বনজীবীদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না- পর্ব এক
গত বছর যখন আমি কয়রা এসেছিলাম তখনকার তুলনায় এবার এখানকার অবস্থা বেশ ভাল মনে হচ্ছে। অবস্থা বলতে আমি আসলে কৃষির কথা বলছি। আইলার কারনে এই অঞ্চলের কৃষি জমিতে প্রচুর লবন চলে আসে সে সময়। আর যার ফলাফল হল, হাজার হাজার বিঘা কৃষি জমিতে আবাদ বন্ধ হয়ে যাওয়া। আর আবাদ বন্ধ হওয়ায়, এলাকার বিশাল একটা জনগোষ্ঠী কর্মহীন হয়ে পড়ে। এই এলাকার সব মানুষই যে বনজীবী বিষয়টা তেমন ছিল না। কিছু মানুষ ছিল কৃষি দিনমজুর, আবার বেশির ভাগ বনজীবীই যে সময় জঙ্গলে যেত না, সেই সময় তারা অন্যের জমিতে কাজ করত। তো কৃষি কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারনে বিশাল একটা জনগোষ্ঠী কর্মহীন হয়ে পরে। আর এর ফলাফল হল অভাব আর অভাব। মানুষজন নিকটবর্তী শহর গুলোতে এমনকি বেনাপোল হয়ে দালাল ধরে ভারতে পর্যন্ত সিজনাল মাইগ্রেশন শুরু করে। আইলার পরপর সময়ে এই অঞ্চলে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে মধ্যবিত্ত শ্রেনী। কারন এই সময় সরকারী, বেসরকারী, এন জি ও থেকে প্রচুর সাহাজ্য এসেছে। কিন্তু এই শ্রেনীর লোকজন নিজেদের আত্ম মর্যাদার কারনে রিলিফের লাইনে গিয়ে দাড়াতে পারেনি আর তার সাথে শেষ সম্বল বিঘা কয়েক জমি নষ্ট হয়ে যাওয়া তো থাকছেই। প্রভাবশালীরা রিলিফ আত্মসাৎ করেছে আর দরিদ্ররা রিলিফ খেয়েছে। কিন্তু ফাপরে পরেছিল এই মধ্যবিত্ত শ্রেনী। এই অঞ্চলের নারীরা আইলার আগে ছিল খুব বেশি পর্দাশীল। একজন নারী ঘরের বাইরে গিয়ে কাজ করবে এটা কখনো কেউ মেনে নিতে পারতো না। আর নারীরাও মনে করত আসলে এমনই হয়। নারীদেরকে ঘরেই কাজ করতে হবে। একটা নারীর জন্য ঘর- সংসার ই সব। কিন্তু এক আইলায় তাদের সব ধরনের ধ্যান- ধারনা পরিবর্তন করে দেয়। আইলা পরবর্তী সময়ে, ডেভেলপমেন্ট অরগানাইজেশন গুলো এসে রিলিফ কিংবা কাজ দেয়া শুরু করে নারীদেরকে টার্গেট করে। আর নারীরাও এই সকল অভাবী পরিবার গুলো থেকে ক্ষুধার তাড়নায় বের হতে থাকে। তারা যুক্ত হয় এন জি ও গুলোর ট্রেনিং, ঋন, রিলিফ কিংবা কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচী গুলোতে। যেটা ডেভেলপমেন্টের ভাষায় 'উইমেন এমপাওয়ারমেন্ট', নারীরা এই তথাকথিত 'উইমেন এমপাওয়ারমেন্ট' ডিসকোর্সে যুক্ত হতে থাকে।এক আইলা এসে এই অঞ্চলের অর্থনীতি, সমাজ ব্যবস্থা, ধর্ম, রীতি নীতি, পেশা, মুভমেন্ট, রাজনীতি সব কিছুই চেঞ্জ করে দেয়। গত বছর যখন আমি এই এলাকায় আসি তখনো এই এলাকায় প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। আইলার পর থেকে এখানে মাছের কোন কমতি ছিল না। কিন্তু সেই মাছ মানুষ কিনে খেতে পারত না। খাবে কিভাবে তার পকেটে তো টাকা নেই। মাছ খেতে হলে তাকে নদীতে ধরে খেতে হবে। আমি ব্যাক্তিগত ভাবে এই এলাকার বেশ কয়েকটা বাজার গত দুই বছর ধরে পর্যবেক্ষন করছি, সেখানে আমি তেলাপিয়া মাছ ছাড়া আর কোন মাছ উঠতে দেখি নাই। কারন এই মাছের দাম কম। আর বেশির ভাগ মাছ চলে যায় শহরে। গত বছর এখানে তেলাপিয়া মাছের দাম ছিল ৪০ টাকা কেজি কিন্তু এ বছর সেই মাছের দাম হয়েছে ৮০ টাকা প্রতি কেজি। ঝিলিঘাটা বাজারে একদিন এক ছোট বাচ্চাকে আমি মাছ বিক্রি করতে দেখি। তো আমি তাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করি তোমার মাছের কেজি কত? সে আমাকে কোন উত্তর দেয় না। আমি পরপর তাকে তিনবার জিজ্ঞেস করি তোমার মাছের কেজি কত? সে কোন উত্তর দেয় না। পরে আমার কলিগ তাকে জিজ্ঞেস করে মাছের পোয়া কত তখন সেই শিশু উত্তর দেয় ২০ টাকা। এখানে বিষয়টা এমন যে এই এলাকার মানুষ অভাবের কারনে আসলে এক কেজি মাছ কিনে না। কিনে পোয়া হিসেবে। আর তাই সেই শিশুটি কেজি নামক এই বাটখারাটার সাথে পরিচিত নয়।
