চিত্রে দখানো ছবিগুলো জনমনে বেশ দৃষ্টিকটু ঠাহর হলেও, এগুলো সম্পর্কে নতুন করে আর কোন কিছু বলার অপেক্ষা রাখে না। এগুলো বাংলাদেশে বহুল প্রচলিত তিনটি মরন নেশা। যার দরুন ধীরে ধীরে আমাদের আগামী প্রজন্ম মেধাহীন আর পঙ্গুত্ব বরন করে চলেছে, ধ্বংস হয়ে চলেছে পরিবার, রাষ্ট্র, সমাজ। খুব জনপ্রিয় এই নেশাজাতীয় দ্রব্য গুলো দেশের আনাচে কানাচে, গ্রামে গঞ্জে, হাটে বাজারে আড়ালে আবডালে দেদারসে বিক্রি হচ্ছে প্রশাসনের নাকের ডগায় বসে। আর এর প্রধান খরিদ্দার আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সহ অনেকেই। মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রনে দেশে একটি মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রন কমিশন এবং পুলিশ প্রশাসন থাকলেও কার্যত তারা অক্ষম এবং এই ব্যবসার প্রধান মুনাফাভোগী তারাই। পত্রিকায় কালে ভদ্রে দু একটা মাদক সম্রাট কিংবা সম্রাজ্ঞীর গ্রেফতারের খবর প্রচারিত হলেও তা খুব নগন্য। যেখানে কথা ছিল মাদকের এই ভয়াল ছোবলকে সমূলে উৎপাটনের সেখানে এই মরন ব্যাধি সমাজের শিরায় শিরায় আজ বাসা বেধে ফেলেছে। আশু প্রতিকার জরুরী।
দশ টাকা থেকে শুরু করে এক হাজার টাকা পর্যন্ত এই মরন নেশাজাত দ্রব্যগুলোর দাম। প্রধান ভোক্তা মূলত কিশোর আর যুব সম্প্রদায়। নেশা গ্রহনের ক্ষেত্রে নেশা হওয়া যেমন জরুরী তেমনি জরুরী দল বেঁধে কিংবা দুই তিনজনের সঙ্গীদল তৈরি করে শেয়ার করে এই নেশা গ্রহন ও বেশ আরামদায়ক। নেশাজাত দ্রব্য গুলো গ্রহনের অনুভূতি কেমন হবে তা অনেকটাই নির্ভর করবে যে , সেবনকারী কি পদ্ধতিতে এবং কি পরিমাণ গ্রহন করবে । সাধারণত সেবনে কল্পিত বস্তু , কল্পনার রং আরও প্রখর হয়ে দেখা দেয় । মায়া বিভ্রমও দেখা দিতে পারে । স্থান , কাল , পাত্রের কোন খেয়াল থাকে না । কথা বলার প্রবনতা বেড়ে যায় । চোখ লাল হয়ে যায় । এছাড়া শরীরের রক্তচাপ কমে যেতে পারে । ঘন ঘন শুকনা কাশি হতে থাকে । আস্তে আস্তে শিথিলতা আসে,ঘুম আসে । এমনকি স্ট্রোক করে মৃত্যুও হতে পারে।
স্থায়ী ক্ষতির মধ্যে,
১) রক্তকোষে পরিবর্তন ও প্রতিরোধী ক্ষমতা হ্রাস ।
২ ) জিনের গঠন পরিবর্তন হয়ে যায় ।
৩ ) ক্যান্সারের সম্ভাবনা দেখা দেয় ।
৪ ) যৌন অক্ষমতা ।
৫ ) এনজাইনা পেক্টোরিস
৬ ) ফুসফুসের ব্যাধি ।
৭ ) স্নায়ুতন্ত্রে পরিবর্তন ।
৮ ) ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন বা আরগ্যানিক ব্রেন-সিন্ড্রোম ।
এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
“যে ঘরে দেবদাস থাকে, তাহারই পাশের ঘরে চুনিলাল বলিয়া একজন যুবক আজ নয় বৎসর হইতে বাস করিয়া আসিতেছেন। তাঁহার এই দীর্ঘ কলিকাতা বাস বি এ পাস করিবার জন্য অতিবাহিত হইয়াছে-আজিও সফলকাম হইতে পারেন নাই বলিয়া এখনো এইখানেই তাঁহাকে থাকিতে হইয়াছে। চুনিলাল তাঁহার নিত্যকর্ম সান্ধ্যভ্রমণে বাহির হইয়াছেন, ভোর নাগাদ বাটী ফিরিবেন। বাসায় আর কেহ এখনও আসেন নাই। ঝি আলো জ্বালিয়া দিয়া গেল, দেবদাস দ্বার রুদ্ধ করিয়া শুইয়া পড়িল। তাহার পর একে একে সকলে ফিরিয়া আসিল। খাইবার সময় দেবদাসকে ডাকাডাকি করিল, কিন্তু সে উঠিল না। চুনিলাল কোনদিন রাত্রে বাসায় আসে না, আজিও আসে নাই। তখন রাত্রি একটা বাজিয়া গিয়াছে। বাসায় দেবদাস ব্যতীত কেহই জাগিয়া নাই। চুনিলাল গৃহপ্রত্যাবর্তন করিয়া দেবদাসের ঘরের সম্মুখে দাঁড়াইয়া দেখিল, দ্বার রুদ্ধ কিন্তু আলো জ্বলিতেছে; ডাকিল, দেবদাস