১৯৭৩ সালের ২৯ জুলাই ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ঢাকা থিয়েটার। বাংলা নাটকের কিংবদন্তি অকাল প্রয়াত সেলিম আল দীন, একুশে পদকপ্রাপ্ত নাট্যব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু, নাট্যজন ম. হামিদ, রাইসুল ইসলাম আসাদ, পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, হাবীবুল হাসান, আল মনসুর, খায়রুল আলম সবুজ ও কামাল আতাউরসহ (বর্তমানে নাট্যজগতের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়) সে সময়ের এক ঝাঁক প্রতিভাদীপ্ত ও প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ ঢাকা থিয়েটারের সূচনা করেছিলেন।
ঢাকা থিয়েটারের স্লোগান ছিল—‘মৌলিক নাট্যচর্চায় বাংলা নাটকের মুক্তি নিহিত’? আর এর অন্যতম প্রতিশ্রুতি ছিল পেশাদার থিয়েটার প্রতিষ্ঠা। প্রতিষ্ঠার তিন যুগ পরও ঢাকা থিয়েটার একই স্লোগান আর প্রতিশ্রুতি নিয়েই এগিয়ে চলছে। ১৯৭৩ সালের ৯ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠার মাত্র পাঁচ মাসের মাথায় বিসিআইসি মিলনায়তনে মঞ্চায়ন করে এক সঙ্গে দু’টি নাটক। নাটক দুটির একটি সেলিম আল দীনের সংবাদ কার্টুন এবং অপরটি হাবীবুল হাসানের সম্রাট ও প্রতিদ্বন্দ্বীরা। নাটক দুটির নির্দেশনা দেন নাসির উদ্দীন ইউসূফ বাচ্চু। গত তিন যুগের কিছু বেশি সময়কালের মধ্যে ঢাকা থিয়েটার ৩৪টি নাটক মঞ্চায়ন করে।
শুরুর দিকে ঢাকা থিয়েটারের সঙ্গে মেয়েদের মধ্যে যারা জড়িত ছিলেন তাদের মধ্যে রয়েছেন—রেখা, দীপা, প্রিসিলা পারভীন, শারমীন মোর্শেদসহ অনেকে, যাদের বেশিরভাগই পরবর্তীকালে আর মঞ্চে সময় দেননি। ১৯৭৪ সালে ঢাকা থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত হন শিমূল ইউসুফ ও সুবর্ণা মুস্তাফার মতো প্রতিভাময়ী অভিনেত্রী এবং ’৭৫ সালে যুক্ত হন আফজাল হোসেন, জামিল আহমেদ প্রমুখ। প্রায় একই সময়ে যুক্ত হন জহির উদ্দীন পিয়ার, ফারাহ কবীর (বর্তমানে অ্যাকশন এইড বাংলাদেশের পরিচালক) প্রমুখ। ৭৭/৭৮ সালের দিকে ঢাকা থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত হন হুমায়ুন ফরীদি, কামাল বায়েজীদ প্রমুখ। আশির দশকে ঢাকা থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত হন ফারুক আহমেদ, শহীদুজ্জামান সেলিম, শতদল বড়ুয়া, সুভাশীষ ভৌমিক, নাসরীন নাহার, সাবেরী আলমসহ আরো অনেকে।
আজও পর্যন্ত ঢাকা থিয়েটারের অন্যান্য অর্জনের মধ্যে যে অর্জনকে শ্রেষ্ঠ অর্জন বলে বিবেচনা করা হয় তা হলো—সেলিম আল দীন, নাসির উদ্দীন ইউসুফ ও শিমূল ইউসুফ। এ তিনের অনন্য সম্মিলন নাট্যজগতে সূচনা করেছিল অন্যরকম বিস্ময়ের। সেলিম আল দীনের রচনা, নাসির ইউসুফের নির্দেশনা আর শিমূল ইউসুফের অভিনয় ও সঙ্গীতের অপূর্ব সম্মিলন এক ভিন্নরকম পরিবেশ সৃষ্টি করেছে ঢাকার নাট্যাঙ্গনে।
আধুনিক নাটকে বাংলার ঐতিহ্যবাহী নাট্যরীতির প্রবর্তন করেছিলেন সেলিম আল দীন। তিনি পশ্চিমা নাটকের বিপরীতে বাংলার গ্রামীণ পটভূমি থেকে হাজার বছরের চর্চিত গীতাবহ সমৃদ্ধ গীতল নাট্যরীতির প্রবর্তক। তার নাটকে অভিনয়ের সঙ্গে গান, সংলাপ আর আবৃত্তির এক সমন্বিত নাট্যকলা দর্শকদের ঐতিহ্যভিত্তিক সৃষ্টি রীতির সঙ্গে পরিচিত করে তোলে। সেলিম আল দীনের এ ঐতিহ্যিক অথচ অভিনব নাটকের মঞ্চায়নে নাসির উদ্দীন ইউসুফের সৃষ্টিশীল শৈল্পিক নির্দেশনা এবং শিমূল ইউসুফের সুদক্ষ অভিনয় ক্ষমতা ও সাঙ্গীতিক মেধা বারবার দর্শকদের এ কথাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছে।
ঢাকা থিয়েটারের ৩৪টি নাটকের মধ্যে মুনতাসির ফ্যান্টাসি, শকুন্তলা, রাস্তার নাটক চরকাকরার ডকুমেন্টারি, ফণীমনসা, কীর্তনখোলা, কেরামত মঙ্গল, হাতহদাই, ঢাকা, যৈবতী কন্যার মন, হরগজ, বনপাংশুল, প্রাচ্য, নিমজ্জল, বিনোদিনী, ধাবমান ইত্যাদি নাটকগুলো এক নামে দর্শক সাধারণের কাছে পরিচিত। অনেক মেধাবী ও প্রতিভাবান শিল্পীর আবির্ভাব ঢাকা থিয়েটার থেকে ঘটলেও সবাই যে থিয়েটারের সঙ্গে নিজেকে সর্বক্ষণ জড়িয়ে রেখেছেন এমন নয়, অনেকেই থিয়েটার ছেড়ে অন্যান্য মাধ্যমে ব্যাপক কাজ করে গেছেন। কিন্তু আমৃত্যু সেলিম আল দীন এবং নাসির উদ্দীন ইউসুফ ও শিমুল ইউসুফ ঢাকা থিয়েটারকে এগিয়ে নিয়েছেন প্রতি মুহূর্তে।
ঢাকা থিয়েটারের পথচলা ও সাফল্য সম্পর্কে নাট্যব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, সেলিমের অভাব প্রতিমুহূর্তে অনুভব করছি। সেলিম যে আন্দোলন করে গেছে আমার মনে হয় সেটা এখনও সম্পূর্ণ হয়নি। কোথাও যেন একটা থমকে যাওয়ার জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। যারা নতুন রচয়িতা ও নির্দেশক তারা সেলিমের সৃষ্ট পথে হেঁটে ঔপনিবেশিকতা থেকে কতদূর আমাদের নাটককে বের করে আনতে পারবে জানি না। সে যেভাবে ঢাকা থেকে দূরে পড়ে থেকে সব আনন্দ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নিভৃতে থেকে সত্যিকার আনন্দ সৃষ্টি ও সাধনা করেছেন, গ্রামে গ্রামে পড়ে থেকে আদিবাসী, সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে কত স্থান থেকে কতভাবে সংলাপ কুড়িয়ে এনেছেন—সহসাই এর কোনো পরিপূরক পাওয়া যাবে বলে মনে করতে পারি না।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




