হিসেব করে বেরিয়েছিলাম তার আগে পৌঁছে যাবার কথা ছিল।
আমি মোবাইলে গুঁতোগুঁতি করছিলাম। হাতিরঝিলে হঠাৎ দেখি গাড়িটা থেমে গেছে। কী ব্যাপার জিজ্ঞেস করায় চালক জানালেন পথ ভুল হয়ে গেছে। উনি ব্যাস্ত রাস্তায় ব্যাক-গিয়ারে পেছনে যেতে দুই-একবার চেষ্টা করে পারলেন না।
কিছু দূর গিয়ে আবার পুলিশ প্লাজার সামনে দিয়ে ত্যাছড়াভাবে যাবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু গার্ড তাকে যেতে দিল না। তিনি বিরক্তি প্রকাশ করলেন। আমিও কিঞ্চিত অসহিষ্ণু গলায় বললাম, আপনি কি রাস্তাটা ঠিক মতন চেনেন? উনি চেনেন বললেন। আমি বললাম, তাহলে আর অহেতুক ঘোরাঘুরি করবেন না। সোজা রাস্তায় যান।
উবারের চালকেরা যাত্রীদেরকে অহেতুক ঘোরান্টির মধ্যে ফেলে। এই অভিযোগ ঢাকায় নুতন না। সোজা রাস্তা রেখে তারা ঘুরপথ ধরে যায়। যত বেশি পথ, যত বেশি জ্যামে আটকানো তত বেশি ভাড়া। তাই, উনার পথ ভুল করাটাকে আমি শুরুতেই নিরপরাধ পথ-ভুল হিসেবে ভাবিনি। উনার ভুলটাকে আমি সন্দেহ করেছিলাম।
পুলিশ প্লাজা দিয়ে যেতে না পেরে উনি সোজা কিছু দূর গিয়ে আবার হাতিরঝিল থেকে বায়ে একমুখী রাস্তায় উল্টো দিকে যাবার প্রয়াস নিলেন। আমি তৎক্ষনাৎ চেঁচিয়ে উঠলাম! আরে! আরে! করেন কী! উল্টো দিকে যাচ্ছেন কেন!
ততক্ষণে আমিও অধৈর্য্য হয়েছি। মনে স্থির বিশ্বাস জন্মেছে, এই লোক আমাকে ঘোরাচ্ছে। তাই, না চাইতেও খেঁকিয়েই উঠেছি আসলে। আমার খেঁকানি শুনে উনি উল্টো দিকে না গিয়ে সোজা গেলেন। কিন্তু গিয়ে ঢুকলেন মেরুল বাড্ডার দিকের রাস্তায়। এইবার আমি ক্ষেপেই গেলাম। কারন এই রাস্তা ভাঙা। সারা ঢাকা ফকফকা থাকলেও এই পথে কিছু না কিছু জ্যাম হবেই। যেই ভাবা সেই কাজ। জ্যামে পড়লাম।
৩৫/৪০ মিনিটের রাস্তা দুই ঘন্টা লাগবে ভেবে মেজাজ খিচড়ে গেলো। শেষ দিকে উনি বারিধারার ভেতর গিয়ে এলোমেলো ঘুরতে লাগলেন। রাস্তা চিন্তে পারছিলেন না। অবশেষে আমাকে বললেন, ম্যাডাম, জানালাটা খুলে একটু কাউরে জিজ্ঞেস করেন না আপনার ঠিকানাটা কোন দিকে।
আমি রেগে ছিলাম। তাই তাকে এইটুকু সহযোগিতাও করিনি। উল্টো বলেছি, আপনি জিজ্ঞেস করেন। আরো দেরি হয়, হোক। আমার সমস্যা নাই। রাত ১২টা বাজলেও আমার সমস্যা নাই।
আর মনে-মনে ভাবছিলাম যে, আজকে উবারে কম্প্লেইন করবো। করবোই। এই লোককে মায়া দেখানো যাবেই না। এরা টাকার জন্য মানুষকে ভোগায়। কয়টা মাত্র বাড়তি ভাড়ার জন্য আমার দুই ঘন্টা সময় খেয়ে দিলো!