কি জেগে আছ নাকি হে? দেবদাস ভিতর হইতে কহিল, আছি, তুমি এর মধ্যে ফিরলে যে? চুনিলাল ঈষৎ হাসিয়া কহিল, হাঁ, শরীরটা আজ ভাল নেই, বলিয়া চলিয়া গেল। কিছুক্ষণ পরে ফিরিয়া আসিয়া কহিল, দেবদাস, একবার দ্বার খুলতে পার? পারি, কেন? তামাকের জোগাড় আছে? আছে। বলিয়া দেবদাস দ্বার খুলিয়া দিল। চুনিলাল তামাক সাজিতে বসিয়া কহিল; দেবদাস, এখনো জেগে কেন? রোজ রোজই কি ঘুম হয়? হয় না? চুনিলাল যেন একটু বিদ্রূপ করিয়া কহিল, আমি ভাবতুম তোমাদের মত ভাল ছেলেরা কখনো দুপুর রাত্রের মুখ দেখেনি-আমার আজ একটা নূতন শিক্ষা হল। দেবদাস কথা কহিল না”।
উপরোক্ত চরন গুলো শরৎ চন্দ্রের দেবদাস হতে চারন করা। আমার আসলে ভীষন আগ্রহের জায়গা হল এই চুনিলাল নামক চরিত্রটি। আমরা যখন দেবদাস পড়ছি, শুনছি কিংবা দেখছি তখন খুব কৌশল করে কৌশলি এই চুনিলাল চরিত্রটি পাশ কেটে চলে যাচ্ছি। আমরা দেবদাসের করুন পরিনতির জন্য সমাজের শ্রেনী ব্যবস্থা, জাত-পাত এবং সম্ভ্রম বৈষম্য কিংবা তার পরিবারের সদস্যদের খুব করে দায়ী করে চলি কিন্তু দেবদাসের দেবদাস হয়ে ওঠবার গল্পে চুনিলাল ও যে সমান দায়ী তা কখনো ভেবে দেখি না। হয়তো বা ভাবী, কিন্তু খুব করে নয়।
সাম্প্রতিক সময়ে একজন মানুষ যে কিনা নেশা করে তাকে নেশা ধরার কারন জিজ্ঞেস করলে সে তার নেশা করার কারন হিসেবে হাজারটা দেবদাসীয় গল্প হাজির করে ফেলে। কিন্তু আমার মনে হয়, তার নেশায় আসক্তির পিছে খুব বেশি মাত্রায় কৌতুহল আর এই চুনি লাল নামক বন্ধুদের অবদান খুব বেশি মাত্রায় প্রভাব ফেলে একই সাথে দ্রব্য সমূহের সহজলভ্যতা তো থাকছেই।
দেশের ভারত সীমান্ত দিয়ে দেদারসে গাঁজা আর ফেন্সিডিল ঢুকছে আর মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে ঢুকছে ইয়াবা। আমি ব্যাক্তিগত ভাবে ইন্ডিয়াতে গিয়ে কোথাও ফেন্সিডিলের কোন চিহ্ন দেখি নাই। তারা মূলত ফেন্সিডিল উৎপাদন করে বাংলাদেশকে টার্গেট করেই। হয়তো বা মিয়ানমারের ও একই অবস্থা। আর এসব মরন নেশা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে প্রশাসনের নাকের ডগার উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে তার খরিদ্দারদের হাতে। খরিদ্দার তালিকা দেখলে রীতিমত আফসোস লাগে যে ছোট ছোট স্কুল পড়ুয়া বাচ্চারাও আজ এই মরন নেশা তাদের মুখে তুলে নিয়েছে।
সন্তানকে কিংবা পরিবারের সদস্যটিকে নেশামুক্ত রাখার কথা বলতে গেলে অনেক পরামর্শই চলে আসবে সামনে। যেমনঃ
১। পারিবারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করা
২। খোলামেলা আলোচনা করা
৩। হতাশ না হতে দেয়া
৪। বেশি বেশি সময় দেয়া
৫। বন্ধু সূলভ আচরন করা
৬। মাদকের কুফল সম্পর্কে অনেক অনেক আলোচনা করা
৭। ছোটদের সামনে মাদক গ্রহন না করা
এবং আরো আরো অনেক কিছু।
উপরোক্ত বিষয়গুলো অবশ্যই গুরুত্বপূর্ন তবে একই সাথে আমার প্রস্তাবনা হল কৌতুহল এবং বন্ধু নির্বাচন। পরিবারের প্রত্যেকটি সদস্যকে এই বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে যে সে কোন ভাবে মাদকের প্রতি কৌতুহলী হয়ে উঠছে কিনা। মাদক যে খুব ভয়াবহ একটা বস্তু, তার ভয়াবহতা তার মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দিতে হবে। এবং একই সাথে সে কি ধরনের বন্ধুর সাথে বন্ধুত্ব করতে যাচ্ছে এটাও খুব বেশি গুরুত্বপূর্ন।
একটা সুন্দর, সুস্থ মাদক মুক্ত সমাজের প্রত্যাশায়……..
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ১২:৩৩