somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বনজীবীদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না-পর্ব তিন

০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পূর্বের পর্ব গুলোর লিংকঃ
বনজীবীদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না
বনজীবীদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না- পর্ব এক
বনজীবীদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না-পর্ব দুই

গত পর্ব গুলোতে আমি যেটা বলছিলাম, সর্দার আর গাজী, এই দুই গোষ্ঠীর একটা চমৎকার সহাবস্থান হল এই ৩ নং কয়রা গ্রাম।


চিত্রঃ ঝিলিঘাটা বাজার


চিত্রঃ ৩ নং কয়রা গ্রাম


চিত্রঃ গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ছোট নদীটি


চিত্রঃ বাজার থেকে গ্রামে ঢুকার রাস্তা


চিত্রঃ এটা ছোট নদীটির ঐপাড়ের রাস্তা, যেটা বাদকাশি ইউনিয়নে পড়েছে।


চিত্রঃ নদীর ওপাড় (বেদকাশি) থেকে তোলা

যদিও কয়েক দশক পূর্বে এই দুই গোষ্ঠী অর্থ্যাৎ গাজী আর সর্দারদের মধ্যে সব সময় কোন বংশ দল বেশি সম্ভ্রান্ত, এটা নিয়ে একটা কলহ লেগেই থাকত, একদল আরেক দলের সাথে কোন আত্মীয়তা অথবা সম্পর্কের ধারে কাছেও যেত না, দুই দলই নিজেদের সম্ভ্রান্ত এবং অন্য দলকে খাটো করে দেখত । কিন্তু কালের পরিক্রমায় তাদের মধ্যকার সেই প্রতিযোগীতা নিঃশ্বেস হয়েছে অনেক আগেই । তারা জানান, আমাদের পূর্ব পুরুষরা এই পার্থক্য করত, কারন তাদের টাকা-পয়সা আর সম্পদের প্রাচুর্য্য ছিল। এটা তাদের মানায় কিন্তু আমাদেরকে মানায় না। আমাদের টিকে থাকাই হচ্ছে আমাদের জন্য সব থেকে বড় প্রতিযোগীতা। গ্রামের দুই অংশে, এই দুই গোষ্ঠীর আলাদা আলাদা পুঞ্জিভূত অবস্থান, মনে হয় যেন (গাজী পাড়া আর সর্দার পাড়া) আজো সেই বিভক্তির সাক্ষী হয়ে টিকে আছে। সেই দিন গত হয়েছে অনেক আগেই। সর্দার আর গাজী, তারা এখন একই সূত্রে গাথা। বংশানুক্রমে তারা বনজীবী। এই জঙ্গলকে ঘিরেই তাদের সব স্বপ্ন, আশা, আকাংখা। জঙ্গল হল তাদের কাছে খুবই পবিত্র একটা সত্ত্বা। আর পবিত্র সত্ত্বা বলেই, জঙ্গলের ক্ষেত্রে তারা মেনে চলে হাজারটা নিয়ম। এই এলাকার নারীদের জঙ্গলে যাওয়া কঠিন ভাবে নিষেধ। কারন নারীরা সব সময় পাক-পবিত্র থাকতে পারেনা, যেহেতু জঙ্গল পবিত্র একটা এলাকা, তাই সেখানে অপবিত্র কারো প্রবেশ সম্পূর্ন রুপে নিষিদ্ধ, এবং এই নিষেধাজ্ঞা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে এই অঞ্চলের নারীরা। জঙ্গলে যাওয়া তো দূরের কথা, এটা তারা কখনো কল্পনাতেও নিয়ে আসে না। আর তাই জঙ্গলের খুব কাছে থেকেও তারা তাদের পিতা,ভাই অথবা স্বামীদের কাছে থেকে শুনে যায় জঙ্গলের গল্প, বাঘ-ভাল্লুকের গল্প, জঙ্গলে থাকা খারাপ মানুষেদের গল্প । জঙ্গলের গল্প শুনতে শুনতে অবস্থা এমন হয়েছে এ সব নারীদের যে, জঙ্গল যেন তাদের নখদর্পনে। বাড়ির পুরুষটা যখন জঙ্গলে যায়, তখন সব থেকে বেশি উৎকন্ঠায় থাকে এই 'অপবিত্রা' নারীটিই। এবং তাই তারা জঙ্গলে যাবার সময় এটা নিশ্চিত করে যে, তার পুরুষটি যাবার সময় হাতে কিংবা গলায় পীরের পড়ে দেয়া তাবিজ, মাদুলি ঝুলিয়ে নিল কিনা অথবা পড়ে দেয়া লাল রুমালটা সাথে নিল কিনা। এলাকার মানুষের দৃঢ় একটা বিশ্বাস যে, পীর সাহেবের পড়ে দেয়া এসব মাদুলী, তাবিজ কিংবা লাল রুমাল তাদের সাথে থাকলে জঙ্গলের বাঘ-ভাল্লুক তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবেনা। এই মাদুলী, তাবিজ কিংবা লাল রুমাল পড়ে দেয়ার ক্ষেত্রে সমসাময়িক সময়ে, সব থেকে জনপ্রিয় পীর হলেন সাতক্ষীরার হাসান হুজুর। কথিত আছে যে, এই হাসান হুজুর এমনই একজন আলেম ওলামা, যে তাকে একই সময়ে, একই সাথে একাধিক জায়গায় ওয়াজ করতে দেখা গেছে। জঙ্গলে যাবার আগে এই সকল বনজীবী দলে দলে সাতক্ষীরা গিয়ে অথবা কারো মাধ্যমে ৫০/৬০ টাকা হাদিয়া প্রদানের মাধ্যমে হাসান হুজুরের কাছ থেকে তার পড়ে দেয়া তাবিজ, মাদূলী অথবা পড়া লাল রুমাল নিয়ে আসেন। পীর সাহেবের পড়ে দেয়া এসব মাদূলী,তাবিজ অথবা লাল রুমালে আদৌ কোন কাজ হয় কিনা এটা নিয়ে আলোচনা করছিলাম গ্রামের প্রবীন, আনু কাকার (আনোয়ার গাজী) সাথে। তিনি আমাকে একটা গল্প বলেন, ‘তার বাবা এবং তার দাদা একবার জঙ্গলে গিয়ে মাছ ধরতে ধরতে বাদায় (জঙ্গলের স্থল অংশ) একটা বড় মৌচাক দেখতে পান। তো তারা মৌচাকটা কাটার উদ্দেশ্যে বাদায় উঠেন। আশে পাশেই যে মামা (বাঘ) ছিলেন তারা সেটা ঠাহর করতে পারেন নাই।তার ভাষায়, আমার বাবা গাছে উঠেছেন চাক নামাতে আর নিচে দাদু। ঠিক সেই সময় মামা এসে হাজির। মামা মুখ হা করে যেই দাদুর দিকে লাফ দিয়েছে, অমনি দাদু মামাকে (বাঘকে) বলে উঠেন, থাম। মামা দাদুকে ধরে ঠিকই, কিন্তু মুখ তার কাপটি লেগে যায়। হা করা মুখ সে আর বন্ধ করতে পারেনা। অবশেষে মামা দাদুকে ছেড়ে দিয়ে দৌর দিয়ে, জান নিয়ে পালিয়ে যায়। আর এর কারন হল, সে সময় দাদুর কাছে পীর সাহেবের পড়া রুমাল ছিল। তিনি বলেন, তিনি এই গল্প শুনেছেন তার বাবার কাছ থেকে।’
আসলে জঙ্গলের এমন হাজারটা গল্প শোনা যায়, এসব বনজীবী দের কাছ থেকে। যে গল্প চলতে থাকে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত। শুক্রবারটা এসকল বনজীবীদের কাছে খুব পবিত্র একটা দিন। তারা কেউ শুক্রবারে জঙ্গলে যান না। আর যারা জঙ্গলের নদীতে মাছ ধরার কাজে থাকেন তারাও এই দিনটিতে জঙ্গলে উঠেন না। কারন হিসেবে তারা মনে করেন এই দিনটিতে এখানকার যত প্রানী, উদ্ভিদ আছে তারা সকলেই ইবাদতে মশগুল থাকে। এসময় তাদের কে বিরক্ত করা অনেক বেশি গোনাহএর কাজ হিসেবে পরিগনিত হয় তাদের কাছে।
বনজীবীরা জঙ্গলে মাছ ধরতে যায় গোন হিসেব করে। এটা আসলে নির্ভর করে জোয়ার ভাটার উপর।


চিত্রঃ আসছে পাইস্যার মৌসুম, নৌকা বানাতে ব্যাস্ত গাজীরা।
তারা কেউ নিজের নৌকা নিয়ে যায়, আবার কেউ অন্যের নৌকায় ‘জন’ (দিনমুজুর) হিসেবে যায়, আবার কেউ নিজের নৌকা না থাকায় অন্যের নৌকা ভাড়া নিয়ে যায়। নৌকা ভাড়া ৭ দিন তথা এক গোনের জন্য ১০০০-১২০০ টাকা আর জন হল দিন ১৫০ টাকা এবং খাওয়া। যাবার সময় এরা নৌকায় চাল-ডাল, লবন, তরি তরকারী, চুলা, খাবার পানি এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে নেয়। একটা নৌকায় দুইজন করে মানুষ যায়। নৌকাটি ডিঙ্গি নৌকার থেকে একটু বড়। এই নৌকার খোলে একপাশে ছোট্ট করে তক্তা দিয়ে তৈরি একটা খাট এবং অন্য কিনারে রান্নার জন্য চুলা। জঙ্গলে গিয়ে মাছ ধরা এই সকল জেলে বৈশাখ,আষাঢ় এবং জ্যৈষ্ঠ এই তিন মাস গলদা চিংড়ির রেনু ধরে। শীতের তিন মাস তারা পাইস্যা (স্থানীয় ভাষায়) মাছের পোনা ধরে। আর বছরের বাদ বাকী সময় তারা বাগদার পোনা, কাকড়া এবং সাদা (অন্যান্য বড় মাছ) মাছ ধরে। জঙ্গলে ক্রমাগত মাছ/কাকড়া ধরতে থাকে এইসব জেলে।