এ বছর লবন সরে যাওয়ার পথে। গ্রামবাসীরা আমাকে জানায় গত বছর আপনি চলে যাওয়ার পর এলাকার কিছু জমিতে অনেক চাষী সাহস করে ধান লাগায়। ইউনিয়নের মোট কৃষি জমির প্রায় ২৫% জমিতে ধান লাগানো হয় সেবার কিন্তু বন্যা হয়ে আমরা কেউ সে জমির ফসল ঘরে তুলতে পারি নাই। কিন্তু এ বছর প্রায় সকল জমিতেই ধান লাগানো হয়েছে। আর তরি তরকারী এবং সংসারের খরচ মোকাবিলায় তারা সকলেই তাদের বাড়িতে করেছেন সবজী বাগান। ফলন ও হচ্ছে ভালই
তারা জানান, যেহেতু এবছর মাছ নেই তাই এই সবজীই তাদের একমাত্র ভরসা। এ বছর মাছ না থাকার কারন হল যেহেতু জমিতে ধান চাষ করা হয়েছে, তাই সেখানে প্রচুর পরিমানে সার, কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে এবং মাছ, ব্যাঙ, সাপ সব মরে শেষ।
খাবার পানির সমস্যা এই এলাকার পুরোনো সমস্যা। এখানকার পানি পুরাই স্যালাইন। স্থানীয়রাও মুখে দিতে পারেন না এই পানি। আইলার পর তা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। খাবার এবং রান্নার জন্য তাই তাদের বৃষ্টির পানির উপর নির্ভরশীল হতে হয়। বর্ষার সিজনে তারা বড় বড় কলস কিংবা ট্যাংকিতে বৃষ্টির পানি জমিয়ে রাখেন।
চিত্রঃ মাটিতে বিশেষ ভাবে পুতে রাখা এই বড় কলসে বৃষ্টির পানি সংরক্ষন করা হয়
চিত্রঃ এটা একটা মাটির হাউস, হাউসের ভেতরে বড় একটা পলে ঢুকানো। এটা আবার টিনের চালার সাথে লাইন করে দেয়া। বৃষ্টির পানি গড়িয়ে সেই লাইন দিয়ে সোজা এই হাউসে প্রবেশ করে।
ধোয়া এবং গোসলের জন্য এই এলাকার মানুষ গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ছোট নদীটির উপর নির্ভরশীল।
এই নদী যে তারা শুধু গোসল এবং ধোয়া মোছার জন্য ব্যবহার করেন বিষয়টা তা না। কখনো এই নদী তাদের কাছে-
যোগাযোগের মাধ্যম
কখনো আহার যোগানদানকারী কিংবা অন্যকিছু।
গ্রামের প্রায় সকল বাড়ি ঘর কাচা। বাঁশ এবং গোলপাতা দিয়ে তৈরি কতটা ঝুপড়ি ঘর গুলোর মত। পুরো গ্রামে কোথাও একটা বিল্ডিং খুজে পাওয়া দুষ্কর শুধু জাপান সরকারের অর্থায়নে তৈরি করা এই মসজিদটি ছাড়া। তাও এই মসজিদের ৮ লক্ষ টাকা আনতে দুই লক্ষ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে গ্রামবাসীদের। হায় রে মানুষ! মসজিদ, মন্দির ও খাইতে বাকী রাখলি না!
আইলার কিছু পরে এখানে কিছু এন জি ও এখানে সাস্টেইনেবেল কৃষির চেষ্টা করেছিল এবং এখনো করছে। এর পদক্ষেপ হিসেবে তারা লবন সহিষ্ণু বীজ চাষিদেরকে প্রদান করছেন। এখানকার ঘের চাষীরাও কিন্তু খুব একটা ভাল নেই। এর মূল কারন হল ভাইরাস। আগে তারা এমন সমস্যায় পড়তেন না বলে তারা জানান। কিন্তু হ্যাচারীতে তৈরি হওয়া চিংড়ির রেনু আসার পর থেকেই নাকি তারা এই ভাইরাসের মুখোমুখি হচ্ছেন। আগে তারা জঙ্গলের নদীতে ধরা রেনু চাষ করতেন। কিন্তু এখন সেই রেনুর দাম অনেক বেশি। আবার খুব একটা পাওয়াও যায় না। এ বছর আমি দেখলাম তারা নতুন একটা ব্যবস্থা উদ্ভাবন করেছেন। চিংড়ি ঘেরেই ধান চাষ। এখানে একই সাথে চিংড়ি এবং ধান চাষ করা হচ্ছে। আমি জানিনা কতটুকু সফল তারা হতে পারবেন।
একই সাথে চিংড়ি এবং ধান চাষ।
চিত্রে, পানিতে যে একটা খাচার মত দেখা যাচ্ছে সেটা আসলে নিছক ফেলে রাখা হয়েছে এমন নয়। সেটা হল চিংড়ি ধরার যন্ত্র। কাঠের ফ্রেম আর জাল দিয়ে তৈরি বিশেষ একটা বস্তু। ঘেরে চিংড়ি ধরতে হলে, রাতের বেলা এই বস্তু ঘেরে ফেলে রাখতে হয় কোন কিছু ছাড়াই, এমনি এমনি। আর চিংড়ি গুলো সেই খাচার মধ্যে গিয়ে ঢুকে বসে থাকে। সকাল বেলা তুললে এক খাচা চিংড়ি। কি আজব এই প্রানী এ গুলো তাই না?
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জুলাই, ২০১৪ সকাল ১১:২৭