এসব করে দুই ঘন্টা লাগিয়ে গন্তব্যে যখন পৌঁছালাম চালক দেখি আগে থেকেই ব্যাকফুটে। উনি বললেন, ম্যাডাম, বাড়তি যেই ভাড়াটা আসছে আপনি সেইটা দিয়েন না।
আমিও বললাম, হ্যাঁ। দেবো তো না-ই। আপনার নামে কম্প্লেইনও করবো।
কিন্তু বাড়তি টাকাটা না দিয়ে নামার পরপরই আমার খুব তীব্র অপরাধ বোধ হলো। মনে হলো, আমি তো এমন কখনো করি না! ছি! এটা করা ঠিক হয়নি। তাকে বাড়তি ভাড়াটা আমার দেয়া দরকার ছিল। এইসব ভাবলাম। তার নামে আমি কোনো কম্প্লেইনও করলাম না।
এরপরও অনুষ্ঠানে থাকার সময় থেকে-থেকে বারবারই ঘটনাটা মনে পড়ছিলো আর মনটা খচখচ করছিলো। ভাবলাম, বাসায় গিয়ে উনাকে টাকাটা ফ্লেক্সি বা বিকাশ করে পাঠিয়ে দেবো।
ফেরার সময় আবার উবার। এবার উঠার সময় চালককে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি রাস্তা চেনেন কিনা। চেনেন। তার সাথে সন্ধ্যার ব্যাপারটা শেয়ার করলাম। উনি বললেন, ম্যাডাম আসলে মাঝে মাঝে এমন হয় যে, গাড়ি চালাতে-চালাতে মাথাটাই জ্যাম হয়ে যায়। এমনকি আমার নিজেরই এমন হয়েছে যে, আমার চোখ ঘোলা হয়ে গেছে আর প্রতিদিনের চেনা রাস্তাটাকেও তখন অচেনা মনে হয়।
যিনি এই কথাগুলো বলছিলেন তিনি উবারের অন্যতম টপ রেটেড ড্রাইভার। তার নামে অদ্ভুত সব ভালো ভালো কমেন্ট করেছেন তার রাইডাররা। ভদ্রলোকের কথা শোনে আমার তীব্র খারাপ লাগলো। ভীষণ অপরাধবোধ হলো। সেসময় আয়না থাকলে হয়তো নিজের চোখে তাকাতে পারতাম না।
আমার খালি মনে হচ্ছিলো, আহারে! সেই লোকটা যদি আমাকে ইচ্ছে করে ঘুরিয়ে থাকে তো সেটার দায় তার। কিন্তু সত্যি যদি তার কোনো কারণে মন খারাপ থেকে থাকে বা তার যদি পরিবারে কোনো বিপর্যয় হয়ে থাকে! আমি তো তার কিছুই জানি না। অহেতুক তাকে সন্দেহ করলাম। কড়া কথা শোনালাম। না হয় গেছে আমার দুই ঘন্টা। কিন্তু আমি তো তার বাস্তবতাটা জানি না।
তীব্র অপরাধবোধে আক্রান্ত হয়ে তাকে তক্ষুণি ফোন করলাম। বাসায় যাওয়া পর্যন্ত আর অপেক্ষা করলাম না।
প্রথমবার ফোন বেজে গেছে। উনাকে পাইনি। কিছুক্ষণ পরে আবার ট্রাই করলাম। এবার ধরলেন। আমি পরিচয় দিতেই উনি খুব অবাক হয়ে বললেন, ওহ আপা! আপনি!