চিত্রঃ সুন্দরবনের মাছ (সাদা মাছ)

মাছ/ কাকড়া ধরে যখন তারা ফেরত আসে, তখন তারা আগে চলে যায় খালের (নদীর পাশে যেখান থেকে ছোট নদী বের হয়েছে) গোড়ায়, কাঠকাটা অথবা জরসিং এ বিক্রির উদ্দেশ্যে। নদীপথেই যায় তারা এই সব জায়গায়। এই তিন জায়গায় নদীর কিনারে রয়েছে ছোট ছোট অনেক গুলো ঘর যেগুলোতে মাছ, পোনা, কাকড়া ক্রয় করা হয়। বনজীবীরা তাদের ধরা মাছ/পোনা/কাকড়া এখানে বিক্রি করে দিয়ে, টাকা নিয়ে যার যার বাড়িতে চলে যায়। সবার ক্ষেত্রে কিন্তু এমনটা হয় না।


চিত্রঃ লাল বৃত্ত চিহ্নিত ঘর গুলোই হল বিক্রয়ের স্থান
বনজীবী দের ঋন দেবার জন্য এই এলাকায় রয়েছে ‘কোম্পানি’, কোম্পানি আসলে কোন প্রতিষ্ঠান নয়। এরা আসলে বিশেষ একজন ব্যাক্তি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির থেকেও খারাপ এই কোম্পানি। বনজীবীদের ‘উদ্ধার’ করতে ছোট্ট এই এলাকাতে রয়েছে দেড়শ থেকে দুই শ র ও বেশি কোম্পানি। যে সকল মানুষ এই এলাকায় বনজীবীদের ঋন সুবিধা দিয়ে জঙ্গলে পাঠায় তাদেরকেই এই এলাকার মানুষ জন কোম্পানি বলে। এই সকল কোম্পানি এখানকার বনজীবীদের ঋন, নৌকা, জাল ইত্যাদি সরবরাহ করে এই শর্তে যে, যেই বনজীবী তাদের কাছ থেকে ঋন নিবে, তাকে ঋন পরিশোধ করতে হবে তার কাছে মাছ/কাকড়া/পোনা বিক্রি করতে হবে তার ধরে দেয়া দামে (যেটা বাজার মূল্য থেকে অনেক কম) এবং এর সাথে আরো যুক্ত হয় যে, এই সকল কোম্পানি আবার তাদের ঋন প্রদানকৃত সেই টাকার সুদ হিসেবে তাদের কাছ থেকে, মাছ ক্রয় করার পরও (তার ধরে দেয়া দামে) আরো কিছু টাকা কেটে রাখবে। আবার তথাকথিত এই সব ‘কোম্পনি’ অর্থ ছাড়াও অভাবী বনজীবীদের নৌকা, জাল ইত্যাদিও প্রদান করে থাকে, আর তার শর্ত হয় আরো কঠিন।
(চলবে)
আমার আজকের এই পর্বটি আমার প্রিয় একজন মানুষ, যার অনুপ্রেরনায় আমি এটুকু বুঝেছি আমি আসলেই খারাপ লেখি না, যার সাথে আমি যত মিশেছি তত অবাক হয়েছি এবং তার মত হতে চেয়েছি, যাকে অনুসরন করেছি, যাকে অনুকরন করার চেষ্টা করেছি এবং করছি, সেই প্রিয় মামুন ভাইকে উৎসর্গকৃত।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জুলাই, ২০১৪ সকাল ১১:৩১
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহমিকা পাগলা

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


এক আবেগ অনুভূতি আর
উপলব্ধির গন্ধ নিলো না
কি পাষাণ ধর্মলয় মানুষ;
আশপাশ কবর দেখে না
কি মাটির প্রণয় ভাবে না-
এই হলো বাস্তবতা আর
আবেগ, তাই না শুধু বাতাস
গায়ে লাগে না, মন জুড়ায় না;
বলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩




তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×