আমি তাকে ‘ভাই, সরি’ বলে কথা শুরু করলাম। উনার সাথে অনেক্ষণ কথা হলো।
‘সরি’ শোনার পর উনার গলাটা এতো কাতর হয়ে গেলো! মানুষ বোধ হয় মানুষের কাছেই ভেঙে পড়ে এমন প্রতিরোধহীন। চেনা-অচেনায় এতে কিছু এসে যায় না। প্রয়োজন কেবল মোক্ষম মুহূর্তটা।
জানলাম, উনি উবারে নতুন। নিজের গাড়ি। আমি তার ৫ বা ৬ নম্বর রাইড। তার পরিবারে কিছু একটা বিপর্যয় ঘটেছে। তাই উনি উবারে এসেছে। উনি আসলেই রাস্তা-ঘাট সব চেনেন। আর উনি ইচ্ছে করে আমাকে ঘোরাননি। উনি বোঝেননি যে উনি আনমনা ছিলেন। তাই, প্রথমবার রাস্তাটা ভুল হয়ে গিয়েছিল। তারপর পুলিশ প্লাজার এখান দিয়ে কোণাকোণি গিয়ে উনি রাস্তাটা কাভার করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু গার্ডটা কোনো কারনে উনাকে যেতে দিলো না। তারপর যে কী হলো! উনার খালি একটার পর একটা ভুল হতে থাকলো। রাস্তাও কেমন গুলিয়ে গেলো। আমিও খুব রেগে ছিলাম। সব মিলিয়ে উনি খুব নার্ভাস হয়ে গিয়েছিলেন।
তার ফোন নাম্বারটা বিকাশ করা কিনা জানতে চাইলাম। তার ফোন বিকাশ করা না। আমি তাকে ফ্লেক্সি করবো বলার পর উনি আমার হাতে-পায়ে ধরা শুরু করেছেন। না। কিছুতেই উনি আমার কাছ থেকে ভাড়ার বাড়তি টাকাটা নেবেন না। রাগে না। দুঃখে না। অভিমানে না। অদ্ভুত অনুভূতিতে।
মানুষ এক আজীব প্রাণী।
উনি বলেছেন, আপা, আপনার কথায় আমার মনটা খুব খারাপ হইছিল। আপনি মনে করছিলেন, আমি আপনাকে ইচ্ছে করে ঘুরাইছি। আপনি আমাকে আর সবার মতন মনে করছিলেন। কিন্তু আমি তো আপনারে ইচ্ছে করে কষ্ট দিই নাই। আমি আসলেই ভুল করছিলাম। কিন্তু, আপনি আমাকে বিশ্বাস না করায় আমার খুব আঘাত লাগছিল! আপনার খারাপ ব্যাবহারে কষ্ট পাইছিলাম।
তবে, আমি ফোন করায়, তাকে সরি বলায় তার দুঃখ দূর হয়ে গেছে। মন খারাপটাও আর নাই। তাই, তার অনুরোধ আমি যেনো তাকে বাড়তি টাকাটা না দেই।
তিনি বলার চেষ্টা করলেন যে, তার ভুলের কারণেই আমার এতোটা সময় নষ্ট হলো। এতো দেরি হলো। তাই, আমার থেকে বাড়তি টাকাটা তিনি নিতে চান না।
উনি বলছিলেন, “মনে করেন, আমি আপনার ভাই। ভাই হলে কি আর আপনি আপনার ভাইরে বাড়তি টাকাটা দিতেন”!
এই কথা শুনে আমার এতো মায়া লাগলো! ইশ! সব মানুষের ভেতরেই বোধ হয় একটা কাতর মানুষ লুকিয়ে থাকে। কিন্তু মানুষের কাছ থেকে কাঁটার গুঁতো খাবার ভয়ে সেই কাতর মানুষটা গুঁটি-শুটি মেরে আড়ালে পরে থাকে। তবে, সুযোগ পেলে সে ঠিকই কেঁদে ভারমুক্ত হতে চায়।
আলাপের শেষে পরস্পরের কল্যাণ কামনা করে ফোন রাখলাম। তারপর, তার যে বাড়তি ভাড়া হয়েছিল সেটার ডাবল পরিমান টাকা আমার বিকাশ থেকে তাকে ফ্লেক্সি করে দিলাম। দিয়ে মনে হলো, খানিক স্বস্তি পেলাম।
লেখা শুরু করেছিলাম তিনটা মৃত্যুর খবর দিয়ে। হ্যাঁ, তিনটা মৃত্যু আর একটা কর্কট রোগের খবর।
যারা মারা গেছেন তারা আমার কেউ নন। তারা আমার কলিগদের আত্মীয়, স্বজন, প্রাণের মানুষ। ঈদ পরবর্তী প্রথম দিনের অফিসে নিজে থেকেই কুশল বিনিময় করতে গিয়ে তাদের এই খবরগুলো জানলাম। আমি এগিয়ে না গেলে হয়তো জানাও হতো না এই খবরগুলো। জানাও হতো না তাদের মনের দশা। হয়তো তাদের অতিরিক্ত চুপচাপ আচরণ কোনো এক মুহূর্তে আমার কাছে শীতল ঠেকলেও ঠেকতে পারতো।
আর কর্কট রোগের খবরটা! আহা! একেবারে ভীত নাড়িয়ে দিয়েছে আমার! গতকাল আমার এক পরিচিতের কর্কট রোগের খবরটা জানার পর তার হাসিমাখা উচ্ছল মুখটা ফেসবুকে দেখে আবার তীব্রভাবে বোধ হলো যে, আমরা বুঁদ হয়ে থাকি নিজের খোঁড়লের ভেতর। তাই, বুঝতেও পারি না যে, অন্যের হাসির আড়ালে চিকচিক করে দুঃখের জল। বরং কেন তার হাসিটা বেশি উচ্চকিত, কেন তার হাসিটা পরিমিত নয় তাই নিয়ে আমরা সমালোচনায় মজি বা মুখ ফুটে সমালোচনা না করলেও মনে-মনে নিজের নিক্তিতে মেপে আরেকজনকে বসিয়ে দিই অপেক্ষাকৃত নীচু আসনে।
একজন আরেকজনের বাস্তবতার সামান্যতম খবর না নেয়ার কারনেই বোধ হয় এতো কলহ, বিবাদ; এতো অশান্তি এতো মনোপীড়া চারদিকে।
ওভারিয়ান ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ইনি বেশ ক’বছর ধরে লড়ছিলেন। একের পর এক ক্যামো সহ্য করছিলেন। অথচ তার চারপাশের মানুষদের, সহকর্মীদের কিছুই বুঝতে দেননি। আমরা সবাই দেখতাম উনি খুব উচ্চকিত করে হাসেন। উনি খুব দারুণ প্রাণোচ্ছল। উনি খুব ভিগোরাস। উনি ফ্রেশ রুমে বেসিনে হাত ধুতে গেলে বা ফ্রেশ হতে গেলে খুব উঁচু গলায় গান করেন। উনার গানে অন্যরা কী ভাবলো তার পরোয়া করেন না।
কিন্তু আমরা কেউ বুঝতেও পারিনি যে, এই সরব গানের ভেতর দিয়ে উনি হয়তো নিজেকেই আরো প্রাণশক্তি ঢেলে দিতে চাইছেন। বরং উল্টো হয়তো এমনো হতে পারে যে, এই মানুষটার আচরণের মধ্যেও আমরা কেউ হয়তো খুঁজে পেয়েছিলাম কোনো ‘খাপছাড়া’ আচরণ! আর সেগুলোকে হয়তো নিজের নিক্তিতে তুলে মেপেও ছিলাম।
কর্কট রোগে আক্রান্ত সেই পরিচিত মানুষটি তার অসুখের কথা আর গোপন রাখতে পারেননি। প্রায় কোটি খানেক টাকা খরচ হয়ে যাবার পর এখন আর চিকিৎসা করানো যাচ্ছে না। তাই, এই সুন্দর পৃথিবীতে বাঁচতে চাওয়ার আকুতি জানিয়ে তিনি সকলের কাছে অর্থ সহায়তা চেয়েছেন।
“জীবন এতো ছোটো কেনে” বলে তারাশংকর আক্ষেপ করেছিলেন। যে জেনে গেছে যে তার হাতে আছে একটা স্টপওয়াচ, তার সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে, সে হয়তো তার প্রতিটা মুহূর্তকে কানায় কানায় পূর্ণ করে নিতে চায়। সে হয়তো প্রতিটি চুমুকেই উদগ্রীব হয়ে আকণ্ঠ পান করে নিতে চায় এই ছোটো জীবনের সবটুকু সুধা। সে হয়তো পলকে-পলকে পৃথিবী থেকে লুফে নিতে চায় আনন্দ।
যে জেনে গেছে তার কর্কট বা এমনই এক দূরারোগ্য ব্যাধি আছে কেবল সেই হয়তো বলতে পারবে জীবন আর মৃত্যুর মাঝখানে ধূসর জমিনে থাকার অনুভূতিটা কেমন।
এমন ধূসর জমিনে থেকে যে মানুষটি কাউকে কিছু না জানিয়ে মৃত্যুর সাথে প্রতিনিয়ত একা-একা লড়েছেন, কী অমিত শক্তিশালী তিনি! কী অসম তার সাহস! কী অনন্য তার সহ্য ক্ষমতা! তিনি সব একা সয়েছেন। একা বয়েছেন! কাউকে বুঝতে পর্যন্ত দেননি তার ব্যাথা! আর আমাদেরই মধ্যে, কি জানি, হয়তো কেউ ব্যাস্ত থেকেছি নিক্তি নিয়ে!
জীবন একটা ভঙ্গুর বস্তু। ভীষণ ভঙ্গুর। আজ আমার সহকর্মীদের মধ্য থেকে পরপর তিনটা মৃত্যুর খবর পেয়ে এই কথাই আমার আরেকবার আরো তীব্রভাবে মনে এলো।
মনে এলো, আমাদের সবার হাতেই আছে একটা করে স্টপওয়াচ। কর্কট বা এমন কোনো দূরারোগ্য ব্যাধি যাদের হয়েছে তারাই কেবল এই স্টপ ওয়াচটাকে দেখতে পান। অন্যকে হয়তো ক্ষমা করে দেন। অন্যকে নিক্তিতে তুলে হয়তো তারা মাপেন না।
আর রোগাক্রান্ত না হয়েও এই স্টপওয়াচটিকে আরো কিছু মানুষ দেখতে পান। আমি মনে করি, তাদের থাকে সূফীর হৃদয়।
আমার বাবার মৃত্যুর ঘটনায় আমি প্রথম স্টপওয়াচটিকে টের পেয়েছিলাম। কিন্তু দিব্যি করেই বলছি, আমার হৃদয় এখনো ক্লেদে ভরা। এখনো আমি রেগে গেলে ফোঁস করে ফণা তুলি। তারপর যদিওবা সেই ফণা নেমে যায়। যদিওবা আমি ক্ষমা চাই। যদিওবা হেরে যেতে আমার কোনো লজ্জা বোধ হয় না। তবে আমি জানি, আনত হৃদয় আজো আমার হয়নি আর সূফীর হৃদয় তো কোন দূর কী বাৎ।
আমরা যারা প্রতিযোগিতা আর প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মগ্ন জীবন কাটাই আমাদের কাছে জীবন একটা রেসের ঘোড়া। তার পিঠে চাবুক মেরে মেরে আমরা কোথায় পৌছুঁতে চাই তা হয়তো আমরা নিজেরাও জানি না।
তবে হ্যাঁ, এইটুকু সত্য এখন আমি মানি যে, প্রতিটি দিন আলাদা। প্রতিটি ঘটনা আলাদা। প্রতিটি মানুষ আলাদা। তাই, মানুষকে বিশ্বাস করে আমি ঠকতে রাজি। কিন্তু মানুষকে অবিশ্বাস করে আমি জিততেও রাজি নই।
আমার মনে হয়, জীবন হচ্ছে শহিদুল জহীরের সেই চিঠির গল্পের মতন।
শহীদুল জহিরের 'সেই রাতে পূর্ণিমা ছিল' উপন্যাসের এক নারী চরিত্র তার ভালোবাসার মানুষকে উদ্দেশ্য করে চিঠি দেয়। চিঠি না বলে একে অবশ্য চিরকুট বলাই ভালো। এক লাইনের চিঠি।
একে একে ১৬ বা ১৭টা চিঠি সেই নারী পাঠিয়েছিল প্রেমিকের কাছে। সঠিক সংখ্যাটা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। প্রেমিক পুরুষটি চিঠি খুলে-খুলে একটাই বাক্য পেয়েছেন। “তুমি কিছু কও না কেন”? “তুমি কিছু কও না কেন”? “তুমি কিছু কও না কেন”?
১৬ বা ১৭টা চিঠি। একটিই বাক্য। তারপর আরেকটি চিঠি এলো। ১৭ বা ১৮ নম্বর চিঠি। এই ছিল শেষ চিঠি। একই কথা লেখা আছে ভেবে এই চিঠি আর প্রেমিকের পড়া হয়নি।
তারপর একদিন সেই মেয়েটির মৃত্যুর খবর এলো। মৃত্যুর খবর পাবার পর পুরুষটি তার তোরঙ্গ খুলে শেষ চিঠিটি খুলে দেখে এতে লেখা, “তুমি আমারে বিয়া করবা”?
জীবন এরকম। ১৭টা চিঠিতে একই বাক্য লেখা থাকলেও ১৮তম চিঠিতে ভিন্ন কিছু থাকতে পারে।
এই কথাটাই দারুণভাবে একবাক্যে এক ডায়লগে বলা হয়েছে ‘ফরেস্ট গাম্প’ সিনেমায়। ফরেস্টকে তার মা বলেছিলেন, “লাইফ ইজ লাইক অ্যা বক্স অফ চকোলেট। ইউ নেভার নো হোয়াট ইউ আর গনা গেট”। [Life is like a box of chocolates. You never know what you're gonna get.]
তাই, প্রতিটি চিঠিই নতুন চিঠি। প্রতিটি মানুষই নতুন মানুষ। প্রতিটি ঘটনাই নতুন ঘটনা। এমনকি একই মানুষের প্রতিটি দিনই আলাদা-আলাদা নতুন দিন। প্রতিটি দিনই সদ্য আসা, মুখ না খোলা নতুন চিঠির খাম।
২৬ অগাস্ট ২০১৮
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে আগস্ট, ২০১৮ রাত ১২:৫৭